ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

নববর্ষে মুখ ফেরাবো কোথায়?

সাখাওয়াত টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৫ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নববর্ষে মুখ ফেরাবো কোথায়?

 

সময় অসীমের দিকে ধায়। তার শেষ নাই। সেই অর্থে শুরুও নাই। কিন্তু বস্তু বিশ্বের শুরু আর শেষ দৃশ্যমান। ফলে দর্শনের সরল জগতে আমরা ‘সময়’ নামক ভাবকে বস্তু দিয়ে ধরি। অধরা ভাবকে ধরার নামই তো দর্শন। ‘বস্তু’ বলতে নিছক ইটের টুকরা নয়। ‘আকার’ ‘আয়তন’ আর ‘জায়গা’ দখল করা নয়। তাহলে কী? আমরা বস্তুকে প্রকৃতি জ্ঞান করছি। আমরা বলছি ভাব অভাব স্বভাবের কথা। আর ভাবের রূপককে বস্তু জ্ঞান করছি। ফলে বস্তুর অধরা ভাবকে ধরা তো সময়কে ধরা। কেন? প্রকৃতির কথা ধরলে বলা যায়, প্রকৃতি সময়ে সময়ে তার রূপ বদলায়। ভাব বদলায়। চক্রাকারে স্বভাব বদলায়। যাকে জনমানস প্রকৃতির আচরণ হিসেবে জানে এবং বোঝে। যাকে আমরা বলছি স্বভাব। প্রকৃতির আচরণের বদল সরল নয়। বলা চলে সহজ। গাণিতিক হিসাব কষলে একটা হিসেব হয়ত মিলবে। সেটা রেখা আনুপাতিক বদলায় না। তল উত্তল অধতল নানা পাটাতনে তার চক্র। প্রকৃতির পালা বদল এতে মূখ্য। ফলে মানুষ প্রকৃতির নিয়মেই তাকে সাজিয়ে নেয়। নানা কালখণ্ডে ভাগ করে। সেটা কেমন?

শেষ দিয়েই শুরু নববর্ষের। প্রকৃতির কথা ভাবলে সময় অনন্ত আর অসীমের ধারণার জন্ম দেয়। মানে সময় প্রকৃতিকে ধরে। আবার প্রকৃতির কাছে সময় ধরা। কেননা ধরা আর অধরা দুই ধারণা প্রকৃতির জমজ বোন। ধারণা মানে ধার না। অভাবগত রূপের স্বরূপ। এটা ঋণাত্মক নয়, ধনাত্মকেরই অর্থ বহন করে। যার কারণে মানুষ প্রকৃতির কাছে ঋণী। প্রকৃতির যে রূপ মানুষ ধরতে পারে, সেটা বস্তুর নামান্তর মাত্র। যে অধরা মানুষের ধরার ভেতর নাই সেটাকে আমরা বলছি ভাব। অভাব এখানে প্রকৃতির অধরা রূপ। ফলে মানুষ কল্পনা প্রবণ হতে বাধ্য। এই প্রবণতাকে ধারণ করার নামই ধর্ম। বস্তুগত ধারণা থেকে বিশ্বাসের জন্ম। বস্তুতে আর ভাবের বিশ্বাস একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ফারাক শুধু খাঁজ কাটা ক্ষমতার ব্যাসার্ধ। কারণ বস্তুকে পাশ কাটিয়ে ভাব অধরাই থাকে। কেননা অধরা ভাব বস্তুর ভাব নয়। এটা বস্তুর বেশি কিছু। এটা ভাব দর্শনের কথা। এটাকে পাশ কাটিয়ে মানুষের প্রকৃতিতে টিকে থাকা অসম্ভব ব্যাপার।
মানুষ ধারণাগতভাবে সীমাবদ্ধ প্রাণী। কথাটা পুরাতন মনে হতে পারে। সীমাবদ্ধ বলেই মানুষ প্রকৃতির নিয়মে হিসেব কষতে থাকে। তবে কথাটা আদৌ পুরাণ নয়। কেননা চিন্তার জগতে মানুষ প্রকৃতির মধ্যে বাস করে। ফলে প্রকৃতি চিন্তার জন্ম দেয়। আর চিন্তা দিয়ে মানুষ প্রকৃতিকে বদলাতে চায়। মানুষ যে বস্তুগত দখলের উপর বেঁচে আছে, সেটা বস্তুর প্রতি অগাধ ব্যবহারিক বিশ্বাসেরই ফল। কথা নতুন শোনাবে হয়তো। আদ্যকথা, প্রকৃতি ভাব দিয়ে চলে, বিশ্বাস দিয়ে নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, বদলানো কি সম্ভব? প্রকৃতিকে পুরোপুরি বদলানো সম্ভব নয়। তবে বদলকে রূপান্তর অর্থে ধরলে ‘বদল’ কে ‘বদল’ আকারে দেখা যাবে! আদতে সেটা বদল নয়, রূপান্তর মাত্র। এক অর্থে সংস্কারই বলা চলে। বদল মানে সংস্কার নয়, মূলসহ পাল্টে দেয়া। মানে বিপ্লব। দর্শনের এই সহজ সূত্রটি ধরলে আমরা ‘নব’ ওরফে ‘নতুন’ ভাবের অর্থ ধরতে পারব।

নববর্ষ কি? সোজা কথা, কাল গণনার শুরু। শুরু নিয়ে নানা পথ আর নানা তর্ক জারি আছে দেশে-বিদেশে। তবে কথা স্পষ্ট, নববর্ষের ভিত্তিমূল ধর্ম বা ধরা। ধরা দুই অর্থে, অধরাকে ধরা আর বস্তুকে ধরা। ধরা তো আত্মীয়তার যোগান্তর মাত্র। আদি যুগে প্রকৃতির সাথে বস্তুর আত্মীয়তা নির্ণয়ের ধারণা হতে নববর্ষের জন্ম। আত্মীয়তা কী ধরনের? আত্মীয়তার ধরন দিন-রাত্রি, জোয়ার-ভাটা, অমাবশ্যা-পূর্ণিমা, চন্দ্র-সূর্য, ঋতুর নানা রূপ-রূপান্তর ইতি আদি। এই আত্মীয়তা নির্ণয় করতেন জোতির্বিদগণ। আদি সভ্যতার দিকে তাকালে দেখা যাবে, দিন গণনার বেলায় এক সূর্যোদয় হতে আরেক সূর্যোদয় নাগাদ ‘সৌরদিন’। মানে এক সূর্যোদয় হতে আরেক সূর্যোদয় নাগাদ ‘একদিন’। আর এক চন্দ্রোদয় হতে অপর চন্দ্রোদয়কে ‘চন্দ্রমা’ হিসেবে ধরে নেয়া হতো। এক পূর্ণিমা হতে অপর পূর্ণিমা নাগাদ মানা হতো ‘চন্দ্রমাস’। একই সূত্র ধরে জোতির্বিদগণই আবিষ্কার করেন ‘কালের একক’। কালের একক হচ্ছে ক্ষণ, দিন, সপ্তাহ, পক্ষ, বছর।
আমরা খানিক পরকালের ইতিহাসের দিকে তাকাব। মেসোপটেমিয়া, মিশর আর ব্যাবিলন প্রায় সমসময়ে কাল গণনা শুরু হয়। মেসোপটেমিয়ায় চন্দ্র দেবতা ‘নানার’, ব্যাবিলনে সূর্য দেবতা ‘শামাস’ আর মিশরে নক্ষত্র দেবতা ‘সিরিয়াস’ নামক ধর্মদর্শনকে আমলে নিয়ে বর্ষ গণনা শুরু হয়। মজার দিক হলো, তখন পশু শিকার আর লালন-পালন সমাজে প্রথা। আর কৃষি সভ্যতা তখন বিকাশমান। মুশকিল হলো, প্রকৃতি আর মানুষের মধ্যে যে সম্পর্ক সেটা সমান্তরাল নয়। প্রকৃতি নিজেকে যে রূপে সাজায়, মানুষকে তার ভেতরে বেঁচে থাকতে হয়। মানুষ প্রকৃতির নিয়ামক মাত্র। মানুষের বেঁচে থাকা জীবনের মূল প্রেরণা নয়। মূল প্রেরণা হলো জীবনকে অর্থবহ করে তোলা। ফলে মানুষকে সংগ্রাম করতে হয়। সেটা কেমন?
প্রকৃতির নিয়মানুসারে মানুষ শস্য উৎপাদন করে। এটা আদি কি বর্তমান সব সমাজের চিরাচরিত প্রথা। কিন্তু, প্রকৃতি যেহেতু অসমান্তরাল রূপে চলে সেহেতু মানুষ কখনো কখনো বিরূপতার কাছে অসহায় হয়ে পড়ে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, একদা মিশরকে নীলনদের দুঃখ বলা হতো। গ্রীষ্মের দাবদাহের পর দেখা দিতো জলোচ্ছ্বাস। ভাসিয়ে নিতো শস্যাদি। কিন্তু জলোচ্ছ্বাস বছরে একইদিনে আসছে না। আদতে প্রকৃতির এই অসমান্তরাল রূপ ঋতুরই পালাবদল। জোতির্বিদরাও প্রকৃতির এই আচরণে অসহায় হয়ে পড়ে। তারা দেখতো, প্লাবনের আগে একটি তারা আকাশে দেখা যায়। সে তারা জন্ম নিয়েছিল সূর্যের দেহ থেকে। নাম ‘সিরিয়াস’ ওরফে ‘ডগস্টার’। ‘গথিক সাইকেল’ বা বর্ষগণনার এই কাহিনি অনেকের জানা হয়তো। কিন্তু ইসায়িপূর্ব ২৪০০ শতের আগে মিশরে বর্ষ গণনা শুরু হয়েছিল। গথিক সাইকেলে তাদের পৌঁছতে সময় লেগেছিল ইসায়িপূর্ব ১৩২১ সাল নাগাদ। এতো সময় কেন? ধর্ম এখানে মূল প্রশ্ন আকারে দেখা দেয়। প্রকৃতির প্রতি ভাব আর বস্তুর প্রতি বিশ্বাস দুই-ই ধর্মীয় দর্শনের গোড়া। দেবতার দান বর্ষপঞ্জি আর বস্তুগত শস্য প্রেম একসাথে গাঁথা। ফলে এটাকে সংস্কারের চিন্তা ছিল খানিক দূরহ। শস্য রোপণ আর তোলার মধ্যে নানা উৎসবে দেবতাকে তুষ্ট করার সংস্কৃতি এতে বিদ্যমান। এই সংস্কৃতি কালে কালে সংস্কার হয়ে মানুষ আজও দিনক্ষণে বর্তমান। তো বাংলায় বর্ষ কেমন?



দুনিয়ার অন্য দেশের মতো এতদ অঞ্চলে চন্দ্র আর সৌর বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে বর্ষপঞ্জির শুরু। তবে সৌর মতবাদই বর্ষগণনার নিয়ামক আকারে আছে। চন্দ্র তিথির ‘অমাবশ্যা’ আর ‘পূর্ণিমা’ যার ভিত্তি। প্রাচীন জোতির্বিদ আর্যভট্টের ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ মতে, বিশাখা নক্ষত্রের নামে ‘বৈশাখ’, জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নামে ‘জ্যৈষ্ঠ’, আষাঢ়া নক্ষত্রের নামে ‘আষাঢ়’, শ্রবণা নক্ষত্রের নামে ‘শ্রাবণ’, ভাদ্রপাদ নক্ষত্রের নামে ‘ভাদ্র’, অশ্বিনা নক্ষত্রের নামে ‘আশ্বিন’, কৃত্তিকা নক্ষত্রের নামে ‘কার্তিক’, মৃগশিরা নক্ষত্রের নামে ‘অগ্রহায়ণ’, পূষ্যা নক্ষত্রের নামে ‘পৌষ’, মঘা নক্ষত্রের নামে ‘মাঘ’, ফাল্গুনী নক্ষত্রের নামে ‘ফাল্গুন’ আর চিত্রা নক্ষত্রের নামে ‘চৈত্র’। এখানে মজার ব্যাপার হলো, সকল নক্ষত্র নামের উচ্চারণের সহজ সংস্কার হয়ে ‘মাস’ ওরফে ‘মাহ’ ঠিক হয়। শুদ্ধ ব্যতিক্রম ‘অগ্রহায়ণ’ বা ‘মৃগশিরা’। বাংলার অগ্রহায়ণে ফসল তোলার সময়। ফসল বলতে ‘খাদ্য’ আর ‘বীজ’ অর্থই বিরাজিত। বীজের সাথে ‘মৃগশিরা’ ভাব বর্তমান আর ভবিষ্যত দুই কালই চিহ্নায়ক। খাদ্য মানে ‘বর্তমান’ আর বীজ মানে ‘ভবিষ্যত’। বাংলা পঞ্জিকায় ‘অগ্র’ বা ‘আগে’ বা ‘শ্রেষ্ঠ’ অর্থে স্থান দখল করেছে। তবে প্রকৃতির পালাবদল মানে ঋতুর পালাবদল। ফলে নক্ষত্রের অবস্থান আর চন্দ্রের তিথি এই পালাবদলের ধারক। তবে এই অঞ্চলে কবে থেকে বর্ষ গণনা শুরু তা নিয়ে মতভেদ আছে। ‘বিক্রমাব্দ’, ‘শকাব্দ’, ‘বঙ্গাব্দ’ ইতি আদি ভাব সম্প্রদায় বর্ষপঞ্জির কেন্দ্র। কালের একক ‘বছর’ নির্ধারিত হতো দিন ক্ষণ তিথি মাস হতে।

বাংলা ছয় ঋতুর দেশ। মানে প্রকৃতির পালাবদল ছয় রকমের। ছয় ঋতুকে সৌর মতবাদে বারো ভাগে ভাগ করা হয়। এক ভাগ এক মাস। চন্দ্রতিথির অমাবশ্যা আর পূর্ণিমা হিসেবের বাইরে অপর এক বস্তুগত দিকের কথা ভাবা যায়। যেদিক ‘ঋতুস্রাব’। নারীর ঋতুস্রাবের বিষয়ও এতে বিদ্যমান থাকতে পারে বলে ধারণা হয়। নৃতাত্ত্বিকভাবে দেখলে, এতদ অঞ্চল মাতৃশাসিত সমাজ। ফলে রজঃস্বলার সাথে মাস-তিথি জড়িত। ‘মাসিক’ শব্দ কি সেই অর্থ বহন করে না? সে ভিন্ন এক তর্ক! ভাষাশাস্ত্র বলে, ফার্সি ভাষার সন্তান সংস্কৃত। ‘মাস’ নামক সংস্কৃত শব্দের উদয় ‘মাহ’ ফার্সি ভাব হতে। ফার্সিতে ‘মাহ’  ভাবের অর্থ ‘চন্দ্র’ ও ‘মাস’। তবে সংস্কৃতে ‘মাহ’ মানে ‘মাস’, চন্দ্র নয়। প্রশ্ন হলো, বাংলা চলতি নববর্ষের অবিষ্কারক কে? এই নিয়ে তর্ক আছে নানা ধরনের। ভারতীয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ কারো কারো মত, রাজা শশাঙ্ক বঙ্গাব্দ চালুর জনক! ইতিহাসের দিনক্ষণ আর শাসন কাঠামোর হদিস মেলালে সেটা অসার হয়ে যায়। ফলে এহেন তর্ক বৃথা। তবে কে কখন করেছিল তা এখনো অজানা পর্যায়ে আছে।
তবে চালু মত, সম্রাট আকবরের ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ সনের সাথে বঙ্গাব্দের যোগ রয়েছে। সংস্কার অর্থে যোগ আছে। আকবর পারস্যের রাজা সুলতান জালাল উদ্দীনের মতানুসারি ছিলেন। সুলতানের ‘তারিখ-ই-জালালি’ মতের মতো আকবর ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ চালু করেন। সেটাও কালের ক্ষমতাকাঠামোর পালাবদলে সংস্কার হতে থাকে। শাসকশ্রেণির দখলদারিত্ব প্রভাব এতে বিরাজিত। বাংলায় নানাসময়ে কখনো বঙ্গাব্দ, কখনো হিজরি সন, কখনো রোমান বর্ষ চালু হয়েছে। ঈদ উৎসব, পূজাপার্বণ, বড়দিন, প্রবারণা পূর্ণিমাসহ নানা ধর্মকর্ম বর্ষ গণনার মধ্যে নিহিত আছে। তবে কৃষিনির্ভর অঞ্চলে প্রজাসাধারণ থেকে ‘খাজনা’ বা ‘টোল’ বা ‘কর’ আদায়ের সাথে কথিত ‘নববর্ষ’ সম্পৃক্ত। মানে হিসাবের ‘হালখাতা’র উদ্বোধন। পুরনো খাতার কর্তন করে নতুন খাতার হিসাব চালু। বলা দরকার, বকেয়া খাতার জের বাদ দিয়ে নববর্ষ উদযাপন করা হয়। মানে খাতাকে হালনাগাদ বা বর্তমান করা হয়। সমাজ তার উৎপাদন কাঠামোর ভেতর নববর্ষ আবাহন করে।  

নির্মম হলেও সত্য, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে বাংলা সনের কার্যকারিতা নাই। বাংলাবর্ষ এতে অপাংক্তেয়। রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোয় ‘ইউরোপিয় বর্ষ’ বা ‘রোমান বর্ষ’ চালু আছে। রাষ্ট্রীয় ‘অর্থ বছর’, কোনোভাবেই ‘বাংলা বছর’ নয়। ‘বাংলা বছর’  টিকে আছে গাঁয়ের সংস্কৃতিতে। লোকাচারের উৎসবের ভেতর। ঠিক ‘ধর্ম’ অর্থে উৎসব। শস্যের সাথে গাঁয়ের মানুষের যে-রূপ বাঁচা-মরার সম্পর্ক, ধর্মও তার তদ্রুপ। ধর্মের ভাব বস্তুগত জীবনের অধরার সাথে বসবাস করে। ফলে অবসরে বস্তুগত জীবনকে ভাব দিয়েই প্রসারিত করতে চায়। যাকে আমরা বলছি ফসলের ভাষা। বাঙালির ফসলের ভাষা বাংলা। ফসলের সংস্কৃতিতে ছয়ঋতুর গর্ভে বাংলাবর্ষ বেঁচে আছে। প্রকৃতির এই সম্বন্ধকে আমরা বলছি সংস্কৃতি। আর রাষ্ট্র হচ্ছে উপনিবেশের মৃগশিরা! কিন্তু উপনিবেশিক ক্ষমতা-কাঠামোর যুগে একটা প্রশ্ন জারি রাখতে চাই। নাগরিক জীবনে নববর্ষ কী জিনিস?
ফরাসি দার্শনিক জাঁ বদ্রিলা উৎসবের গোড়া ধরে টান দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, উৎসবের পাটাতন চার রকমের। উৎসব ঐতিহাসিকভাবে ধর্মের প্রচারণা, উপনিবেশের শুরু, উপনিবেশের পতন আর নয়াপুঁজিবাদের জমানায় ঢোকে। নয়া পুঁজিবাদ মানে পণ্য সংস্কৃতির যুগ। নতুন পণ্যের পশরা ছাড়া নাগরিক জীবনে নববর্ষ একদম বিকল। উৎপাদন কাঠামো হতে নাগরিক নববর্ষ খানিকটা বিচ্ছিন্ন। ফলে পণ্য সংস্কৃতির এই নাগরিক উৎসবকে আমরা বললাম ‘বিচ্ছিন্নতার উৎসব’। কেননা বিচ্ছিন্নতার সমষ্টি প্রথাগত কাঠামোরই মিলন। সংস্কৃতির রূপান্তরের চেয়ে পণ্যের রূপান্তরই এখানে মূখ্য সংস্কৃতি। পুঁজিবাদি সমাজ কাঠামোয় শ্রমিক নিজের উৎপাদিত পণ্য নিজেই ভোগ করতে পারে না। ফলে সে পণ্য হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অভোগের একাকিত্বই নাগরিক উৎসবের গোড়া। তাহলে মুখ ফেরাবো কোথায়?

উৎসব কখনো উৎপাদন বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। গাঁয়ে নববর্ষের উৎসব শস্য উৎপাদনের কাঠামোকে ঘিরেই হয়। ঋতুর পালা বদলের সাথে সাথে নব নব উৎসব সংস্কৃতির অঙ্গ। কারণ নগরে সেটা দুরূহ। গাঁয়ের সংস্কৃতির সাথে নাগরিক দূরত্ব কম নয়। তবে নাগরিক নববর্ষ, বস্তুগত জীবন হতে একাকিত্ব উদ্যাপনের উৎসব। ‘একাকিত্ব’ শব্দখানা নিলাম শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তা হতে। তিনি ভাবখানাকে বলেছেন, ‘ভাব সম্পদ’। ঠাকুর আরও বলছেন, ‘প্রকৃতির মধ্যে নববর্ষের দিন বলে কোন একটা বিশেষ দিন নেই।’ কথাটা সত্যি। তো এমন দিনে তিনি ব্রহ্মা সাধনা করতেন। গাজীপুরেও করেছেন। তিনি ধার্মিক মানুষ। ধার্মিক বললাম কারণ তিনি ধর্মবিদ্যা হতে নিজেকে বিযুক্ত করেন নি কখনো। হয়তো করতে চান নি তিনি। কারণ ধর্মকে কেন্দ্রে রেখে তিনি দর্শন চিন্তার ডালপালা বিস্তার করেছেন। তার চিন্তার কাঠামো ধর্মীয়-সমাজ সংস্কৃতির সংস্কার। শুধু ঋতু নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মের দিকে মুখ ফেরালে ছয়ঋতু পার করা সম্ভব। বাড়তি কিছুই না। তবে আমরা রবি ঠাকুরের মতো শেষ দিয়ে গণনা শুরু করলাম। শেষ না হলে শুরু হয় না। আমাদের নবীন ‘রাষ্ট্র’ শুরুতেই আছে। মানে ঔপনিবেশিক ছাঁচে ঢালা। ফলে আমাদের ভয় এইখানে, শিকড় কেটে গাছকে রক্ষা করা যায় না। এই যা, নব আশা দাগিয়ে রাখলাম।

তত্ত্বপারা

১.    নববর্ষ ও সমাজমানস: নির্মল সেন; নববর্ষ (সংকলন), বাংলা একাডেমি, ঢাকা
২.   বিশ্ব পটভূমিতে বাংলা মাস-তালিকা: সত্যেন সেন; নববর্ষ (সংকলন), বাংলা একাডেমি, ঢাকা

৩.  নববর্ষ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; নববর্ষ (সংকলন), বাংলা একাডেমি, ঢাকা
4.   http://www.rabindra-rachanabali.nltr.org/node/8998
5.   Carnival and Cannibal: Jean Baudrillard; Seagull, India

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও তাত্ত্বিক





রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়