ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘বুঝতে পারছিলাম মৃত্যু অবধারিত’

জিয়াউল হাসান কিসলু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘বুঝতে পারছিলাম মৃত্যু অবধারিত’

জিয়াউল হাসান কিসলু : যতটুকু মনে পড়ছে মাসটি সেপ্টেম্বরের শেষ কিংবা অক্টোবরের শুরু। প্রচন্ড ঠান্ডা পড়েছিল। রাতে আমরা ১১জন মুক্তিযোদ্ধা নৌকায় বিল পাড়ি দিচ্ছিলাম। স্থানটি ছিল যশোর অঞ্চলের কালা আথবা কালিয়া। যাই হোক, আমি ওই স্থানকে কালা-ই বলছি। এক বিল থেকে আরেক বিলে যাওয়ার যে মুখ ঠিক সেখানে রাজাকাররা বসে থাকত। তারা যদি মুক্তিযোদ্ধা ধরতে পারত তবে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে তুলে দিতো। শরণার্থী ধরলে লুটপাট করত। আমাদেরকে এই জায়গা দিয়েই পার হয়ে গন্তব্যে যেতে হবে, বিকল্প কোনো পথ নেই।

রাত তখন ২টা বা ৩টার মতো বাজে। প্রচন্ড শীত। অনেকটা ঝরো হাওয়া বইছিল। এ অবস্থায় প্রায় ৫০-৬০টি নৌকা বিলের ওই স্থানে পৌঁছানোর পর রাজাকাররা থামতে বলল। কিন্তু আমরা নৌকা না থামিয়ে জোরে চলতে শুরু করলাম। ওরা আমাদের নৌকা তাড়া করল কিন্তু ধরতে পারছিল না। আমাদের ছেলেরা সবাই গ্রামের, শক্ত সামর্থ্য। দাপটে বৈঠা চালিয়ে যাচ্ছিল। ছই ছাড়া একটি নৌকায় রাজাকাররা সম্ভবত ৪-৫জন ছিল। রাতের অন্ধকারের জন্য ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। তবে আমাদের নৌকায় ছই ছিল। আমরা ভেতরে বসেছিলাম। এক সময় ওরা গুলি করতে লাগল। 

আমাদের কারো হাতে অস্ত্র ছিল না। কারণ তখনো আমরা ট্রেনিং গ্রহণ করিনি। আমরা ট্রেনিং নেয়ার জন্যে ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলাম। নয় নম্বর সেক্টর কমান্ডারের কাছে নাম লিখিয়ে তাদের নির্দেশে আমরা রওনা হই। যাই হোক, রাজাকাররা গুলিবর্ষণ করতে থাকল। এক পর্যায়ে আমাদের কয়েকজন নৌকা থেকে পানিতে ঝাঁপ দেয়। তাদের মধ্যে আমি নিজেও ছিলাম। বিলের গভীরতা কিন্তু অনেক। আমি যেখানে ঝাঁপ দিলাম সেখানে অনেক গভীর। পানির নিচে কাদা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এদিকে পানি প্রচন্ড ঠান্ডা। (আমি ১১জনের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ ছিলাম। আমার বয়স তখন ষোল বছর। দশম শ্রেণির ছাত্র।) এই অন্ধকারের মধ্যে ঝাঁপ দেওয়ার পর নৌকা কোথায় চলে গিয়েছিল বুঝতে পারছিলাম না। আমার সঙ্গে যারা ঝাঁপ দিয়েছিল তারা কোন দিকে গিয়েছে তাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

তখন মনে করেছিলাম, পানিতে হয়তো আমি একাই পড়ে আছি। একদিকে ঠান্ডা পানি, অন্যদিকে বিলের কোনো কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছি না। পানি খেতে খেতে আমার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। হাবুডুবু খাচ্ছি। যখন এরকম চলছে তখন মনে হচ্ছিল, আমি আর বাঁচব না। যেদিকে সাঁতার কেটে যাই সেদিকেই পানি আর পানি, কোনো তীর খুঁজে পাই না। এদিকে ঠান্ডায় আমার শরীর প্রায় জমে গেছে। এক পর্যায়ে সাঁতার কাটার মতো শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম। পানিতে ডুবে যাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম আমার মৃত্যু অবধারিত। তখন আমার মা, ভাই-বোনের কথা খুব মনে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল, ওদের সঙ্গে আমার আর কখনো দেখা হবে না। এখানেই আমার সলিল সমাধি হবে।

শক্তিহীন হয়ে পড়ার কারণে পানির উপরে উঠতে পারছিলাম না। ফলে শ্বাসও নিতে পারছিলাম না। তখন সবটুকু শক্তি দিয়ে পানির উপরে উঠে আসার চেষ্টা চালাই এবং সফল হই। তখন হঠাৎ দেখি সামনেই একটি নৌকা। সেই নৌকা ভর্তি শরণার্থী। আমি চিৎকার দেওয়ার পর তারা আমাকে নৌকায় তুলে নেয়। নৌকায় ওঠার আধা ঘণ্টা পরই রাজাকাররা নৌকাটি আটকায়। সাধারণভাবে শরণার্থীদের সঙ্গে আমি মিশে যাই। নৌকা আটকে রাজাকাররা বলে, ‘তোমরা কেন চলে যাচ্ছ? আমরা এই দেশ স্বাধীন করতে দেব না। আমরা পাকিস্তান চাই। তোমরা শুধু শুধু চলে যাচ্ছো। তোমরা ভীতু।’ এমন নানারকম কথা বলছিল। আমি নৌকার ভেতরে বসে এসব শুনছিলাম। তারপর রাজাকাররা বলল, ‘তোমরা পঞ্চাশ টাকা দাও তারপর চলে যাও।’ তখন শরণার্থীরা বলল, ‘আমাদের কাছে কোনো টাকা পয়সা নাই। আমাদের ঘর বাড়ি সব জ্বালিয়ে দিয়েছে। এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়েছি।’ রাজাকাররা এতটাই ছ্যাচড়া যে, শেষ পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে দশ টাকা আদায় করে ছাড়ল। তারপর এই শরণার্থীদের সঙ্গে বিল পাড়ি দিয়ে আমি গন্তব্যে পৌঁছে যাই। গিয়ে দেখি আমার অন্য সব সহযাত্রী আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটে গেছে।

পানিতে এভাবে ভিজে যাওয়ার পর আমার নিউমোনিয়া হয়ে যায়। এরপর ২০-২৫ দিন আমি জ্বরে ভুগেছিলাম। তারপর ট্রেনিংয়ের ঢাক পড়ে, ট্রেনিং শেষ করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। এই ঘটনা আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ঘটনা। কখনো ভুলতে পারি না। বাকি জীবনে কখনো পারব বলেও মনে হয় না। জীবনকে তুচ্ছ করে, সমস্ত কষ্টকে আমরা গ্রহণ করেছি-এই দেশটি স্বাধীন করার জন্য। এটা আমার কাছে বিরাট গর্বের বিষয়। কিন্তু আমরা যে স্বাধীন দেশ চেয়েছিলাম, যে স্বাধীনতা চেয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন তা আমাদের সবার জীবনে সমানভাবে আসেনি। এ বিষয়টি এখনো কষ্ট দেয়।

আমার পাশে একজন হিন্দিু ছেলে যুদ্ধ করেছে, একজন খ্রিস্টান ছেলে যুদ্ধ করেছে কিন্তু এই দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়, ধর্মান্ধদের উত্থান হয়। এমন দেশ তো চাইনি। আমরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ চেয়েছি। সুন্দর জীবন যাপনের একটি ভূ-খণ্ড চেয়েছিলাম। আমরা যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তাদের একটাই স্বপ্ন ছিল- সোনার বাংলা গড়া। এই স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু আমাদের দেখিয়েছিলেন। এখনো আমরা এই স্বপ্নের পূর্ণতা পাইনি। ব্যক্তিগতভাবে এই বিষয়টি আমার কাছে অনেক আক্ষেপের বিষয়। তবে আমি নিরাশাবাদী নই। আমি তেত্রিশ বছর শিক্ষকতা করেছি। পুরোটা জীবন এই স্বপ্নের বীজ আমার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বপন করেছি। আমি বিশ্বাস করি, পরবর্তী কোনো প্রজন্ম এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবেই।

অনুলিখন : আমিনুল ইসলাম শান্ত 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ ডিসেম্বর ২০১৮/শান্ত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়