ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ইচ্ছে হলেই লিখেছেন, সেলুলয়েডে এঁকেছেন স্বপ্ন

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৩ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইচ্ছে হলেই লিখেছেন, সেলুলয়েডে এঁকেছেন স্বপ্ন

হাসান মাহামুদ : মানুষ এক জীবনে কয়টি কাজে পারদর্শিতা অর্জন করতে পারে, সফল হতে পারে? এটি একটি প্রশ্ন হতে পারে, যার নির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই। আবার যদি বলা হয়, এক জীবনে মানুষের পরিচয় কয়টা হতে পারে? এরও নির্দিষ্ট কোনো উত্তর হয়তো নেই।

বহুবিধ পরিচয়ের অধিকারী কিছু মানুষ থাকেন। যারা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, প্রতিভার বিভিন্ন শাখায় তাদের অবদান স্বমহিমায় উজ্জ্বল। যারা যুগ পেরিয়ে শতাব্দীকাল উপমার আসনে আসীন থাকেন। যাদের প্রতিভা সব দিকেই আলোর মতো বিচ্ছুরিত। তাদেরই একজন ওবায়দ উল হক। তিনি একাধারে সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চলিচ্চত্রকার। একই সঙ্গে তিনি লেখক, কবি, ঔপন্যাসিক, প্রযোজক, সুরকার ও গীতিকারও। সম্পাদনা করেছেন, ইচ্ছে হলেই কলম নিয়ে আপন মনে লিখেছেন, আবার যখন চেয়েছেন তখন সেলুলয়েডেও স্বপ্ন এঁকেছেন। একই সাথে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় অনন্য দক্ষতার অধিকারী একজন কৃতী ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।

ওবায়েদ উল হক সেসব সংগ্রামী মানুষদের একজন, যাদের জীবনটাই কেটেছে শুধু সংগ্রামে। সময় বা বয়স তাকে পরাস্ত করতে পারেনি বরং বারবারই সময়ই তার কাছে পরাস্ত হয়েছে। কাজের প্রতি তার নিষ্ঠা আর ধ্যান এই বয়সেও এতোটুকু কমেনি। ৯৫ বছর বয়সেও তিনি নিয়মিত কলাম লিখেছেন।

একজন সৎ, নিষ্ঠাবান সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার ওবায়েদ উল হকের জীবনের বিচিত্র আলোচনায় সঙ্গত কারণে এসে যায় তৎকালীন সমাজ, সংস্কৃতি এবং ঔপনিবেশিক শাসনের বিস্তৃত বলয়। ওবায়েদ উল হককে নিয়ে আলোচনার অর্থ হলো খ্যাতিমান সাংবাদিকের আদর্শ, সততা, দেশপ্রেম, সচেতন প্রত্যয় এবং পর্বত প্রমাণ ব্যক্তিত্বের এক উজ্জ্বল জীবনালেখ্য উপস্থাপন করা।

ঔপনিবেশিক শাসনামলে কীভাবে সাংবাদিকতা এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের যাত্রা শুরু হয় তার একটি ঐতিহাসিক পটভূমি পাওয়া যায় ওবায়েদ উল হককে নিয়ে আলোচনায়। যখন এই প্রদেশে সাংবাদিকতার গলা টিপে রাখা হতো, সেই দুঃসময়ে অনেক সাহসী পুরুষ শক্ত হাতে কলম চালিয়ে গেছেন। যাদের আমরা সাংবাদিকতার দিকপাল হিসেবে ভূষিত করে থাকি। ওবায়েদ উল হকও তেমনই একজন ছিলেন।

ওবায়েদ উল হক পাকিস্তান অবজারভারে লেখালেখি করতেন। সে সূত্র ধরে ১৯৫১ সালে একদিন পাকিস্তান অবজারভারের সম্পাদক আবদুস সালাম তাকে তার পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে চাকরির আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি চিঠি লেখেন। ওবায়েদ উল হক প্রথমে বিষয়টি গুরুত্ব দেননি। কিন্তু সম্পাদক আবার টেলিগ্রাম পাঠালেন। এবার আর ফেলে দিতে পারলেন না। সেই থেকে তার সাংবাদিকতার শুরু। ঘটনাচক্রে সাংবাদিকতায় এলেও ভালোবেসে ফেলেন পেশাটিকে। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এখানে তিনি পার করেন জীবনের পঞ্চাশ বছর। এখন তো তার নাম মানেই সাংবাদিক।

দেশ স্বাধীন হলে ওবায়েদ উল হক সাংবাদিকতার সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করেন; ১৯৭২ হতে ১৯৮৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ অবজারভারের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর সম্পাদক হিসেবে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন ডেইলি নিউজ নামে আরেকটি নতুন দৈনিকে। তিনি দৈনিক বাংলা ও বাংলাদেশ টাইমস পত্রিকার ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

যে সরকারই যখন সাংবাদিকদের জন্যে ভালো মন্দ কিছু করতে গিয়েছেন, তখনই এগিয়ে এসেছেন ওবায়েদ উল হক। আর তাই সরকার যখন দেশে একটি প্রেস ইনস্টিটিউট করার চিন্তা করলো, তার আহ্বায়ক করা হলো ওবায়েদ উল হককে। তাঁরই চেষ্টা, পরিশ্রম এবং মেধার ফলে দাঁড়িয়ে গেলো প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)। তিনি পিআইবির প্রথম চেয়ারম্যান নিযুক্ত হলেন। এ সময় আরো অনেক সংগঠনের জন্যে কাজ করেছেন তিনি। একাধারে ছিলেন এডিটরস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান, নজরুল ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে তিনি জড়িয়ে রয়েছেন সাংবাদিকতায়। তাঁর কাজের একাগ্রতা, পরিশ্রম, সাহস, সততা, নিষ্ঠা ইত্যাদি কারণে তিনি আজ সাংবাদিকতার মডেল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব যখন সারাবিশ্বে আলোড়ন তোলে সেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় কেঁপে ওঠে অবিভক্ত বাংলা। যার পরিণতিতে ১৯৪৩ সালের সেই সর্বগ্রাসী মন্বন্তর, যা চিন্তাশীল বিজ্ঞজনদের মনন ও সৃষ্টি দ্যোতনায় প্রচণ্ড ঝড় তোলে। ওবায়েদ উল হকও তাড়িত হন সেই বিষন্ন প্রতিবেশের চরম দুঃসময়ের সঙ্কটাবর্তে। মননশীলতার বিদগ্ধ অনুভবে লিখলেন জীবনের সর্ব প্রথম গল্পগাথার এক করুণ আলেখ্য ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া’। শুধু লিখলেন না, যাদের কারণে এই অনবদ্য রচনা তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। সে সময় তার কাছে মাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্র নয়, চলচ্চিত্রকেই মনে হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ। তারই তোড়জোড় শুরু করলেন কলকাতায় এসে। ওবায়েদ উল হকের এক সাক্ষাতকারে স্পষ্ট হয় প্রথমে তিনি কিছুটা আইনগত বাধার সম্মুখীন হলেও পরবর্তী সময়ে তা বিধি অনুযায়ী মীমাংসার ফলে ছবি করার অনুমোদন পান সরকারের কাছ থেকে।

এই কৃতী সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার আইনের ওপর ডিগ্রি নিয়েও আইনকে পেশা হিসেবে নিলেন না। অবিভক্ত বাংলার সিভিল সার্ভিসের সদস্য হয়েও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নিজেকে বাঁধলেন না। তার চিন্তাশীল আর সৃজনশীল উদ্যমকে এতই গুরুত্ব দিলেন যে, নির্মোহ তাড়নায় বেছে নিলেন সাহিত্যিক আর সাংবাদিকতার অনিশ্চিত জীবন। তৃপ্তি পেয়েছেন, অনিশ্চয়তাকে জয় করেছেন। সর্বোপরি আনন্দ আর নান্দনিক অনুভবে জীবন কাটিয়েছেন।

ওবায়েদ উল হকের জন্ম ১৯১১ সালে ফেনীর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। ১৯৩৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি দর্শন ও মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। এর মধ্যে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ তার ভাবনাকে প্রচণ্ড নাড়া দেয়। ১৯৪৩ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে চলচ্চিত্রাঙ্গনে প্রবেশ করেন। ১৯৪৬ সালে মুক্তি পায় তার ছবি ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া’। বাংলা, বিহার, আসাম ও বার্মায় তার ছবি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। সিনে ম্যাগাজিন রূপমঞ্চের জরিপে সে বছর সেরা ১০টি ছবির একটি নির্বাচিত হলো তার ছবিটি। এটি পরে ঢাকার মানসী সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পর তিনি চলচ্চিত্রাঙ্গন ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ নানা পদে দায়িত্ব পালন করেন কৃতী এই মানুষটি। কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে নানা সম্মাননাও পেয়েছেন তিনি। ১৯৮১ সালে পেয়েছেন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক। পেয়েছেন বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, মার্কেন্টাইল ব্যাংক সম্মাননা, ইউনিসেফ স্বর্ণপদক, আব্দুস সালাম স্বর্ণ পদক, জহুর হোসেন চৌধুরী স্বর্ণ পদক, অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণ পদকসহ অনেক পুরস্কার।

তিনি ১৪টি বই, ছয়টি নাটক, তিনটি উপন্যাস, তিনটি কাব্যগ্রন্থ এবং ইংরেজিতে একটি আত্মজীবনী লিখেছেন। তার লেখা নাটকগুলো হলো- এই পার্কে, দিগ্বিজয়ে চোরাবাজার, সমাচার এই, রুগ্ন পৃথিবী, ব্যতিক্রম এবং যুগসন্ধি। দ্বৈত সঙ্গীত, সংগ্রাম এবং ঢোল-এই তিনটি তার উপন্যাস। কাব্যগ্রন্থগুলো হল- দ্বিধার ফসল, ছায়ানগর সংলাপ এবং গরিব হতে চাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে তার লেখা জীবনী গ্রন্থের নাম- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: অন্যরকম এক নেতা।

ওবায়েদ উল হক ৯৬ বছর বয়সে ২০০৭ সালের এই দিনে (১৩ অক্টোবর) পাড়ি জমান পারাপারে। মৃত্যুবার্ষিকীতে এই মহান মানুষটির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ অক্টোবর ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়