ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পিতাদের নিঃসঙ্গতা এবং আর্থিক সংকট

রিয়াজুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪৫, ২১ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পিতাদের নিঃসঙ্গতা এবং আর্থিক সংকট

রিয়াজুল হক: বিষয়টা নিয়ে হয়ত অনেকের ভাবার সময়ই হয় না। পিতা খুব সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে দায়িত্বশীল এবং নিঃসঙ্গ মানুষের নাম। যার কাজই হচ্ছে পরিবারের সকলের সব ধরণের চাহিদা পূরণ করার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিশ্রম করে রাতে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়া।

যাদের জন্য সারাটা দিন পরিশ্রম করা হয়, তাদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলারও সুযোগ থাকে না। সুযোগ না থাকার অভাবে একটা সময় সন্তানরাও বাবাকে খুব রিজার্ভ মনে করা শুরু করে। কিছুটা দূরত্ব তৈরী হয়। প্রয়োজন হলেই কেবল সন্তানরা কাছে আসে। আর বাবা যদি ডাক দেন তাহলে তারা কাছে আসে, ঠিক যেন এমসিকিউ পরীক্ষায় উত্তর দেওয়ার মতো।

এখানে সস্তানদের দোষ দেওয়া হচ্ছে না। আসলে পরিস্থিতি এমনটা তৈরী করে দিয়েছে। মায়েরা সন্তান, সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর বাবা ব্যস্ত থাকে পরিবারের জন্য আয় রোজগার করার জন্য। তবে আজকের এই লেখাটা মূলত মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য প্রযোজ্য। অঢেল অর্থবিত্তের মালিক বাবাদের জন্য এই লেখা প্রযোজ্য নয়।

মশিউর রহমান (ছদ্মনাম) জেলা শহরের একটি এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষক ছিলেন। স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। সন্তানদের ভালো করে লেখাপড়া করানো, বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়ানো, সংসারের যাবতীয় খরচ মেটানোর পর তেমন কোন সঞ্চয় থাকত না। দুই ছেলে মাস্টার্স পাস করেছে। দুই ছেলেই চাকরি করছে এবং তারা বিবাহিত। তবে ছোট ছেলের চাকরি এমনি এমনি হয়নি। মশিউর রহমান অবসরোত্তর সুবিধা হিসেবে ১০ লাখ টাকা পেয়েছিলেন, সেই টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনা ছিল। তিন মাস পর পর কিছু মুনাফা পেতেন। কিন্তু ছোট ছেলের চাকরির জন্য সঞ্চয়পত্রের সেই টাকা তুলেছেন। ছেলের চাকরির জন্য উৎকোচ দিতে হয়েছে ১০ লক্ষ টাকা। এখন তার নিজের কাছে কোন টাকা নেই। বড় ছেলে চাকরির সুবাদে অন্য জেলা শহরে থাকে। মশিউর রহমান স্যার ও তার স্ত্রী তাদের ছোট ছেলের সঙ্গেই আছেন। তবে শোনা যাচ্ছে ছোট ছেলের বদলি হওয়ার কথা। এরপর কি হবে মশিউর রহমান স্যারও নিজেও জানেন না। নিজের হাতে কোন টাকা পয়সা নেই। চাকরিতে থাকার সময় ব্যস্ততার কারণে পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। আর এখন এই অবসরে পরিবারের সদস্যরা ব্যস্ত হয়ে দূরে চলে যাচ্ছে। বাবাদের জীবনটা সবসময় যেন নিঃসঙ্গতার চাদরে মোড়া থাকে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত একটা লেখা পড়ে চোখ আটকে গেল। সেটাই তুলে ধরছি- ‘বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ প্রাণীর নাম হচ্ছে- বাবা! বিয়ের আট-দশ-পনের বছর পরে বউয়ের সঙ্গে আর আগের সেই ভালোবাসাটা থাকে না। ভালোবাসাটা অভ্যাসে পরিণত হয়। নিত্যদিন আলু-পেঁয়াজ, বাচ্চার স্কুল-কলেজ ইত্যাদি আলাপে ঘুম নেমে আসে চোখে। একান্ত নিজের কথা, নিজের ভাবনা, ভালোলাগা কিছু বলার অবকাশ হয় না। বিয়ের শুরুতে অথবা প্রেমিক জীবনে, হয়ত বাচ্চার নাম ঠিক করেছিলেন- দুইজন মিলে। রোমান্টিসিজম ছিল। সন্তান জন্মের পরে একরাশ দায়িত্ব কাঁধে চাপে। সন্তানের স্কুল- ভালো রেজাল্ট- বিয়ে- বাড়ি- গাড়ি। এইসব আলাপেই দুইজন ব্যস্ত থাকেন। এক সময় হয়ত দুপুরে অফিসের ব্যস্ততার ফাঁকে ফোন দিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে নানা অর্থহীন গল্প গুজবে ভালোবাসা খুজে পেতেন। এখন দুপুরে ফোন দিলে হয়ত স্ত্রী বলে উঠেন, 'ডিপোজিটের টাকাটা জমা দিয়েছো/কারেন্ট বিল, গ্যাস বিল দিয়েছো?' বাসায় ফিরে দেখেন, স্ত্রী ব্যস্ত বাচ্চাদের হোমওয়ার্ক নিয়ে। যদি স্ত্রীকে বলেন, 'আসো একটু নিরিবিলি কথা বলি, আমাদের কথা বলি।' উত্তরে স্ত্রী হয়ত বলে উঠেন, 'ঢং করার জায়গা পাও না? আমার রান্না আছে! একটু পরে বলবা ভাত দাও।' কিংবা হয়ত বলে উঠবেন, 'বাচ্চারা বড় হয়েছে, সে খেয়াল আছে?’ কোন কোন সময় হয়ত আমাদের মায়েরা ফ্রি থাকেন। দুই কাপ চা নিয়ে দু'জন বসে পড়েন পুরানো স্মৃতি রোমন্থনে। হঠাৎ করেই হয়ত প্রতিবেশির মেয়ের বিয়ের দাওয়াতের কথা মনে পড়ে। কমদামে, সন্মানজনক গিফট কেনার চিন্তা গ্রাস করে বসে দুজনকে। বাবারা যে কতটা নিঃসঙ্গ - তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ মেলে যখন আমাদের মায়েদের সঙ্গে তাদের অভিমান পর্যায় চলে।

আমাদের বেশির ভাগ সন্তানই মা ঘেষা। বাবার সঙ্গে কেমন যেন একটা দুরত্ব থাকে। সন্তানেরা ভাবে, 'বাবা প্রাণীটা কেমন। সেই সকালে বেরিয়ে যায়, রাতে ফেরে। দেখা হলে কেবল রেজাল্ট জিজ্ঞাসা করে। এমন কেন এই লোকটা?' মায়েরা সন্তানকে নিয়ে সংসার নামক পার্লামেন্টে ঐক্যজোট করে। বাবা দেখে তার সন্তানেরাও তার পক্ষে নাই। যাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য তিনি বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। যাদের সঙ্গে বিছানা শেয়ার করেছেন, এক পাতে খেয়েছেন- সেই ভাই বোনেরাও সংসারের চাপে, জমি-বাড়ি-সম্পদ ইত্যাদি বৈষয়িক ঝামেলায় দূরের মানুষ হয়ে যায়। বিভিন্ন কারণে এক সময়ের কাছের বন্ধুদের সঙ্গেও সে রকম যোগাযোগ থাকে না। কিংবা থাকলেও নানা রকম সামাজিক অনুষ্ঠান, বৈষয়িক কথাবার্তা, ছেলেমেয়ের রেজাল্টের খবর আদানপ্রদানে আটকে থাকে সেই সকল যোগাযোগ।

সহকর্মীদের সঙ্গেও একটা কৃত্রিম গাম্ভীর্য বজায় রেখে চলতে হয়। যাকে বলে প্রফেশনালিজম। কারো সঙ্গে একত্রে বসে, নিজের মনের একান্ত কিছু কথা বলার কেউ থাকে না। কেউ না। মায়েরা হয়ত কথায় কথায় বলতে পারেন, আমি বাপের বাড়ি/বোনের বাড়ি চলে গেলাম। কিন্তু বাবাদের চলে যাবার মত কোন জায়গা থাকে না। একরাত কারো বাসায় গিয়ে থাকার মত কোন জায়গাও অবশিষ্ট নাই তাদের।’

আজিজুল ইসলাম (ছদ্মনাম) সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। অত্যন্ত সম্মানের সাথে চাকরি জীবন শেষ করেছেন। অবসর জীবনের বয়স প্রায় ১৩ বছর। স্ত্রী মারা গেছেন আজিজুল ইসলামের বয়স যখন ৩৮ বছর। দুইটি সন্তানকে ঠিকমত মানুষ করার জন্য আর বিয়ে করেননি। সন্তান দুটি অনেক বড় হয়েছে। একজন অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং অন্যজন সৌদি আরবের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক। অনেক নামকরা দুজনই এবং ভীষণ ব্যস্ত তারা। বাহাত্তর বছর বয়স্ক বাবার খোঁজ খবর নেওয়ার সময় নেই তাদের। দুই মাস পরপর বাবার ব্যাংক হিসেবে তারা টাকা পাঠায়। আজিজুল স্যার ব্যাংক থেকে টাকা তোলেন না। সন্তানদের জন্যই রেখে দিয়েছেন, যদি ভবিষ্যতে তাদের কোন কাজে আসে। বয়সের ভারে নিজের পেনশনের টাকা তোলা, বাজার করা, দরকারি জিনিসপত্র কেনা, কাপড় ধোয়াসহ বাড়ির সবকিছু দেখভাল করা তার পক্ষে আর সম্ভব হয় না। হৃদরোগ, ডায়াবেটিকসসহ বিভিন্ন রোগ তো আছেই। প্রতিবেশীরা প্রায়ই বলে, সন্তানদের কাছে চলে গেলেই তো পারেন। আজিজুল স্যার প্রতিবেশীদেরও বলতে পারেন না সন্তানদের অনীহার কথা। অনেকবার চেষ্টা করেছেন সন্তানদের কাছে যাওয়ার। নাতি নাতনীদের সঙ্গে সময় কাটাবার। কিন্তু সন্তানরা চায় না। বৃদ্ধ বয়সে একাকীত্ব যে কত বড় যন্ত্রণার, সে কথা কাউকে বলা যায়না। নিজের একাকীত্ব দূর করার জন্য আজিজুল স্যার চলে এসছেন বৃদ্ধাশ্রমে। দুঃখ করেই স্যার একদিন বলেছিলেন, সন্তানদের বেশি বড় মানুষ করতে নেই। আপন থাকে না, পর হয়ে যায়।

আধুনিকতার নামে আমরা সত্যিই বর্বর হয়ে যাচ্ছি। বড় বাড়িতে বাবার থাকার জন্য সামান্য একটু জায়গা আমরা দিতে পারছি না, লক্ষ টাকা আয় করেও বাবা বিনা চিকিৎসায় যদি দিনের পর দিন পার করে, তবে সন্তান থাকার চেয়ে না থাকাই যে ভালো। বাবা কি সারাটা জীবন কষ্ট করার জন্যই পৃথিবীতে আসে? চাকরি জীবনে সন্তানের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে নিজের স্বাদ কখনও পূরণ করতে পারেনা, বৃদ্ধ বয়সেও যদি সন্তানের অবহেলা সহ্য করতে হয়, তবে সন্তান দিয়ে কি হবে? আমরা যারা সন্তান, একবারও ভাবছি না, আমাদের শরীরের এই শক্তি একদিন থাকবে না। আস্তে আস্তে সব নিঃশেষ হয়ে যাবে। প্রত্যেক সন্তানের উচিত, তাদের বাবা-মায়ের সেবা যত্ন করা।

প্রত্যেকটি সন্তানকে অনুরোধ করব, বাবাদের একটু সময় দিন। তারা হয়ত নিজেদের একটু রিজার্ভ করে রাখেন। আমরা সন্তানরাই না হয় বাবাদের কাছে যাবো। হয়ত বাবারা একটু কম কথা বলবে কিন্তু বিশ্বাস করুন তাদের মনটা ভরে উঠবে। আমাদের জন্যই তো তাদের দিন রাতের পরিশ্রম। আমাদের জন্যই শেষ জীবনে বাবাদের কোন সঞ্চয় থাকে না। অনেক বাবাদের বলতে শুনেছি, জীবনের অর্জিত সকল অর্থ, মূল্যবান সময়গুলো পরিবারের মানুষগুলোর সুখ শান্তির জন্য ব্যয় করেছি। অথচ জীবন সায়াহ্নে এসে দেখি সকল কষ্টই বিফলে গেছে।

এই কষ্টে অসহায় বাবা মনে মনে নিজের বার্ধক্যকে ধিক্কার দেন।

সন্তান হিসেবে এটা আমাদের ব্যর্থতা।

লেখক: উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ এপ্রিল ২০১৯/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়