ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

স্টিফেন হকিংয়ের ঘটনাবহুল জীবন

মোহাম্মদ আসিফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩২, ১৪ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
স্টিফেন হকিংয়ের ঘটনাবহুল জীবন

মোহাম্মদ আসিফ : ৭৬ বছর বয়সে বিদায় নিলেন স্টিফেন হকিং। মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত এই বিজ্ঞানীকে এই সময়ের সবচেয়ে সম্মানিত ও শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে গণ্য করা হয়।

হাস্যরসের এই মানুষটি বিজ্ঞানের একজন জনপ্রিয় দূত হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সেই সঙ্গে সাধারণ জনগণ যেন সহজেই তার যেকোনো কাজের তথ্য পেতে পারে সে ব্যাপারেও সচেতন ছিলেন। তার লেখা ‘এ ব্রিফ হিস্টোরি অব টাইম’ বইটি সর্বাধিক বিক্রিত বই হিসেবে পরিচিত। তিনি বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন এবং তার সংশ্লেষিত কণ্ঠস্বরকে বিভিন্ন রেকর্ডিংয়ের কাজে ব্যবহার করার অনুমতিও দিয়েছিলেন।

স্টিফেন উইলিয়াম হকিং ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি অক্সফোর্ডে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জীববিজ্ঞানী ছিলেন। জার্মানির বোমা হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি হকিং এর মাকে নিয়ে লন্ডন পালিয়ে আসেন। অক্সফোর্ড থেকে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণীতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর হকিং লন্ডন এবং সেন্ট আলবানিতে বড় হন এবং মহাবিশ্ববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর গবেষণার জন্য ক্যামব্রিজে যান। কিশোর বয়সে হকিং ঘোড়ায় চড়তে ও নৌকা চালাতে পছন্দ করতেন। কিন্তু ক্যামব্রিজে থাকাকালীন মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত হন। ফল হিসেবে তাকে আজীবনের জন্য পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হয়।

১৯৬৪ সালে হকিং যখন তার প্রথম স্ত্রী হিসেবে জেইনকে বিয়ে করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন ডাক্তাররা তাকে জানান, তিনি দুই থেকে তিন বছরের বেশি আর বাঁচবেন না। তবে ডাক্তাররা যেভাবে বলেছিলেন রোগটি সেভাবে বাড়েনি। আস্তে আস্তে এর প্রভাব বাড়ছিল। ততদিনে হকিং ও জেইন দম্পতির ঘরে তিন সন্তান জন্ম নেয়। ১৯৮৮ সাল। তখন হকিং ট্রেচিয়োস্টমির আওতায় ভয়েস সিন্থেসাইজার বা স্বর সংশ্লেষকের মাধ্যমে কথা বলতেন। এর মধ্যেই তিনি ‘এ ব্রিফ হিস্টোরি অব টাইম-এ লেম্যানস গাইড টু কসমোলজি’ লেখা সম্পন্ন করেন। এই বইটিকে ‘দ্য মোস্ট পপুলার বুক নেভার রিড’ আখ্যা দেওয়া হলেও ১০ মিলিয়নের বেশি কপি বিক্রি হয়েছিল।

খ্যাতি
ব্ল্যাকহোল শক্তি নির্গমণ করে এবং শূন্যে বিলীন হয়ে যায় হকিংয়ের আবিষ্কৃত এই তত্ত্ব হকিং রেডিয়েশন নামে পরিচিত। গণনা বা পরীক্ষা ব্যতীত বৈজ্ঞানিক সমাধানের অসাধারণ ক্ষমতার জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। কিন্তু সম্ভবত এটিই ছিল তার ‘থিওরি অব এভরিথিং’ যা অবলম্বন করে বলেছিলেন যে, মহাবিশ্ব সুপ্রতিষ্ঠিত আইন অনুসারে গঠিত হয়েছে, যা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে।

হকিং বলেন, ‘বৈশ্বিক আইনের এই ধারা আমাদেরকে পৃথিবী সৃষ্টির সম্পর্কে ধারণা দিতে পারবে। এছাড়াও পৃথিবী কোথায় যাচ্ছে বা এর কি শেষ আছে? যদি থেকেই থাকে তাহলে এর শেষ কীভাবে হবে? যদি এ প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা জানতে পারি তাহলে সৃষ্টিকর্তার চিন্তা সম্পর্কে ধারণা করা যাবে।’ হকিং যে হাস্যরসাত্মক ছিলেন তা সিম্পসনও স্বীকার করেন। হোমারের সঙ্গে একটি বারে মদ্যপান করার সময় তিনি বলেন, ‘মহাবিশ্ব যে ডোনাট আকৃতির হোমারের এই থিওরি চুরি করতে পারলে ভালো হতো।’

স্টিফেন হকিং রেড ডোয়ার্ফ এবং স্টার ট্রেক: দ্য নেক্সট জেনারেশন সহ বিবিসির একটি কমেডি সিরিজেও অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে দ্য রক গ্রুপ পিংক ফ্লয়েড তাদের অ্যালবাম ‘দ্য ডিভিশন বেল’ এ কিপ টকিং এর শুরুতে হকিংয়ের সংশ্লেষিত ভয়েস ব্যবহার করেছিল।
শারীরিক প্রতিকূলতা নিয়েই স্টিফেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের লুকাজিয়ান অধ্যাপক হিসেবে তার কাজ চালিয়ে যান এবং ২০০১ সালের দিকে তার দ্বিতীয় বই ‘ইউনিভার্স ইন এ নাটশেল’ প্রকাশিত হয়।

খামখেয়ালি জীবন
তিনি মনে করতেন এই রোগ তাকে কিছু সুবিধা করে দিয়েছে। তার মতে, এই রোগের সংক্রমণের আগে তিনি তার জীবন নিয়ে বিরক্ত ছিলেন। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থা তাকে অন্যের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে। তিনি প্রায়শই তার স্ত্রী জেইনের প্রশংসা করতেন যিনি গত ২০ বছর ধরে তার দেখাশোনা করে আসছিলেন। কিন্তু ১৯৯৫ সালে যখন স্টিফেন তার এক নার্সকে বিয়ে করে জেইনকে ছেড়ে চলে আসেন তখন তার আত্মীয়-স্বজনরা বিস্মিত হয়।

২০০০ সালের মধ্যে হকিং কেমব্রিজের অ্যাডেনব্রুকের হাসপাতালের জরুরি বিভাগের নিয়মিত চিকিৎসা নিতে আসতেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় তিনি কয়েক বছর ধরে শারীরিক ও মৌখিক অত্যাচারের শিকার হয়ে আসছিলেন। হকিং তার হুইলচেয়ার চালনায় খেয়ালী ও নিয়ন্ত্রণহীন হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। এবং তিনি দাবি করতেন যে, তার আঘাতের সঙ্গে নির্যাতনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। যার ফলে এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি।

২০০৭ সালের দিকে হকিং ‘ভমিট কমেট’ এর প্রথম আরোহী হিসেবে ওজন শূন্যতার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। মূলত অভিকর্ষের শূন্যতা নিরুপণে ‘ভমিট কমেট’ নামের এই বিশেষ বিমান তৈরি করা হয়। মহাকাশ অভিযানকে উৎসাহ দিতেই তিনি এই কাজ করেছিলেন। ‘আমি বিশ্বাস করি যে নিউক্লিয়ার যুদ্ধ কিংবা জ্বিনগতভাবে পরিক্ষিত কোনো ভাইরাস কিংবা অন্য কোনো দুর্যোগের কারণে পৃথিবীর জীবন জগৎ ক্রমবর্ধমান হুমকির মধ্যে রয়েছে। আমি মনে করি মানবজাতি যদি মহাশূন্যে না যায় তাহলে তাদের ভবিষ্যত অন্ধকার। আমি সাধারণ মানুষের মধ্যে মহাকাশ সম্পর্কে উৎসাহ সৃষ্টি করতে চাই।’

২০১৪ সালে, জেইন-হকিংয়ের বিবাহ এবং বিবাহ পরবর্তী অবস্থার ভিত্তিতে ‘থিওরি অব এভরিথিং’ চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। বিজ্ঞানীর চরিত্রে ভূমিকার অংশ হিসেবে হকিং এডি রেডমাইনির সঙ্গে দেখা করেন। ডিসকভারি চ্যানেলের একটি সিরিজে তিনি বলেন, পৃথিবীর বাইরে জীবনের অস্তিত্ব আছে এটা ভাবা যুক্তিসঙ্গত। তবে তিনি সতর্কতা আরোপ করে বলেন, অ্যালিয়েনরা পৃথিবীতে হামলা চালিয়ে এর সম্পদ কেড়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। একবার তিনি লিখেছিলেন, প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের পুরোটা সময় তিনি মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত ছিলেন। কিন্তু সেই রোগ তাকে সুখি পরিবার পেতে বাধা দেয়নি এবং কর্মজীবনেও তিনি সফল। এটা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কারোরই আশা হারানো উচিত না’।

তথ্যসূত্র : বিবিসি

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ মার্চ ২০১৮/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়