ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘ওর গান শুনছি আর কাঁদছি’

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০৭, ৭ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘ওর গান শুনছি আর কাঁদছি’

রাহাত সাইফুল: ‘সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে গেছে একুশে পদকপ্রাপ্ত সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দী। খবরটা শোনার পর থেকেই মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। ওর গান শুনছি আর কাঁদছি।’— আজ রাইজিংবিডির সঙ্গে আলাপকালে এভাবেই কথাগুলো বলেন বরেণ্য গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান।

‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’, ‘পাহাড়ের কান্না দেখে’, ‘বধুয়া মান ভাঙাতে জীবন’ শিরোনামের জনপ্রিয় তিনটি গানের শিল্পী সুবীর নন্দী। ক্যারিয়ারের শুরুতে এমন তিনটি গানে কণ্ঠ দিয়ে শ্রোতাদের তাক লাগিয়ে দেন তিনি। এরপর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি সুবীর নন্দীকে। আর এই তিনটি গানের গীতিকার রফিকউজ্জামান।

সুবীর নন্দীর সঙ্গে পরিচয় প্রসঙ্গে বরেণ্য গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে সিলেট রেডিওতে চাকরি করতাম, তখন সুবীর নন্দীর সঙ্গে আমার পরিচয়। সেই থেকে ওর সঙ্গে ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। এর পর স্বাধীনতা যুদ্ধ হলো। আমি ঢাকায় চলে আসি। ’৭৬ সালে আমরা সিদ্ধান্ত নিই বিভিন্ন বেতার কেন্দ্রে বাছাই করা কিছু শিল্পী নেওয়ার। সেই শিল্পীদের মধ্যে সুবীর নন্দী, শাম্মী আখতার, ফরিদা পারভীন, আবু জাফরসহ আরো অনেকেই ছিলেন। এর মধ্যে কেউ কেউ টিকেছে আবার কেউ কেউ হারিয়ে গেছে। এভাবেই সুবীর নন্দীর সঙ্গে আমার পরিচয়।’

তার লেখা গানে প্রথম কণ্ঠ দেওয়ার স্মৃতিচারণ করে মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান বলেন, ‘সত্য সাহা একদিন বাসায় এসে আমার স্ত্রীকে বললেন— ভাবি আজ দুপুরে আপনাদের বাসায় আমরা খাব। সেদিন সুবীর নন্দীকে আমার বাসায় নিয়ে আসেন। আমাকে বললেন, দুটি গান লিখতে হবে। সাবিনা ইয়াসমিনের জন্য একটা আর নতুন এই ছেলেটার জন্য একটা। তখন সুবীর নন্দীর জন্য প্রথমে লিখলাম, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’ এমন কথার গানটি। এর সুর করেন সত্য সাহা। আমরা এই গানটি রিলিজ না করে পরিকল্পনা করি, একজন শিল্পীর তিনটি গান একসঙ্গে রিলিজ দিব। এর মধ্যে থেকে অন্তত একটি গান হিট হবে। এরপর ‘পাহাড়ের কান্না দেখে’, ‘বধুয়া মান ভাঙাতে জীবন’ শিরোনামের গান দুটি লিখি। এ দুটি গানের সুর করেন খন্দকার নূরুল আলম। এই তিনটি গান একসঙ্গে রিলিজ দেয়ার পর তিনটি গানই হিট হয়ে গেল। এরপর সুবীর নন্দীকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’

তিনি আরো বলেন, ‘তখন টেলিভিশন বলতে শুধু বাংলাদেশ টেলিভিশন ছিল আর রেডিও ছিল। এতে অসংখ্য গান করেছি। আর চেষ্টা করেছি প্রত্যেকটি চলচ্চিত্রে সুবীর নন্দীর গাওয়ার মতো একটি গান রাখার। সত্যদার সিনেমায়ও আমি সুবীর নন্দীকে দিয়ে গান করিয়েছি। খন্দকার নূরুল আলমের সিনেমা তো ছিল-ই। বিশেষ করে সাহিত্য নির্ভর সিনেমায় সুবীর নন্দীকে রাখা হতো।’

সুবীর নন্দীকে নিয়ে চলচ্চিত্রে গান করা প্রসঙ্গে মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান বলেন, ‘‘দেবদাস’ সিনেমায় সুবীর নন্দী আর রুনা লায়লাকে দিয়ে গান গাওয়ানো হয়। আমার এখনো মনে আছে, রুনা লায়লা প্রথমবার সুবীর নন্দীর সঙ্গে গান করছিল। ‘বলো কে বা শুনেছে এমনো পিরিতি গাঁথা’ শিরোনামের গানটি গেয়েছিল ওরা। গান করে এসে রুনা লায়লা বলেছিল, ‘ছেলেটা এত সুরে গায়! এক বিন্দু সুর নড়ে না।’ একই সিনেমার শেষ গানে পাবর্তীর সঙ্গে দেবদাস দেখা করতে আসে তখন বিনাযন্ত্রে শুধু গরুর গাড়ির চাকার শব্দ, গরুর গলার ঘণ্টা আর ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। এই আবহের মধ্যে ‘মনরে ও মন সুখপাখি তোর হইল না আপন’ শিরোনামে গান করেছিলাম। কি যে গেয়েছে সুবীর নন্দী। এটা যে তার প্রথম দিকের গান কল্পনাই করা যায় না। তার সমস্ত দরদ দিয়ে গানটি করেছে। আমার লেখা দেড় শর মতো গানে কণ্ঠ দিয়েছে সুবীর নন্দী।’

সুবীর নন্দীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে দিয়ে বরেণ্য এ গীতিকবি বলেন, ‘সুবীরের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি রয়েছে। খন্দকার নূরুল আলম, সত্য সাহা এই দুজন মিউজিক ডিরেক্টর, রফিকুল আলম, আবিদা সুলতানা, সুবীর নন্দী, অনুপ ভট্টাচার্য, শাকিলা জাফর, শাম্মী আখতার, অজিত রায় মিলে আমরা একটা পরিবার ছিলাম। এমনো দিন গেছে ঈদের দিন হঠাৎ করে আমার বাসায় চলে আসছে সবাই। কারণ সবাই একসঙ্গে ঈদ করবে। কিংবা খন্দকার নূরুল আলম ভাইয়ের বাসায় চলে গেছে। একবার হঠাৎ করেই সত্যদাকে বললাম— কই মাছ খাব। তারপর সবাই মিলে সত্যদার বাসায় চলে যাই। সেখানে গিয়ে আমরা খাওয়া দাওয়া করি, আড্ডা দিই। সর্বশেষ ‘শরৎচন্দ্র কাঠগড়ায়’ সিনেমায় সবগুলো গান আমি লিখেছি। এর মধ্যে সুবীর নন্দী একটি গান গেয়েছে। এতে তার সঙ্গে সাবিনা ইয়াসমিনও গেয়েছেন। এটাই সুবীরের সঙ্গে আমার শেষ কাজ।’

সুবীর নন্দীর কণ্ঠের প্রশংসা করে মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান বলেন, ‘‘সুবীরের মতো করে এত দরদ দিয়ে আমার মনে হয় না আর কোনো শিল্পী গাইতে পারবে। ‘তুমি এমনই জাল  পেতেছ সংসারে’— এই ধরনের গান ভেতর থেকে না গাইলে হবে না। সুবীর নন্দী ভেতর থেকে গেয়েছে। সুবীরের যে বিষয়টা ছিল, সেটা হলো সুবীর নন্দী কখনো স্টুডিওতে গিয়ে গান তুলতো না। সুরকারের বাসায় বসে গান তুলতো। বাসায় গান তুলে সেই গান নিজের অন্তরে বসাতো। রেকর্ডিংয়ের আগে কয়েকবার রপ্ত করে তারপর কণ্ঠ দিত। বর্তমানে শিল্পীদের সেই সময় নেই! একজন সুবীর নন্দী যে আসবে তা কি করে চিন্তা করব? চিন্তাই তো করতে পারছি না। এখন শিল্প সাধনা নেই, এখন অর্থ সাধনা।’

তিনি আরো বলেন, ‘সুবীর টাকার পেছনে ঘুরত না, টাকাকে কখনো প্রধান মনে করেনি। এখনকার প্রজন্মের শিল্পীরা কত দ্রুত কত টাকা অর্জন করতে পারে সেদিকে নজর থাকে। এখনকার শিল্পীরা শিল্পী হতে চায় না তারকা হতে চায় কিন্তু সুবীর শিল্পী হতে চেয়েছে। তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।’

‘আমার এ দুটি চোখ’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার’, ‘বৃষ্টির কাছ থেকে’, ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’, ‘ও আমার উড়ালপঙ্খিরে’, ‘হাজার মনের কাছে’, ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, ‘পাহাড়ের কান্না’, ‘তুমি এমনই জাল পেতেছ’, ‘কেঁদো না তুমি কেঁদো না’, ‘পাখিরে তুই’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহান দিয়ে লাখো ভক্তদের হৃদয় স্থান করে নিয়েছেন সুবীর নন্দী। একুশে পদক, একাধিকবার চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কারসহ সন্মাননা পেয়েছেন এই শিল্পী।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ মে ২০১৯/রাহাত/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়