ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

​দেশের প্রথম বেসরকারি ভাষা জাদুঘরে দুর্লভ স্মৃতি

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৯, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
​দেশের প্রথম বেসরকারি ভাষা জাদুঘরে দুর্লভ স্মৃতি

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : ভাষা আন্দোলনের দুর্লভ সব ছবি স্তরে স্তরে সাজানো। রয়েছে ভাষা আন্দোলনের প্রথম বই। আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক এবং নওবেলাল পত্রিকার পুরোনো সংখ্যা। আছে ভাষা সৈনিকদের ব্যবহৃত অনেক দুর্লভ জিনিসপত্র। ভাষা আন্দেলনের প্রকৃত ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ধানমন্ডির কলাবাগান এলাকায় গড়ে উঠেছে ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘর। জাদুঘরে প্রবেশ করে যে কেউ কিছু সময়ের জন্য হলেও অনুভব করবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে ফিরে যাওয়ার অনুভূতি।

ধানমন্ডি কলাবাগান বাস স্টেশনের কাছে ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব সড়কের ৫নং বাড়িটি জনসাধারণের কাছে খুব বেশি পরিচিত নয়। যাদের এই বাড়িতে যাতায়াত আছে তারা জানেন এই বাড়িটির বিশেষত্ব। গেইট দিয়ে ঢোকার সময় হাতের বামে সাদা চুন কাজ করা দেয়ালে লাল রঙে লেখা আছে ‘ভাষা আন্দোলন জাদুঘর’। তিনতলা ওই বাড়ির নিচতলার দুটি কক্ষ নিয়ে ভাষা আন্দোলন ও এ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বেসরকারি উদ্যোগে প্রথম জাদুঘর এটি।

সাধারণ দর্শনার্থীরা শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত জাদুঘরটি ঘুরে দেখতে পারে। কোনো প্রবেশ মূল্য দিতে হয় না। কিন্তু সাধারণের খুব একটা যাতায়াত নেই এই বাড়িতে। গবেষক, ভাষা সৈনিকরা এবং ফেব্রুয়ারি মাস এলে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ও সংবাদকর্মীরা আসেন এই ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘরে।
 


কথা হয় জাদুঘরে ঘুরতে আসা গ্রীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম মিডিয়ার শিক্ষার্থী সাবরিনা নওরিন লিমুর সঙ্গে। তিনি ক্লাস অ্যাসাইনমেন্টের অংশ হিসেবে জাদুঘরে এসেছেন। লিমু রাইজিংবিডিকে জানান, ‘এই প্রথম জানলাম ভাষা আন্দোলন নিয়ে কোনো জাদুঘর আছে। তৎকালীন ভাষা আন্দোলনের সময়ের ক্যাপসনসহ দূর্লভসব ছবি সংরক্ষণে রয়েছে। এটা অসাধারণ। জাদুঘরটির আরো বেশি প্রচার প্রসার হওয়া দরকার।’

গ্রীন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী মাহফুজ ফারুক বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন বলতে আমরা রফিক, সালাম, বরকতসহ কয়েকজনের নাম জানি। কিন্তু এখানে এসে মনে হয়েছে ভাষা আন্দোলন সমগ্র জাতির ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি জড়িত দুর্লভ অনেক ছবি দেখলাম, এক একটি ছবি যেন হাজার কথা বলে।’

জাদুঘরের নির্বাহী পরিচালক এম আর মাহবুব রাইজিংবিডিকে জানান, ২০০৫ সালে ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়। ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের মৃত্যুর পর তার পরিবার জাদুঘরটির দায়িত্ব নেয়। জাদুঘরের জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়। পরিবারই এই ট্রাস্টের ফান্ড সরবরাহ করে থাকে। ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন কাজী গোলাম মাহবুবের স্ত্রী পেয়ারী মাহবুব।

জাদুঘরটি অন্য দশটি সাধারণ জাদুঘরের মতো নয়। কম জায়গায় গাদাগাদি করে সবকিছু রাখা হয়েছে। জাদুঘরের দেয়াল জুড়ে রয়েছে ফ্রেমে বাঁধাই করা বিভিন্ন ভাষাসংগ্রামীদের ছবি, পরিচিতি ও অবদান। আছে ভাষা আন্দোলনের দুর্লভ কিছু ছবিও। ১৯৫২, ৫৩ বা তারও আগে তোলা ভাষা আন্দোলন এবং শহীদ মিনারের সাদা-কালো ছবি, স্মারকগ্রন্থ, বর্তমান শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তরের ছবি, প্রথম শহীদ মিনারের ছবি। ভাষা আন্দোলনের পক্ষে তমদ্দুন মজলিশ কর্তৃক ১৯৪৭-এর ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত অধ্যাপক আবুল কাশেম, ড. কাজী মোতাহার হোসেন ও আবুল মনসুর আহমেদের লেখা ‘পাকিস্তানের রাষ্টভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তিকা। একমাত্র এই জাদুঘরেরই সংগ্রহে রয়েছে ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ ও সিলেটের ‘নওবেলাল’ পত্রিকার মূল কপি। ভাষাসংগ্রামী কাজী গোলাম মাহবুবের ব্যবহার সামগ্রী; কোট, ডায়েরি, টুপি, চাবির রিং, সম্মাননা পদক ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন ভাষা সংগ্রামীদের ব্যবহৃত ডায়রি, কলম, টেনজিস্টারও রয়েছে জাদুঘরে।
 


জাদুঘরের নির্বাহী পরিচালক এম আর মাহবুব জানান, এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এ পর্যন্ত সারাদেশের চার শতাধিক ভাষাসংগ্রামীর স্মৃতিচারণামূলক সাক্ষাৎকার ও জীবন বৃত্তান্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, তাদের সংগ্রহে ভাষা আন্দোলনের এমন কিছু ছবি রয়েছে, যা আর কোথাও নেই। এছাড়া ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত মোটামুটি সব বই-ই এই প্রতিষ্ঠানের সংগ্রহে রয়েছে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে এই জাদুঘর থেকে প্রকাশ করা হয়েছে ৫২টি বই।

ভাষা আন্দোলনের দুর্লভ স্মারক সংগ্রহ করা সম্পর্কে এম আর মাহবুব রাইজিংবিডিকে বলেন, দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে ভাষা সৈনিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্মারক সংগ্রহ করেছি। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও কিছু স্মারক সংগ্রহ করেছি। প্রথম দিকে অনেকে আমাদের জাদুঘরে স্মারক রাজি হয়নি।

এম আর মাহবুব জানান, বর্তমানে ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘর ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে কাজ করছে। দেশব্যাপী শহীদ মিনারের ইতিহাস নিয়ে কাজ করছে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়