ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বিশ্বকাপে বিবর্ণ তারার মিছিলে ব্যতিক্রম ক্রিস্টিয়ানো

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২১ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিশ্বকাপে বিবর্ণ তারার মিছিলে ব্যতিক্রম ক্রিস্টিয়ানো

জাফর সোহেল: ৪ বছর পরপর এন্টার্কটিকা ছাড়া এই গ্রহের বাকি ছয় মহাদেশের ছয়শ কোটি মানুষ এক মাসের একটা শো দেখে। গ্রেটেস্ট শো অন আর্থের পরিচয়ে অলিম্পিকের সঙ্গে এর একটা প্রতিযোগিতা আছে। তবে, কেন জানি আমার মনে হয়, পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের কাছে ফুটবল বিশ্বকাপের মহাযজ্ঞটাই এই গ্রহের বুকে ‘সেরা শো’। বিশেষ করে, পৃথিবীতে মনুষ্যজগতের বাস যেখানে বেশি সেসব এলাকায়, সেসব দেশে এই শো-টাই জগতের সেরা আনন্দের খোরাক। প্রায় একশ কোটির ভারত আর ১৭ কোটির বাংলাদেশে বিষয়টা অন্তত এমনই। অলিম্পিক শো-তে এই দুদেশের মানুষের চোখ ততটা থাকে না, যতটা বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে থাকে।

আমাদের দেশে চায়ের আড্ডায় যত আলোচনা হয় তার চেয়ে বেশি আলোচনা এখন হয় ফেসবুকের ডিজিটাল আড্ডায়। সেই আড্ডায় মাসখানেক ধরে সবচেয়ে বেশি শব্দ ব্যয় হচ্ছে বিশ্বকাপ নিয়ে। সবচেয়ে বেশি ঝগড়া, মান-অভিমানও চলছে অচিন দেশের ‘চিন-অচিন’ ফুটবলারদের নিয়ে! বাতাসে ভেসে বেড়ানো শব্দগুলোয় কান পাতলে বোঝা যাবে- এখন সময় বিশ্বকাপের! তবে এই সময়টা প্রথম সপ্তাহে খুব একটা উপভোগ করতে পারেনি বাংলাদেশের সমর্থকেরা। বলা যায়, বেশিরভাগ সমর্থক হতাশ হয়েছেন। বিশ্ব ফুটবলের সেরা দুটি দল বেশি সাপোর্ট করে বাংলদেশীরা। পেলের ব্রাজিল আর ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা। যুগে যুগে তারকা বদল হলেও সমর্থন বদল হয়নি বাঙালির। পেলে যায়, রোমারিও যায়, রোনালদো যায়, রোনালদিনহো যায়- সমর্থনের জন্য তারকার ঘাটতি হয় না, শূন্যতা কখনো তৈরি হয় না; হলুদ জার্সিতে নতুন তারকা হয়ে আসেন নেইমার। একইভাবে ম্যারাডোনা, বতিস্তুতা, ওর্তেগা যায়, গ্রহের সেরা ফুটবলারের দাবি নিয়ে আসেন মেসি। বাঙালি সমর্থকেরা পায় নতুন নতুন নাম। নতুন নামে জার্সি হয়, দেয়ালে চিত্র হয়, ফেসবুকের ওয়াল ভরে যায় ছবিতে। সমর্থন তো নয়, রীতিমতো যুদ্ধ!

এ যুদ্ধে অনেকে মোটামুটি সহনশীল থাকলেও অনেকে অসহনশীলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যান। কথা কাটাকাটি-গালাগালি-কাদা ছোঁড়া রূপ নেয় মারামারিতে! এবার এমন দুটি ঘটনায় ইতিমধ্যে রক্ত ঝরেছে দেশের অন্তত দুটি জেলায়। এত উত্তেজনা আর উন্মাদনার মূল রসদ – ‘খেলার মাঠের জাদু’ দেখাটা তাই বেশি করে প্রত্যাশিত বাঙালির কাছে। কিন্তু প্রথম সপ্তাহে তা আর পেল কই এই আবেগী জাতি! তাদের দুই পছন্দের দল যে প্রথম ম্যাচেই পেল অপ্রত্যাশিত ফল, হোঁচট খেল অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলের সঙ্গে! তাই মন খারাপ ‘ব্রার্জেন্টিনা’ (ব্রাজিল+আর্জেন্টিনা) সমর্থকের! ভক্তদের মন ভরাতে পারেননি মেসি। উল্টো পেনাল্টি মিস করে প্রতিক্রিয়াশীল ভক্তদের কাছ থেকে শুনেছেন কটু কথা, গালমন্দ। একটু সহনশীল ভক্তরা যদিও আশাবাদী পরের ম্যাচেই স্বরূপে ফিরবেন মেসি, তবু মনের ভেতরে একটা অব্যক্ত ব্যথা ঠিকই লুকিয়ে- ‘এটা কী হলো, মেসি পেনাল্টি মিস করল!’ আর প্রতিপক্ষের খোঁচা তো হজম করতে হচ্ছেই! আইসল্যান্ডের মতো দলের সঙ্গে ড্র করে রীতিমতো সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছে গোটা আর্জেন্টিনা দল। উঠে এসেছে, ‘মেসি জাতীয় দলে কতটা কার্যকর’ পুরেনো সেই বিষয়টিও! বিশ্বকাপ কারা নেবে- এর উত্তরে যে কয়টা দলের নাম আসে আর্জেন্টিনার নামটাও তো সেখানে থাকে। প্রথম ম্যাচেই যদি ধরা খায়, তাহলে শিরোপার প্রত্যাশা টিকে থাকে কী করে?

পরেরদিন অবশ্য ব্যর্থতার মিছিলে যোগ হয়েছে ব্রাজিল আর নেইমারের নামও! প্রথম ম্যাচে তুলনামূলক দুর্বল দল সুইজারল্যান্ডের কাছে পয়েন্ট খোয়ানো কোনভাবেই যায় না এবারের ব্রাজিল দলের সঙ্গে। যদিও সুইসরা র‌্যাংকিংয়ে ছয় নাম্বার দল, তবু ব্রাজিল আর দলটির তারকা প্লেয়ারদের  নামের ভারেই কাটা পড়ার কথা তাদের। কিন্তু ম্যাচের পারফরম্যান্স রিভিউ করতে বসলে আপনি উল্টো সুইসদেরই নাম্বার বেশি দেবেন। অর্থাৎ সেই অর্থে ভালো খেলা উপহার দিতে পারেনি শিরোপার প্রথম দাবীদার সেলেসাওরা। ব্রাজিলিয়ানরাও পায়নি সাম্বা নাচের উপলক্ষ। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই জয় বঞ্চিত হওয়া পেলের উত্তরসূরিদের জন্য ইতিহাসে এটাই প্রথম। সুতরাং নেইমার-কুতিনহো-ফিরমিনোরা সামর্থের দশ আনাও মাঠে অনূদিত করতে পারেননি। দশবার ফাউলের শিকার হওয়ার পরও বলতে হবে, নেইমার মাঠে ছন্দে ছিলেন না। বিশ্বকাপ কতটা প্রাণবন্ত হবে তা প্রায়ই নির্ভর করে বড় দল কতটা ভালো খেলছে তার ওপর। দ্বিতীয় ম্যাচেই ‘ব্র্রার্জেন্টিনা’ তাদের পরিচিত ছন্দে ফিরবে এই আশায় কেবল বাংলাদেশের পাগল-উন্মাদ সমর্থকেরাই নয়, বসে আছে গোটা দুনিয়া।

বর্তমান চ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে তো প্রথম ম্যাচে খুঁজেই পাওয়া যায়নি! অর্থাৎ যেই চেহারায় তাদের দেখা যাওয়ার কথা সেই স্বরূপে দেখা যায়নি। তাদেরকে ১-০ গোলে পরাজয় উপহার দেয়া মেক্সিকোকেই বরং দেখা গেছে প্রাণবন্ত ফুটবল খেলতে। আক্রমণের ধারও বেশি ছিল আটলান্টিকের ওপারের দলটির। পাওয়ার ফুটবলের তকমা গায়ে লাগানো জার্মান দেয়াল ধসে পড়েছে প্রতিপক্ষের পাওয়ার ফুটবলের কাছেই! প্রথম ম্যাচে ধরা খাওয়ার মিছিলে ঢুকে পড়েছে আরেক ফেবারিট স্পেনও। আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার শেষ বিশ্বকাপ স্মরণীয় করার লড়াইয়ে নামার আগে অবশ্য তাদের ভেতরে একটু ওলট-পালট হয়ে যায়। কাপযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগের দিন বরখাস্ত হয়ে যায় লা রোজাদের কোচ। প্রথম খেলায় কি সেই কারণেই ছন্দপতন? নাকি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর গোপন অদম্য ইচ্ছার বাস্তব শুরুর কাছে হার! মেসির সঙ্গে সময়ের সেরা ফুটবলারের প্রতিযোগিতায় একবার এগিয়ে যান তো একবার পেছান। রিয়ালের রোনালদো একক কারিশমায় পর্তুগালকে করেছেন ইউরোপ সেরা। রিয়াল মাদ্রিদকে ৫ বার এনে দিয়েছেন চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শিরোপা। হোক না তার দেশ ফুটবলে সেরাদের তালিকায় নেই, কখনো খেলেনি বিশ্বকাপের ফাইনালও- তাই বলে কি শিরোপার স্বপ্ন দেখতে পারেন না রোনালদো?

খেলার মাঠে কত কিছুই তো ঘটে। ‘সি আর সেভেন’ শুরুর ম্যাজিকটা যদি ধরে রাখতে পারেন, তাহলে এই বিশ্বকাপ নতুন কিছু দেখতেও্ পারে। প্রথম ম্যাচেই হ্যাটট্রিক, স্বপ্ন দেখার তুনে এর চেয়ে উপযোগী শক্তি আর কী যোগ হতে পারে? মেসি ব্যর্থ, নেইমার ব্যর্থ, সালাহ লড়ছেন ইনজুরিতে, কাল তো হেরে বিশ্বকাপ থেকই বিদায় নিলেন- নিজের করে নেয়ার দৌড়ে আপাতত তারকাদের লড়াইয়ে সেরা অবস্থানে আছেন পর্তুগিজ তারকা। প্রথম দেখায় সত্যিকার অর্থে রোনালদোই জয় করেছেন ভক্তদের মন। একটা জমজমাট লড়াইয়ের ম্যাচও উপভোগ করেছে বিশ্বের তাবৎ ফুটবল ভক্তরা। কালও তারা জিতেছে সেই রোনালদোর গোলেই।

যাই হোক, খেলা তো সবে শুরু। আশাকরি দিন যত এগোবে, জমবে বিশ্বকাপ; জ্বলে উঠবেন ভক্তদের স্বপ্নের তারকারা। দ্বিতীয় ম্যাচ থেকেই স্বরূপে ফিরুক মেসি, নেইমাররা। বাঙালি উপভোগ করুক তাদের পছন্দের তারকাদের খেলা। জয় হোক সুন্দর ও নান্দনিক ফুটবলের।

লেখক: সাংবাদিক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়