ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সরেজমিনে মাউশি : জাল সনদের খপ্পরে সর্বস্ব হারাচ্ছেন অনেকে

আবু বকর ইয়ামিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৯, ১৮ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সরেজমিনে মাউশি : জাল সনদের খপ্পরে সর্বস্ব হারাচ্ছেন অনেকে

আবু বকর ইয়ামিন : সোহরাব মিয়া (ছদ্মনাম)। অসুস্থ বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। পরিবারে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। বড় ভাই সুমন মিয়া (ছদ্মনাম) বিয়ে করেছেন আগেই। বাবা-মা ও ছোট বোনের পাশাপাশি বউ আর দুই সন্তানের যৌথ পরিবার। প্রাইভেট টিউশনি পড়িয়ে নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি কোনোরকম পরিবার চালাচ্ছিলেন সোহরাব। সুমন মিয়া স্বপ্ন বুনছেন, ছোট ভাই পড়াশোনা শেষ করে পরিবারে সহযোগিতার হাত বাড়াবে একদিন। অনেক টানাপোড়নের মধ্যে ২০০৫ সালে ব্যাচেলর অব কমার্স (বিকম) ডিগ্রি অর্জন করেন সোহরাব। পরে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে কম্পিউটার অফিস ম্যানেজমেন্টের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। এরই মধ্যে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় বিয়ে দেন ছোট বোনকে।

সোহরাব পড়াশোনা শেষ করে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েও বেকার থেকে গেলেন অনেক দিন। পরিবারের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। অবশেষে ২০১১ সালে একটি বেসরকারি স্কুলে কম্পিউটার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন খুব অল্প বেতনে। এতে পরিবারে কিছুটা স্বস্তি আসে।

দুই বছর শিক্ষকতার পর এমপিওভুক্ত হওয়ার আশায় ২০১৩ সালের আগস্টে বিনা বেতনে যোগ দেন অন্য স্কুলে। প্রাইভেট টিউশনি ও কৃষি কাজ করে জীবন চলছিল সোহরাবের। এরই মধ্য আবদ্ধ হন বিবাহবন্ধনে। কিন্তু সংসারে অভাব থাকায় বউকে বাবার বাড়িতে রাখেন তিনি। দীর্ঘ চার বছর বিনা বেতনে শিক্ষকতার পর ২০১৮ সালের মার্চে সোহরাব কাঙ্ক্ষিত এমপিওভুক্তি লাভ করেন। ভালো অঙ্কের বেতন পাচ্ছেন। বউকে নিয়ে আসেন নিজের বাড়িতে। তাদের সংসারে আসে একটি ফুটফুটে সন্তান।  কিন্তু অভাগা যেদিক যায় দুকূল যেন শুকিযে যায়। সোহরাবের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো না। হঠাৎ খবর আসে তার বেতন বন্ধ। কাগজপত্রের ঝামেলার কারণে ওপর থেকে নোটিশ এসেছে বলে জানান স্কুলের প্রধান শিক্ষক।

খবরটা শুনে সোহরাবের কপালে ভাঁজ পড়ল। তিনি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে গেলে প্রধান শিক্ষক একটি নোটিশ পড়ে শোনান। বলেন, নিয়োগের সময় নিবন্ধনের নকল সনদ প্রদান করায় তার এমপিও বাতিল। এখন তিনি সরকারি বেতনের কোনো অর্থ উত্তোলন করতে পারবেন না। প্রধান শিক্ষক তাকে ওপরে যোগাযোগ করতে বলেন। এর কয়েক মাস পর তিনি (প্রধান শিক্ষক) মারা যান। এরপর শুরু হয় সোহরাবের এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি। একবার এর কাছে, আরেকবার ওর কাছে যান। তবে কেউ কোনো সমাধান দিতে পারে না।

বৃহস্পতিবার সকাল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) ঘোরাঘুরি করছিলেন সোহরাব মিয়ার মতো আরো কয়েকজন শিক্ষক।

সোহরাব মাউশিতে এসে কী ধরনের সুবিধা পাচ্ছেন কিংবা কোনো সমস্যা মোকাবিলা করছেন কি না, জানতে চাইলে কান্নায় ভেঙে পড়েন এই শিক্ষক। বলেন, আমার জীবনটা শেষ, ভাই। যেদিকে যাই খালি বিপদ আর বিপদ। এক স্কুলের যোগদানের পর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এমপিওভুক্ত হই। এখন শুনছি, আমার নাকি কাগজে ঝামেলা। নোটিশ এসেছে, আমার নাকি নিবন্ধন সনদ নকল। অথচ আমি এসব বুঝি না। স্কুলে যোগদান করি নিবন্ধন ছাড়া। এটা ছাড়া নিয়োগও হয়ে গেছে। কিন্তু পরে বলা হলো, অডিটে এসেছে, নিবন্ধন দেখাতে হবে। আমি ২০০৫ সালে নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়েছি। কিন্তু সনদ তুলিনি। এখন হঠাৎ করে নিবন্ধন কই পাব? পরিচিত এক লোকের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, সমস্যা নেই, ২০ হাজার টাকা দিলে এটা বের করা যাবে। পরে অনেক কষ্টে আমি নিবন্ধন সংগ্রহ করে অডিটরকে দেখাই। এটি ২০১৫ সালের ঘটনা। তখন আমার চাকরি এমপিওভুক্ত হয়নি। পরে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনলাইনে আমার কাগজ চাইলে আমি সেগুলো প্রদান করি। মার্চে আমার এমপিও কার্যকর হয়। চার মাস বেতন তোলার পর আমাকে বলা হয়, আমার নিবন্ধন সনদ নকল এবং এ পর্যন্ত যত টাকা তুলেছি সব ফেরত দিতে হবে। এখন আমি বাবা-মা, বউ-বাচ্চা নিয়ে কই যাই? একদিকে বেতন পাচ্ছি না, অন্যদিকে বলছে, আমার আগের সব টাকা ফেরত দিতে হবে। এক্ষেত্রে আমি কী করতে পারি? কার সাথে কথা বলব, কিছুই বুঝতেছি না। চাকরিটা আমার খুব দরকার। 

পরে বিষয়টি জানতে মাউশির পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে গেলে উপ-পরিচালক রসময় কীর্তনীয়া জানান, উনি কাগজপত্র যখন সাবমিট করেছেন, তখন যা যা প্রদান করেন, সেটি পরে আবার যাচাইবাছাই হয়। প্রথমে ধরা না পড়লেও পরের দফায় বিষয়টি নিয়ে এনটিআরসিএর কাছে জানতে চাইলে তার সনদটি অকার্যকর বলে জানায়। সনদ নকল প্রমাণিত হওয়ায় আমরা আমাদের প্রতিবেদন দিয়ে দিয়েছি। এখন বাকি বিষয়াদি মন্ত্রণালয় দেখবে। সেখানে তার আত্মপক্ষ সমর্পনের সুযোগ আছে। অথবা নিজের কোনো বক্তব্য থাকলে সেটাও উপস্থাপন করতে পারেন। এ বিষয়ে তার কাছে চিঠি যাবে। আমাদেরও ভুলত্রুটি থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে উনি যদি উপযুক্ত প্রমাণ দেখাতে পারেন, সেক্ষেত্রে তার চাকরি বহাল থাকতেও পারে। তবে চিঠি পাওয়ার আগ পর্যন্ত তার আর কোনো অযথা চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।

বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) থেকে একটি ভুয়া সনদ দিয়ে এই লোকটিকে যে হয়রানি করা হলো সেটার কী হবে? এ বিষয়ে জানতে প্রতিষ্ঠানের উপ-পরিচালক দীনা পারভীনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, এনটিআরসিএ কোনো ভুয়া সনদ প্রদান করে না। কেউ যদি ভিন্ন মাধ্যমের আশ্রয় নিয়ে প্রতারিত হয় তাতে আমাদের কিছু করার থাকে না। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তার নিয়োগের সময় কাগজপত্র সঠিকভাবে যাচাই করে নেবে। এক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা সেটি যাচাই করে দিই। যদি সনদ ভুয়া প্রমাণিত হয় কিংবা কেউ প্রতারণার শিকার হয় সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ আইনের আশ্রয় নেবে।   

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ জানুয়ারি ২০১৯/ইয়ামিন/হাসান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়