ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

দুরন্ত বেইজিং শান্ত জীবন || শান্তা মারিয়া

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২৭, ৪ অক্টোবর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুরন্ত বেইজিং শান্ত জীবন || শান্তা মারিয়া

চকবাজার টু চায়না : পর্ব ১৬

চীনে গ্রীষ্মের সন্ধ্যাগুলো বড় সুন্দর কাটতো। চীন বিশেষ করে বেইজিংয়ে জীবন বেশ শান্তিময়, নিরাপদ।

 

বেইজিংয়ে দেখতাম শীত একটু কমলেই মার্চ বা এপ্রিল মাস থেকে শুরু হতো নাচের আসর। সন্ধ্যায় পাড়া মহল্লায় কোনো পার্ক বা খোলা জায়গায় বিকেল থেকেই লোক জড়ো হতে থাকে। চীনের আবাসিক এলাকাকে বলে কমিউনিটি। ছোট ছোট এলাকায় অনেকগুলো বাড়ি নিয়ে একটি কমিউনিটি গড়ে ওঠে। এসব কমিউনিটিতে সন্ধ্যায় অর্থাৎ ডিনারের পর শুরু হয় নাচের আসর।

 

বাজনা বাজে। আর নাচ, হাসি, আনন্দে মেতে ওঠে মানুষ। এই নাচের আসরে প্রধানত বয়স্ক নারী-পুরুষ বেশি থাকেন। তবে অল্পবয়সিরাও যে থাকে না তা নয়। শিশুরাও থাকে। এখানে কোনো অশালীন বা অশোভন আচরণ দেখিনি। বরং মনে হয়েছে নির্মল বিনোদন ও শরীরচর্চা হচ্ছে। আমার বাসস্থান শিজিংশানে সিআরআইয়ের মিডিয়া সেন্টারে। তার আশপাশেই কয়েকটি কমিউনিটি ছিল। আমি প্রায়ই এসব কমিউনিটির নাচের আসরে যেতাম।

 

জুড়ি মিলিয়ে নাচ বা বলড্যান্স দেখতে যত সহজ মনে হয়, আদতে তা নয় বলাই বাহুল্য। সেজন্য অনেককে দেখতাম আসরের একপাশে কারও কাছে তালিম নিচ্ছে। এইসব আসরে শুধু যে নাচ হয় তাই নয়। পাড়া-প্রতিবেশি একে অন্যের খোঁজ খবর নেন। আলাপ, গল্প, হাসি-ঠাট্টা চলে। সন্ধ্যাটা ভালো কাটে। এইসব আসরে আমি যেতাম গান শুনতে এবং সাধারণ জীবনের স্পর্শ পেতে। । চীনা গান বেশ শ্রুতিমধুর। বিশেষ করে তিব্বতী ও মঙ্গোলীয় গান আমার খুব প্রিয়। কথা না বুঝলেও সুরের আবেদন অসাধারণ।

 

মাঝেমধ্যে কারও অনুরোধে নাচে অংশ নিতাম। হয়তো নানার বয়সি, কনফুসিয়াসের মতো দেখতে কোনো সদাশয় বৃদ্ধ নাচের আমন্ত্রণ জানালেন। তখন মানা করতে ইচ্ছা হতো না। কারণ জানি তিনি হয়তো বাড়িতে গিয়ে নাতি নাতনিদের কাছে বলবেন আজ এক বিদেশিনীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত না হলে মানুষের মুখে হাসি থাকে না বা মানুষ এত প্রাণবন্ত হয় না। এদের প্রাণশক্তি দেখেই বোঝা যায় বেইজিংয়ের অধিবাসীরা কত সুখী।

 

সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত খোলা জায়গায় এমন নাচের আসর চলে।

 

এই সময়টা আরেকটা জিনিষ খুব চলে। সেটা হলো ওপেন এয়ার ক্যাফে। রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় আকাশের নিচে বা একটা ছাতার নিচে টেবিল পেতে চলে এইসব ক্যাফে। মানুষ এখানে বসে ডিনার করে এবং আড্ডা গল্পে মেতে ওঠে।

 

দিনের বেলা অবসরপ্রাপ্ত মানুষজনের আরেকটা বড় বিনোদন হলো ঘুড়ি ওড়ানো। যে কোনো পার্কে এবং খোলা চত্বরে বয়স্ক নারী-পুরুষ ঘুড়ি ওড়ানোর খেলায় মেতে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে শিশু থেকে সব বয়সের মানুষ চলে যায় পার্কে বা কোনো দর্শনীয় স্থানে ছুটির দিনটা কাটাতে। পার্কে বাবা মা অথবা বয়স্কদের সঙ্গে দেখা যায় শিশুদের খেলে বেড়াতে।

 

চীনাদের পারিবারিক জীবনে গ্র্যান্ড প্যারেন্টস বা দাদা-দাদী, নানা-নানীর ব্যাপক ভূমিকা। চীনে এক সন্তান নীতির কারণে অধিকাংশ সাধারণ মানুষেরই একটি মাত্র সন্তান। সেই সন্তানকে রেখে বাবা-মাকে কাজে যেতে হয়। সেই সন্তানের দেখভালের দায়িত্ব তাই পড়ে গ্র্যান্ড প্যারেন্টসের ওপর। দাদা, দাদী নানা-নানীরা খুশি মনেই এই দায়িত্ব পালন করেন। কারণ তাদের অবসর জীবনে সময় কাটানোর প্রধান অবলম্বনই তো নাতি নাতনিরা। চীনে শোনা একটি গান মনে পড়ছে। গানের কথাগুলো অনেকটা এরকম: ‘আমি আর নানী হেঁটে চলি। আমার আর নানীর ছায়া এক  হয়ে যায়।’ অবশ্য যে বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের ছেলে-মেয়েরা দূরে থাকে তারা বেশ নিঃসঙ্গ। তবে তারা সময় কাটান নাচের আসরে, কমিউনিটিতে, পার্কে বেড়িয়ে বা অন্য কোনো সমাজসেবায় যুক্ত থেকে। বয়স্কদের পেনশনের ব্যবস্থা আছে। তাই তারা সেদিক থেকে নিশ্চিন্ত। ষাটোর্ধ্ব মানুষের জন্য ট্রেন, বাস সর্বত্র যাতায়াত ফ্রি। হাসপাতালে তাদের জন্য ফ্রি চিকিৎসা সেবা। তুলনায় তরুণদের জীবনে টেনশন অনেক বেশি। শিশুবয়স থেকেই পড়ালেখার বিশাল চাপ। শিক্ষার্থীরা ভীষণ চাপের মধ্যে থাকে, বিরাট সিলেবাস। উন্নতি করার মাশুল দিতে হয় ক্রমাগত উদ্বেগের মাধ্যমে।

 

 

চীনে থাকার সময় বিকেল বেলা সময় কাটাতে নাচের আসরে যেমন যেতাম তেমনি আরেকটি জায়গা আমার খুব প্রিয় ছিল। সেটি বেইজিংয়ের বাণিজ্যিক কেন্দ্র শিদান। শিদান ব্যস্ততায় কিছুটা আমাদের মতিঝিলের মতো। তবে শিদানের সাবওয়ে স্টেশনের সঙ্গেই এক বিশাল খোলাচত্বর। তার নাম শিদান কালচারাল স্কোয়্যার। এখানে বিকেল থেকে অনেক মানুষ আসে সন্ধ্যা কাটাতে। এখানে তরুণদের বেশি দেখতে পাওয়া যায়। শিশুরাও আসে। রোলার স্কেট বা চাকাওয়ারা জুতো পরে নানারকম খেলা দেখায় কিশোর তরুণরা। তাদের মধ্যে ছেলে-মেয়ে উভয়ই আছে। মাঝেমধ্যে গান আর গানের সঙ্গে পশ্চিমা ধাঁচের ধুম ধাড়াক্কা নাচ চলে। দেখতে বেশ মজা লাগে। একপাশে ফুলের বাগান। সেখানে প্রেমিক-প্রেমিকা জুটি বেঁধে বসে থাকে। তবে তেমন অশোভন কোনো কিছু কখনো কেউ করে না। একটু এগিয়ে গেলেই শপিং সেন্টার আর খাবারের দোকান একের পর এক। শিদান কালচারাল স্কোয়্যারে বসে নানারকম খেলা দেখে আর আইসক্রিম খেয়ে অসংখ্য বিকাল কাটিয়েছি আমি আর শিহাব। পরবাসের দিনগুলোর একঘেঁয়েমি কেটেছে কিছুটা হলেও।

 

বেইজিং গোলাপের শহর। এখানে মে-জুন মাস থেকে শুরু করে অক্টোবর পর্যন্ত রাস্তার ধারে, আইল্যান্ডে পার্কে ফুটে থাকে অসংখ্য গোলাপ। কত রঙের গোলাপ যে হয়। একমাত্র কালো গোলাপ ছাড়া আর প্রায় সবরকম রঙের গোলাপই দেখেছি এখানে। মৃদু সুবাস পাওয়া যায়। তবে এসব হাইব্রিড গোলাপে তেমন সৌরভ নেই বলাই বাহুল্য। আমার শৈশবে পুরান ঢাকার বাড়ির ছোট ছোট লাল-গোলাপী গোলাপের কথা মনে পড়ে। পুরো বাড়িতে তার সুবাস ছড়িয়ে পড়তো। হায় আমার শিশুবেলার মতো সেই সুবাসিত দেশি গোলাপও চিরতরে হারিয়ে গেছে।

 

যাক যে কথা বলছিলাম। চীনের মানুষ আরেকটি জিনিষে খুব পারদর্শী। তার নাম থাইচি। এটা এক ধরনের ধীর লয়ের ব্যায়াম। বেইজিংয়ের রাস্তাঘাট, পার্ক সব জায়গাতেই দেখেছি মানুষ থাইচি করছে। ধীরলয়ের এই অঙ্গসঞ্চালন নাকি শরীরের জন্য খুবই ভালো। চীনাদের দীর্ঘ আয়ুর রহস্য নাকি অনেকটাই লুকিয়ে আছে থাইচির মধ্যে। বেইজিংয়ে আরেকটা জিনিষ বেশ চোখে পড়তো যে কোনো পার্কে গেলেই। সেটা হলো মাছ ধরা। মাছ ধরা ছিপ নিয়ে কয়েকজন বেশ গম্ভীরভাবে ফাতনার দিকে চেয়ে আছে এটা যে কোনো পার্কে লেকের পাশে সাধারণ দৃশ্য। সঙ্গে প্রচুর সরঞ্জাম। মাছ রাখার জন্য সুদৃশ্য বাক্স, খাবারের আয়োজন, মাথার ওপর ছাতা, দামি ফিশিং হুইল, মাছের চার ইত্যাদি। তবে সরঞ্জামের তুলনায় মাছ উঠতে দেখেছি খুব কম। আমার অধিকাংশ সময় এসব সৌখিন মৎস্য শিকারীদের দেখে হাসি পেত। মনে হতো যত গর্জে তত বর্ষে না। এত আড়ম্বর করে দুএকটা ছোট্ট মাছ ছাড়া কাউকে কিছু ধরতে তো দেখলাম না এ পর্যন্ত।

 

শীতে অবশ্য পার্কের দৃশ্য বদলে যায়। তখন বরফজমা লেকের ওপর দিয়ে চলে কুকুরে টানা স্লেজগাড়ি। শি খোয়াই মানে দশ ইউয়ান করে ভাড়া এসব স্লেজের। চড়তে দারুণ মজা। আমি চীনে যাওয়ার পর এক সিনিয়র বাংলাদেশি ভয় দেখিয়েছিলেন। বরফের ওপর পড়ে গেলে নাকি হাতে পায়ে ‘ফ্রস্ট বাইট’ হবে, পচন ধরবে, হাত পা কেটে ফেলে দিতে হবে, ইত্যাদি। পরে এক চীনা সহকর্মীকে সে কথা বলতে তিনি মৃদু হেসে বললেন- “তাহলে তো মস্কোর অর্ধেক লোকের হাত পা কেটে ফেলতে হতো। কারণ মস্কো বেইজিংয়ের তুলনায় শতগুণে বেশি ঠান্ডা এবং বরফে ঢাকা”। এরপর অবশ্য তুষারের বল নিয়ে আমিও খেলেছি। হাত দিয়ে ছুঁড়েছি তুষারের বল। না, হাত পা কিছুই কেটে ফেলতে হয়নি। শীতকালে সর্দি বা ঠান্ডা লেগে জ্বরটরও হয়নি। বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায় অনেকটা সেই দশা।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ অক্টোবর ২০১৬/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়