ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পাকশী-রূপপুরে ৬ বছরে ৬ হত্যা, বিচার হয়নি একটিরও

শাহীন রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৩২, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাকশী-রূপপুরে ৬ বছরে ৬ হত্যা, বিচার হয়নি একটিরও

পাবনা প্রতিনিধি: পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী-রূপপুরে ৬ বছরে আলোচিত ৬টি হত্যাকান্ড ঘটেছে। চাঞ্চল্যকর এসব হত্যাকান্ডের একটিরও বিচার হয়নি।

এসব হত্যার শিকার হয়েছেন যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগ নেতা ও পাকশী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ। কিন্তু একটিরও বিচার না হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে রয়েছে ক্ষোভ ও হতাশা। হত্যাকান্ডের পেছনে রয়েছে রূপপুর প্রকল্পের কাজ, আধিপত্য বিস্তার ও দলীয় গ্রুপিং।

পাকশী-রূপপুরে গত ৬ বছরে একে একে খুন হয়েছেন যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহমেদ মিতু (৩০), উপজেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি রফিকুল ইসলাম লাবলু, পাকশী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এএসআই সুজাউল ইসলাম (৩৫), পাকশী ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সহ-সভাপতি শাজাহান আলী, পাকশী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সদরুল আলম পিন্টু এবং সর্বশেষ পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান সেলিম।

চাঞ্চল্যকর এসব হত্যাকান্ডের সবগুলোই পাকশী ও রূপপুরে সংঘটিত হয়েছে। এর একটিরও কোন বিচার হয়নি এখনো, ধরা পড়েনি আসামীরাও।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ পাকশীতে অস্ত্রধারী ক্যাডারদের ছুরিকাঘাতে মোস্তাক আহমেদ মিতু (৩০) নামের এক যুবলীগ নেতা নিহত হন। ওই দিন রাতে পাকশীর রেলওয়ের এম.এস কলোনী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত মিতু পাকশী বাজার পাড়ার আমজাদ হোসেনের ছেলে এবং পাকশী ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এ ঘটনায় নিহত মিতুর স্ত্রী মৌসুমি আক্তার বেলী বাদী হয়ে ঈশ্বরদী থানায় ঘটনার পরদিনই একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু গত ৬ বছরেও এ মামলার কোন বিচার হয়নি।

২০১৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরদী উপজেলা যুবলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম লাবলু (৩৫) কে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহত লাবলু ঈশ্বরদীর পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রামের মৃত ঝড় মন্ডলের ছেলে। লাবলু বিশ্বাসের ভাই ডাবলু বিশ্বাস জানান, ঠিকাদারি কাজ ভাগাভাগি নিয়ে ঝামেলার কারণে তার ভাইকে দুর্বৃত্তরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে খুন করেছে। কিন্তু গত ৫ বছরেও আলোচিত এই হত্যাকান্ডের বিচার না হওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ ও শঙ্কিত।

২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর ঈশ্বরদীর পাকশী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এএসআই সুজাউল ইসলাম (৩৫) কে নৃশংসভাবে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পাকশী রেলওয়ে স্টেশনের সন্নিকটে ও পাকশী রেলওয়ে কলেজের পেছনের একটি কলাবাগান থেকে হাত-পা-মুখ বাঁধা ও গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করে ঈশ্বরদী থানা পুলিশ। পুলিশের এএসআইকে কেন হত্যা করা হয়েছে তা আজও জানা যায়নি। ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এএসআই সুজাউল হত্যাকান্ডের বিচার হয়নি।

২০১৭ সালের ২৩ মার্চ রূপপুর গ্রামে শাজাহান আলী মন্ডল (৪৫) নামের এক যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা। নিহত শাজাহান আলী পাকশীর রূপপুর গ্রামের মৃত মোহাম্মদ আলী মন্ডলের ছেলে। তিনি পাকশী ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। নিহত শাজাহানের ছোট ভাই জালাল উদ্দিন জানান, পদ্মা নদীর বালু বিক্রি ও রূপপুর প্রকল্পে বালু সাপ্লাইয়ের কাজ ভাগাভাগি নিয়ে পূর্বশত্রুতার জের ধরে তাকে স্থানীয় কয়েকজন সন্ত্রাসী কুপিয়ে ও পিটিয়ে তাদের দুই ভাইয়ের বাড়ি-ঘর ভাংচুর করে। এ ঘটনায় থানায় মামলা করার পর তারা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে, নতুন রূপপুর ফুটবল মাঠ সংলগ্ন চায়ের দোকানের সামনের রাস্তায় শাজাহান আলীকে উপর্যুপরি কুপিয়ে ও ইট দিয়ে মুখমন্ডল থেঁতলে নৃশংসভাবে হত্যা করে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। দুই বছর পেরিয়ে গেলেও চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকান্ডের বিচার হয়নি।

এ হত্যাকান্ডের এক বছর পরই ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল পাকশীর রূপপুর মোড়ে পাকশী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সদরুল আলম পিন্টুকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীন কোন্দলের জের ধরে তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে অপর গ্রুপের ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। হামলার সময় দেশীয় অস্ত্র দিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন অংশে কুপিয়ে জখম করার পর কয়েক রাউন্ড গুলিও করে সন্ত্রাসীরা। তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানেই তিনি মারা যান। এ হত্যাকান্ডের বিচারও হয়নি।

এসব আলোচিত হত্যাকান্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে রূপপুর গ্রামে নিজ বাড়ির সামনে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামীলগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান সেলিমকে (৬২) আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা দুর্বৃত্তরা গুলি করে হত্যা করে। মোস্তাফিজুর রহমান সেলিমের স্ত্রী দিলারা বেগম জানান, স্থানীয় প্রভাবশালী চক্র ক্ষমতার জোরে এলাকায় ভূয়া কৃষকের তালিকা তৈরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। সে তালিকা চ্যালেঞ্জ করে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণেই এই হত্যাকান্ড।

আলোচিত এসব হত্যাকান্ড সম্পর্কে পাকশী ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পাকশী ও রূপপুরে একের পর এক হত্যাকান্ডে এলাকার মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।’

পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি হবিবুল ইসলাম হব্বুল বলেন, ‘এসব হত্যাকান্ডের বিচার এবং কোন আসামী গ্রেফতার না হওয়ায় আমরাও শঙ্কিত হয়ে পড়েছি।’

পাবনা জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ এমপি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের আমি নির্দেশ দিয়েছি যত দ্রুত সম্ভব এসব হত্যাকান্ডের আসামীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার জন্য। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।’

ঈশ্বরদী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বাহাউদ্দিন ফারুকী বলেন, ‘আমি অল্প কিছুদিন হলো ঈশ্বরদী থানায় এসেছি। আগের ৫টি হত্যাকান্ডের বিষয়ে থানার ফাইল ঘেঁটে বিস্তারিত অবগত হয়েছি, এসব হত্যাকান্ডের আসামী বিশেষ করে গত ৬ ফেব্রুয়ারি রূপপুরে মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামীলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমান সেলিম হত্যার ব্যাপারে আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, খুব কম সময়ের মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে।’




রাইজিংবিডি/পাবনা/১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/ শাহীন রহমান/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়