ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

এখনও একাত্তর আছে সেখানে

সিয়াম সারোয়ার জামিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪০, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এখনও একাত্তর আছে সেখানে

সিয়াম সারোয়ার জামিল : ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। ৪৫ বছর আগের এই দিনে এদেশের মানুষ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পেয়েছিল স্বাধীনতা। সাধারণ মানুষ পাকিস্তানিদের রেখে যাওয়া ধ্বংসস্তুপে শুরু করেছিল নতুন জীবন। গত সাড়ে চার দশকে ক্ষয়ে গেছে সেই অনেক স্মৃতি। নতুন প্রজন্মের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মানুষের আত্মত্যাগের কথা গভীরভাবে জানে না। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনেকটাই যেন রূপকথা। অথচ এর সবই বাস্তব; শিউরে ওঠার মতো ভয়াবহ ইতিহাস যা ঘটেছিল একাত্তরে।

 

একাত্তর চলে গেলেও সরক্ষণ করে রাখা হয়েছে সেসব অগ্নিঝড়া দিনের স্মৃতি। ডিসেম্বরে বিজয়ের এই মাসে সন্তানকে নিয়ে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সেই জায়গাগুলোতে। যেখানে আজও সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে আমাদের বেদনা, গৌরবের একাত্তর। জায়গাগুলো ভ্রমণের পর মুক্তিযুদ্ধের চিত্র কিছুটা হলেও বুঝতে পারবে আপনার সন্তান।  

 

national_monument

 

জাতীয় স্মৃতিসৌধ : ঢাকা থেকে ৩৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সাভারের নবীনগরে নির্মাণ করা হয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ। এর উচ্চতা ১৫০ ফুট। সাতটি সমদ্বিবাহু ত্রিভুজাকৃতির সমন্বয়ে স্মৃতিসৌধ গঠিত হলেও স্তম্ভগুলোর উচ্চতা ও ভূমির ক্ষেত্রফলে রয়েছে ভিন্নতা। সৌধের স্তম্ভগুলো মাঝখান থেকে মোড়ানো এবং ধারাবাহিকভাবে সাজানো। স্থাপত্যটি পুরোপুরি কংক্রিটের তৈরি। স্মৃতিসৌধের দিকে তাকালেই যেন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ১৯৭১ সালে আমাদের বিজয়ের গৌরবগাথা এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও দেশের জন্য অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেওয়া লাখো শহীদের মুখ। স্মৃতিসৌধের পুরো কমপ্লেক্সটি ৩৪ হেক্টরজুড়ে বিস্তৃত। স্তম্ভটির সামনে বেশক’টি গণকবর ও একটি প্রতিফলন সৃষ্টিকারী জলাশয় আছে। এই স্মৃতিস্তম্ভের চারদিক ঘিরে রয়েছে সুন্দর গাছপালা, বাগান। পাখির কলকাকলিতে মুখর এই এলাকা অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত থাকে সবসময়।

 

রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ : মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে এদেশের গুণীজন ও বুদ্ধিজীবীদের হাত-পা-চোখ বেঁধে গভীর রাতে রায়েরবাজার ইটখোলার সামনে এনে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। ১৮ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের ক্ষতবিক্ষত লাশ আবিষ্কৃত হয়। অবশেষে দুই যুগেরও বেশি সময় পর ১৯৯৬ সালে বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের কাজ শুরু হয়। কাজ শেষ হতে সময় লাগে ৩ বছর। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিম পাশে বেড়িবাঁধের ভেতরে এটি নির্মিত হয়। সৌধের স্থপতি ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ ও জামি-আল-শফি। তাদের নকশা অনুযায়ী প্রায় সাড়ে ৩ একর জমির ওপর সাড়ে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে দৃষ্টিনন্দন এই সৌধ গড়ে ওঠে। সৌধটির প্রবেশপথ থেকে শুরু করে পুরোটা লাল ইট ব্যবহার করা হয়েছে। স্মৃতিসৌধের পেছন দিক দিয়ে বয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা নদী। খোলা থাকে সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত।

 

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর : রাজধানীর সেগুনবাগিচায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর অবস্থিত। জাদুঘরটি ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ উদ্বোধন করা হয়। বাঙালির অতীত ঐতিহ্য ও স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাসকে ৬টি গ্যালারির মাধ্যমে এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে। জাদুঘরের প্রবেশমুখেই জ্বলছে ‘শিখা অম্লান’। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন স্মৃতিবিজড়িত অসংখ্য দুর্লভ ছবি দেখতে পাবেন সেখানে। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত অস্ত্র, জামা-কাপড়, বধ্যভূমি থেকে ৭০টি মাথার খুলিসহ ৫ হাজার ৩৯২টি হাড় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে, যা স্মরণ করিয়ে দেবে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা। এই জাদুঘরে কিনতে পাওয়া যাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কিত বই, গানের সিডি এবং ভিডিও চিত্র। শীতকালীন সময়সূচি (অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত জাদুঘর খোলা থাকে। রোববার সাপ্তাহিক বন্ধ। টিকিটের মূল্য ৫ টাকা।

 

Bijoy

 

বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর : প্রতিদিনই জাদুঘরের সংগ্রহশালা বড় হচ্ছে। পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে প্রতিরোধ গড়ে প্রাণ হারান শতাধিক পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা। জাদুঘরে স্থান পেয়েছে একটি পাগলা ঘণ্টা, যেটি বাজিয়ে সেই রাতে পুলিশ সদস্যদের একত্রিত করেছিলেন কনস্টেবল আব্দুল আলি। এছাড়া আরও রয়েছে পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টারশেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা ও ইউনিফর্ম। দেয়ালজুড়ে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্যদের যুদ্ধের সময়ের ডায়েরি, হাতে লেখা বিভিন্ন বার্তা, বিভিন্ন ধরনের আলোকচিত্র এবং পোস্টার।

 

জল্লাদখানা বধ্যভূমি : মিরপুর ১০ নং সেকশনের জুটপট্টিতে জল্লাদখানা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম বড় বধ্যভূমি। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ‘জল্লাদখানা’ নামে পরিচিত ওয়াসার এই পরিত্যক্ত পাম্প হাউসে খনন চালিয়ে ৭০টি মাথার খুলি, ৫ হাজার ৩৯২টি অস্থিখণ্ড এবং শহীদদের ব্যবহৃত নানা সামগ্রী পাওয়া যায়। জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে বর্তমানে দেয়াল ঘেঁষে কাচে ঘেরা পাত্রে রাখা আছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গার বধ্যভূমির পবিত্র মাটি। পূর্বপাশে রয়েছে টেরাকোটা ইট ও লোহার সমন্বয়ে তৈরি শিল্পী রফিকুন নবী ও মুনিরুজ্জামানের যৌথভাবে করা একটি ভাস্কর্য। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। প্রবেশে কোনো টিকিট লাগে না।

 

জাতীয় জাদুঘর : রাজধানীর শাহবাগে অবস্থিত জাদুঘরের তিন তলায় মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারিতে আছে যুদ্ধ-পূর্ব ও যুদ্ধ সময়ের বিভিন্ন স্মারক, তাজউদ্দীনের ভাষণ, গণহত্যার ছবি, সেক্টর কমান্ডারদের ছবি, পোস্টার, মুক্তিযোদ্ধাদের জিনিসপত্র, খেতাবপ্রাপ্তদের তালিকা, বুদ্ধিজীবী ও বীরশ্রেষ্ঠ ডাকটিকিট ইত্যাদি। শনিবার থেকে বুধবার প্রতিদিন সকাল ১০.৩০ মিনিট থেকে বিকাল ৫.৩০ মিনিট (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর) ও ৯.৩০ মিনিট থেকে ৪.৩০ মিনিট (অক্টোবর থেকে মার্চ) এবং শুক্রবার বিকাল ৩.৩০ মিনিট থেকে ৭.৩০ মিনিট পর্যন্ত জাদুঘর দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ছুটি এবং অন্যান্য সরকারি ছুটির দিন জাদুঘর বন্ধ থাকে। প্রবেশ মূল্য ১০ টাকা।

 

Military_Museum

 

জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর : দুই কক্ষবিশিষ্ট এ জাদুঘর এলিফ্যান্ট রোডের জাহানারা ইমাম সরণিতে অবস্থিত। জাহানারা ইমাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তার স্বাক্ষর পাওয়া যাবে এখানে। দেয়ালে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন পোস্টার ‘সদাজাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী, বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালি’ ইত্যাদি প্রদর্শিত হয়েছে  জাদুঘরে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, ফার্নিচার, বই, আলোকচিত্রসহ শহীদ রুমী ও তার বাবার ব্যবহৃত জিনিসপত্র এ জাদুঘরে সংগৃহীত রয়েছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছেন তার বড় ছেলে সাফী ইমাম রুমীকে। রুমী বেঁচে আছেন কি-না, খোঁজখবর নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো জাহানারা ইমামের স্বহস্তে লেখা চিঠির কপি এখানে প্রদর্শিত হয়েছে। প্রতি শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

 

সামরিক জাদুঘর : এটি বিজয় সরণিতে অবস্থিত। এতে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অস্ত্র, রাশিয়ার তৈরি ১৯৭১ সালে যুদ্ধে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর কাছ থেকে উদ্ধার ট্যাঙ্ক পিটি-৭৬, অষ্টাদশ শতাব্দীর কামান, ব্যারেল ১০০ সিসি ট্যাঙ্ক গান, ১৯৬৭ সালে জার্মানিতে তৈরি কামান ১০৫/৫২ সিএম ক্রুপগান যা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘরে দ্বিতীয় তলায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন জায়গার দলিলপত্র রয়েছে। রয়েছে সামরিক বাহিনীর ব্যাজ, অস্ত্র, পোশাক। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৯১ হাজার ৫৪৯ সৈন্য ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পর স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক দলিলের প্রতিলিপিও এখানে দেখা যাবে। জাদুঘরটি সবার জন্য উন্মুক্ত। জাদুঘরে প্রবেশের জন্য টিকিট লাগে না। সামরিক জাদুঘর শীতকালে সকাল ১০টা থেকে ৬টা পর্যন্ত ও গ্রীষ্মকালে সকাল ১০.৩০ থেকে বিকাল ৬.৩০ পর্যন্ত খোলা থাকে।

 

এছাড়াও ধানমন্ডি বত্রিশে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাদুঘর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু সংগ্রহশালা, বিডিআর সদর দফতরে বাংলাদেশ রাইফেলস জাদুঘর, ঢাকার কুর্মিটোলাস্থ বিজয় নিকেতন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ইত্যাদি। এসব জায়গা ছেলে-বুড়ো সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। জাগিয়ে তুলবে দেশ মাতৃকার চেতনা। জানা যাবে একাত্তরের অনেক কথা যা আপনি হয়তো সেখানে না গেলে কখনও জানতেন না।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়