ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পাঁচ ছাগলের শহর

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৪, ২ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাঁচ ছাগলের শহর

সুপ্রাচীন মসজিদ হুইশিয়াং

(চকবাজার টু চায়না : পর্ব-২৭)

শান্তা মারিয়া : পাঁচজন অমর মানুষ এক জনপদে নেমে এলেন পাঁচটি ছাগল (মতান্তরে ভেড়া)। সেই জনপদে তখন চলছিল খাদ্যের অভাব। অমর মানুষরা জনপদবাসীকে দিলেন খাদ্য ও শিক্ষা। তারাই শেখালেন কীভাবে ধান চাষ করতে হয়। এরপর থেকে আর খাদ্যের অভাব হয়নি জনগণের। আর সেই ছাগলগুলো পরিণত হলো পাথরের মূর্তিতে। সেই থেকে এই ছাগল বা ভেড়াগুলোকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়। এমন লোককাহিনির ভিত্তিতে কুয়াংচোও শহরকে বলা হয় ‘পাঁচ ছাগলের শহর’।

 

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যবসা উপলক্ষে চীনের তৃতীয় বৃহত্তম শহর কুয়াংচোওতে ছিলাম প্রায় মাসখানেক। পার্ল নদীর মোহনায় অবস্থিত প্রাচীন এই বন্দর নগরীতে দেখার মতো জায়গার অভাব নেই। কুয়াংচোও বা ক্যান্টন বন্দরই একসময় ছিল চীনে ইউরোপীয় বণিকদের একমাত্র প্রবেশদ্বার। বাংলাদেশের অনেক মানুষ কুয়াংচোওকে গোয়াংজো উচ্চারণ করেন।

 

সেখানে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে বসবাস করছে শত শত বছর ধরে। খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ শতকে গড়ে ওঠা এ জনপদে চীনের প্রায় প্রতিটি রাজবংশের আমলে কোনো না কোনো উল্লেখযোগ্য স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে।

 

কুয়াংচোওতে আমি গিয়েছিলাম ব্যবসায়িক কাজে। তবে, ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকলেও এমন একটি প্রাচীন শহরের কোনো স্থাপনা না দেখে ফিরে আসা অপরাধ। তাই এক বিকেলে গেলাম হুইশাং মসজিদ দেখতে। এটা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন একটি মসজিদ। ৬২৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত এ মসজিদটি হযরত মুহম্মদ (সা.) এর এক আত্মীয় গড়ে তোলেন। ইসলাম-পূর্ব সময় থেকেই এই বন্দর নগরীতে আরব বণিকদের এক সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। তাদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের জন্যই এই মসজিদ গড়ে তোলা হয়েছিল। মসজিদটির মূল ভবন ও মিনার এখনও ব্যবহার করা হয়। প্রাচীন মাটির দেয়ালের নমুনাও সংরক্ষিত আছে। এখানে সেই সময়কার একটি কুয়া থেকে এখনও ওযুর পানি সরবরাহ করা হয়। শরতের বিকেলে সেই প্রাচীন মসজিদে নামাজ পড়তে দারুণ এক অনুভূতি হয়েছিল। এই মসজিদকে ঘিরে এই এলাকায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলিমের বসবাস রয়েছে। চীন সরকারের পক্ষ থেকে মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণ এবং এর বর্ধিতকরণের খরচ দেওয়া হয়।

 

আরেকদিন গেলাম সান ইয়াত সেন মেমোরিয়াল হল দেখতে। নয়া চীনের অন্যতম মহান নেতা ছিলেন ডা. সান ইয়াত সেন। আমি যে হোটেলে ছিলাম সেখান থেকে সাবওয়েতে মাত্র দুটো স্টেশন পরেই এই মেমোরিয়াল হল।

 

সান ইয়াত সেন এবং গণতন্ত্রের জন্য তার সংগ্রাম ও অবদান  সম্পর্কে ছোটবেলায় বাবার কাছে শুনেছিলাম। মেমোরিয়াল হলে গিয়ে এত বছর পর আবার এই মহান ব্যক্তির সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম। মেমোরিয়াল হলটিও অসাধারণ সুন্দর! নীল রঙের এই প্রাসাদটি অষ্টভূজ। এর স্থাপত্য ঊনবিংশ শতকের ঐতিহ্য ও আধুনিকতার চমৎকার সমন্বয়। হল প্রাঙ্গণে গাছের সারি কুয়াংচোওর গরমে শীতলতার স্পর্শ নিয়ে আসে। দশ ইউয়ান দিয়ে টিকেট কেটে ঢুকতে হলেও যা পাওয়া যায় তা অর্থের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।

 

ইয়েশিউ পার্ক

 

কুয়াংচোওতে পার্ক, মন্দির বা অন্যান্য দর্শনীয় জায়গার অভাব নেই সেকথা আগেই বলেছি। তবে এই ট্রিপে ব্যবসায়িক ব্যস্ততার জন্য শিংফা মার্কেট, কারখানা আর সিএনএফ এজেন্টের অফিসে দৌড়ঝাঁপ করতেই ব্যস্ত ছিলাম। তবু একদিন সময় করে গেলাম ইউয়েশিউ পার্কে। এই পার্কেই এক টিলার চূড়ায় রয়েছে সেই বিখ্যাত পাঁচ ছাগলের ভাস্কর্য।

 

আমার হোটেল থেকে মাত্র তিন স্টেশন পরেই এই পার্ক। গিয়ে ভীষণ আফসোস হলো। এত কাছে এত চমৎকার একটি জায়গা ছিল অথচ এলাম এত পরে, যখন এই শহর ছেড়ে চলে যাবার দিন এসে গেছে। পাবলিক পার্ক। তাই কোনো টিকেটের বালাই নেই।

 

বিরাট গেট দিয়ে পার্কে ঢুকে একটু থমকে গেলাম। বিশাল জায়গা নিয়ে এই পার্ক। ৮ লাখ ৬০ হাজার বর্গ মিটার জায়গাজুড়ে রয়েছে পার্কটি। আয়তনের হিসাব শুনলেই বোঝা যায় একদিনে কখনও এটা পুরো ঘুরে দেখা যাবে না। এখানে রয়েছে মিং রাজবংশের আমলে তৈরি পাঁচতলা চেনহাই টাওয়ার। চেনহাই টাওয়ার হলো বুদ্ধিস্ট প্যাগোডা। এখন এখানেই কুয়াংচোও মিউজিয়াম।

 

পার্কে ঢুকে একটু এগোতেই চোখে পড়ে নয়নসুখ লেক। সেই লেকের পানিতে দারুণ সুন্দর রঙিন মাছ। লেকটি নিঃসন্দেহে সুন্দর। কিন্তু এমন সুন্দর লেক মোটামুটিভাবে চীনের অনেক পার্কেই দেখা যায়। তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই। সত্যিকারভাবে অবাক হলাম রঙিন মাছগুলো দেখে। মাছগুলো আকারে যেমন বড় তেমনি বিচিত্র সব রঙে রাঙানো। গোলাপী, হলুদ, সবুজ, নীল, বেগুনি, লাল এমন সব রঙে ঝলমলে তারা। মনে প্রশ্ন জাগছিল এগুলো প্রাকৃতিকভাবেই এমন রঙিন নাকি তাদের কৃত্রিমভাবে রাঙানো হয়েছে?

 

মাছের খেলা মুগ্ধ হয়ে দেখার পর এগোলাম পাহাড় বা টিলার দিকে। পাহাড়টির নাম ইউয়েশিউ শান। এর চূড়াতেই রয়েছে সেই বিখ্যাত পাঁচ ছাগল যাদের কথা লেখার শুরুতে বলা হয়েছে।

 

টিলার ওপর ধীরে ধীরে উঠছিলাম। হঠাৎ কানে ভেসে এলো চমৎকার গানের সুর। এমনিতেই চীনা গান আমার খুব প্রিয়। ভাষা বুঝি না কিন্তু সুরের মধ্যে এমন একটা মায়া আছে যে মন কেড়ে নেয়। বিশেষ করে চীনা লোকজ গানের সুর তুলনাহীন। তেমনি এক সুর ভেসে এলো যেন পাহাড়ের সবুজ গাছপালার ভেতর থেকে। সুর লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলাম। দেখি এক জায়গায় বেশ বড় একটি ছাউনির নিচে জড়ো হয়েছে কয়েকজন নারী-পুরুষ। দেখে মনে হয় সাধারণ নাগরিক। শহুরে নয়, গ্রাম থেকে আসা মানুষের মতো সবুজ-সতেজ চেহারা। তারাই গান গাইছে। আমাদের দেখে তাদের গান গাইবার উৎসাহ আরও বাড়লো। কয়েকজন আমাদের আমন্ত্রণ জানালো তাদের সঙ্গে গান গাইতে। শিহাবের কণ্ঠ ভালো। কিন্তু সে এভাবে চটজলদি বন্ধুত্ব পাতাতে অপারগ। আমার কণ্ঠে সুরের বালাই নেই। তাতে কি। আমি কোরাসে কোনোদিন পিছিয়ে থাকি না। ওদের সঙ্গে যোগ দিয়ে গলা মেলালাম।

 

মহান নেতা সানইয়াতসেনের প্রতিকৃতি

 

বেশ কিছুক্ষণ সংগীত চর্চার পর নতুন বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে তাকালাম প্রকৃতির দিকে। তার রূপও কম আকর্ষণীয় নয়। চারিদিকে সবুজ গাছপালা, লতা আর ফুলের ঝাড়। চূড়া থেকে দেখা যায় লেকের মোহন রূপ।

 

মনে হয় এমনি কোনো সবুজ পাহাড়ের বুকে ছোট্ট পাতার কুটিরে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেই। কিন্তু হায়, সে উপায় নেই। আমাকে যে ফিরতে হবে।

 

ইউয়েশিউ শানকে বিদায় জানিয়ে ফিরে চললাম সাবওয়ে স্টেশনের দিকে।

 

কুয়াংচোওর দিনগুলোর কথা ভাবলে আমার সান ইউয়ান লি এলাকাটির কথা খুব মনে পড়ে। ওখানে চীনা চায়ের একটি মার্কেট রয়েছে। সেখানে হরেক রকম চা এবং চা পরিবেশনের সরঞ্জাম পাওয়া যায়। মনে পড়ে ছোট্ট দুটি রেস্টুরেন্টের কথা যেখানে আমরা প্রায়ই খাবার খেতাম। বিশেষ এক ধরণের টক-ঝাল নুডুলস এর কথা তো ভুলতেই পারি না। উফু হোটেল (যেখানে আমি ছিলাম) এর রিসেপশনে বসা মিষ্টি চেহারার দুই তরুণ ও তরুণীর কথাও মনে পড়ে।

 

কুয়াংচোওর সাথেই রয়েছে ফোশান শহর। ফোশান আসলে স্যাটেলাইট সিটি। এখানে বড় বড় শিল্পকারখানা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে অপূর্ব সুন্দর পাহাড় ও প্রকৃতি। আর চাঁদের আলোয় রাতের বেলা সান ইউয়ানলির রাজপথ ধরে হাঁটার স্মৃতিও খুব মনে পড়ে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ জানুয়ারি ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়