ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মিতিংগাছড়ি ঝরনায় অবগাহন

মেহেদী হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫৮, ১৬ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মিতিংগাছড়ি ঝরনায় অবগাহন

নৌকা চালাচ্ছেন অধ্যাপক আবুল হাসান

মেহেদী হাসান : পাহাড়, ঝরনা আর সমুদ্রের মানুষকে আকর্ষণ করার অস্বাভাবিক একটা শক্তি আছে। রাঙামাটির কর্মব্যস্ত দিনগুলোতে সমুদ্র দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। কিন্তু, ঝরনার সুশীতল জলে গা ভেজানোর আনন্দে সমুদ্র না দেখার কষ্ট অনেকখানি কমে গেছে। ক্ষেত্রসমীক্ষা চলাকালে একদিন আমরা ট্রলারে চেপে চললাম রাঙামাটি শহর থেকে বেশ দূরে। সেদিন রোদের তাপ ছিল প্রচণ্ড। রাঙামাটির নতুন শহীদ মিনার ঘাট থেকে আমরা সকাল ১০টায় ট্রলারে চেপে রওনা দিলাম কাপ্তাই লেক দিয়ে। লেকের মনোরম দৃশ্য দেখে আমরা অভিভূত! পাড় থেকে দেখা, আর বুকে ভাসতে ভাসতে দেখা কাপ্তাই লেকের সৌন্দর্য মনোরম হলেও অনুভূতি এক নয়। সময়ের সঙ্গে আমাদের ট্রলারও ভেসে চলেছে কাপ্তাইয়ের স্বচ্ছ জলে।


বিশাল জলরাশি, জলরাশিতে রোদের ঝিলমিল আলো, মৃদু ঢেউ, শীতল হাওয়া, লেকের চারপাশের ছোট-বড় পাহাড়, পাহাড়ের কোলে সবুজের সমারোহ, মাঝে মাঝে দু’একটা ছোট্ট ঝরনা- সব মিলে এমন সৌন্দর্য নিতান্ত কাঠখোট্টা হৃদয়কেও নরম করে দিতে পারে। অবশ্য তখনও জানি না আমরা কোথায় যাচ্ছি। শুধু এটুকু জানি যে, সুবলং ঝরনা দেখার পর কয়েকটি এলাকায় আমরা একাডেমিক কাজ করব।

এই সময়টা আমরা ছবি তুলে, গল্প করে আর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে সময় পার করছিলাম। দুপুরের আগে আমরা সুবলং ঝরনার দেখা পেলাম। ঝরনা দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের এর আগেও হয়েছে। গত বছর সিলেট বিভাগের ক্ষেত্রসমীক্ষায় আমরা মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ড দেখেছিলাম। কিন্তু ঝরনায় গোসল করা বা ঝরনার পানিতে ভেজার সৌভাগ্য হয়নি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে ক্ষেত্রসমীক্ষায় ছিলাম আমরা। আমাদের সঙ্গে ছিলেন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবুল হাসান স্যার। আমরা তখন সুবলং ঝরনার সামনে। এর নাম অনেক শুনেছি। কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে কল্পনার সঙ্গে মেলাতে পারছিলাম না। যা ভেবেছিলাম মোটেও তা নয়, খুব ছোট একটা ঝরনা। এদিকে, স্যাররা আমাদের ট্রলার থেকে নামতেই দিলেন না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। সুবলং ছোট তো কী হয়েছে, তাই বলে নামতে দেবেন না কেন? রাগ, অভিমান হলো কিন্তু কিছুই করার নেই। তবে আমার মনের কথা হয়তো অধ্যাপক আবুল হাসান স্যার বুঝেছিলেন, সেটা পরে বলছি।

তবে ওই সময় পর্যন্ত জানতাম না, আমাদের জন্য সামনে ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। আমরা সুবলং বাজারের ঘাটে ট্রলার ভেড়ালাম। এখানে কিছু তথ্য সংগ্রহের পর আবুল হাসান স্যার আবার আমাদের নিয়ে ট্রলারে উঠলেন। ৩০ মিনিট পর আমরা মিতিংগাছড়ি নামে একটা আদিবাসী পল্লির দিকে রওনা হলাম। এখানে চাকমাদের বাস। দুই-এক ঘর অন্যান্য আদিবাসীও আছে। এই পল্লিতে একটা প্রাথমিক ও একটা মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা ডিঙি নৌকায় করে স্কুলে আসে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকেরও একটা ডিঙি নৌকা আছে। এসব নৌকা খুব ছোট, ৪-৫ জনের ভার বহনে সক্ষম। এখানকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও বাঙালি শিশুরা খুব কষ্ট করে পড়ালেখা করে। অল্প কিছু ছাত্রের জন্য আছে ছোট্ট একটা ছাত্রাবাস। অন্য শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন পল্লি থেকে ডিঙি নৌকা নিয়ে স্কুলে আসে। আমরা ছোটবেলায় আব্বা-আম্মার কাছে স্কুলে যাওয়ার জন্য সাইকেল চাইতাম, এরা সম্ভবত ডিঙি নৌকা চায়।

মিতিংগাছড়ির কোমলমতী শিশুরা ডিঙি নৌকায় এভাবেই স্কুলে যাতায়াত করে


আমরা মিতিংগাছড়ির প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে আমাদের ট্রলার ভেড়ালাম। ট্রলার থেকে নেমে এলাকার খোঁজখবর নিয়ে দুটি গ্রুপে ভাগ করে দুই দিক দিয়ে কাজ শুরু করলাম আমরা। আমি আবার এই ফাঁকে এক স্থানীয়ের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, পাশেই একটা ঝরনা আছে। খোঁজখবর নিতে আবুল হাসান স্যারের সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম। ঝরনার কথা শোনার পর আমি বারবার স্যারের কাছে ঝরনার বিষয়টি ওঠানোর চেষ্টা করছিলাম। এর ফাঁকে স্যার আমাকে বললেন, ‘মেহেদী তুমি সবুর করো। আমি নিজে নৌকা চালিয়ে তোমাকে নিয়ে যাব ঝরনায়।’

স্যারের কথায় পুলকিত হলাম। চাওয়ার থেকে প্রাপ্তিটা অনেক হয়ে গেল। এবার আমি নিজেই সবাইকে দুই গ্রুপে ভাগ করে দিয়ে একা স্যারের সঙ্গে থেকে গেলাম। আমার খুবই কাছের বন্ধু অমিত তো জিজ্ঞাসা করেই বসল, ‘কী রে! যাবি না কাজ করতে?’

আমি বললাম, ‘তোরা যা, স্যার আমাকে থাকতে বললেন। আমি স্যারের সঙ্গে কাজ করব।’

কোনোমতে ওদের বিদায় দিয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নৌকা চাইলাম। তিনি খুব আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের জন্য নৌকার ব্যবস্থা করলেন এবং যাতে সমস্যা না হয় সেজন্য তিনি স্কুলের পিয়নকে আমাদের সঙ্গে দিলেন। তারপর নৌকায় তিনজন উঠে যাচ্ছিলাম ঝরনার দিকে। নৌকা খুব দুলছিল, আমি অবশ্য ভয়ও পাচ্ছিলাম। এখানকার কিছু লোকজন স্যারের পূর্ব পরিচিত। স্যার এর আগে আরো দুইটা ব্যাচ নিয়ে এসেছিলেন এখানে।

স্যার বৈঠা হাতে নৌকা চালাচ্ছিলেন। আমাকে বললেন, ‘তুমি নড়াচড়া করো না, নৌকা ডুববে না।’ আমি কিঞ্চিৎ সাঁতার জানি, নৌকা ডুবলেও আমি ডুবতাম না। নৌকার জন্য একটু মায়া হচ্ছিল, সেজন্য স্যারের কথাই শুনতে হলো। হাত ও মাথা নাড়াচাড়া করলেও শরীর একটুও নড়েনি। তবে স্যার খুব ভালো নৌকা চালাতে পারেন, স্যারকে ভালো মাঝি বললে একটুও ভুল হবে না।

শান্ত নদীর হালকা স্রোতের বুক চিরে দ্রুত গতিতে নৌকা নিয়ে যাচ্ছিলেন স্যার। দুই মিনিট যেতেই নদীর একটা বাঁক পার হয়েই ঝরনার মন মাতানো, হৃদয় ছোঁয়া কলকল ধ্বনি শুনছিলাম। ঝরনা আমাকে যেন চিৎকার দিয়ে বলছিল, ‘এসো বন্ধু, আমরা উন্মাদনায় মিলি। আমার মধ্যে অবগাহন করো, ধুয়ে সাফ করো সব জঞ্জাল।’

কয়েকটা বাঁক ঘুরেই স্যার একটা বড় কালো পাথরের গায়ে নৌকা ভেড়ালেন। আমি তো অবাক। এতো বড় সারপ্রাইজ আমার জন্য অপেক্ষা করছে বুঝতেই পারিনি। দেখি কালো পাথরটার গা বেয়ে প্রচণ্ড গতিতে স্বচ্ছ পানি নামছে, সেই সঙ্গে কলকল শব্দ। লাফ দিয়ে আমি আর স্যার নৌকা থেকে নামলাম। পুরো জায়গাটা পাথরে বাঁধা। অল্প কিছু জায়গায় বালি আছে। আমাদের স্কুলের দপ্তরি ভদ্রলোকও নামলেন। প্রচণ্ড উৎসাহে আমি এক দৌড়ে ঝরনার ঠিক নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। শুকনো কাপড় পরেই আমি ঝরনার জলে গা ভেজানো শুরু করলাম। পরে মনে হলো, পকেটে মোবাইল-মানিব্যাগসহ অনেক কিছুই আছে। আবেগে তখন মনে ছিল না। কোনো মতে পকেট থেকে বের করে ওগুলো দপ্তরি ভাইয়ের হাতে দিলাম। তারপর ঝরনার নিচে প্রচণ্ড উন্মাদনায় মেতেছিলাম।

আমার দেখাদেখি স্যারও এলেন। প্রথমেই বলেছি, পাহাড় আর ঝরনার অস্বাভাবিক ক্ষমতা আছে মানুষকে আকর্ষণ করার। আমি দেখলাম আমার ২৩ বছরের তারুণ্যের যতটুক উন্মাদনা, স্যারের ৬০ বছরেরও সেরকম উন্মাদনা। এই আনন্দঘন মুহূর্ত ধরে রাখার প্রয়াসে স্কুলের দপ্তরির সাহায্যে কিছু ছবি তোলালাম ও ভিডিও করালাম। সেখান থেকে আসতে একটুও মন চাইছিল না। কিন্তু স্যার একটু তাড়া দিয়ে এক রকম জোর করে নিয়ে আসলেন সেখান থেকে। কিছুক্ষণ ঝরনার শীতল জলে গা ভিজিয়ে আমরা আবার নৌকায় করে স্কুলের ঘাটে ফিরে এলাম। স্যার আমাকে নিষেধ করলেন, আমি যেনো ঝরনার কথা কাউকে না বলি। কিন্তু গোপন করা গেল না। সবাই জেনে গেল। তথ্য সংগ্রহ বাদ দিয়ে সবাই ঝরনা দেখতে যাওয়ার আবদার শুরু করল।

আমি আনন্দ, উত্তেজনা ও আবেগে এতটাই মেতেছিলাম যে, স্যারকে কীভাবে কৃতজ্ঞতা জানাব তার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। নৌকায় উঠে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া থ্রি-কোয়ার্টার পরলাম, কিন্তু অতিরিক্ত টি-শার্ট না নেওয়ায় ভেজা টি-শার্ট গায়ে দিয়ে একা একা তথ্য সংগ্রহের কাজে লেগে গেলাম। যাওয়ার পথে প্রথম যে গ্রুপের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাদের বলে দিলাম, ভেজা গায়ে কোথা থেকে এসেছি। মনেই নেই স্যারের দেওয়া শর্ত। ওসব আর মনে থাকে! আর বন্ধুদের না বললে পরে কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর ভয় তো আছেই!



মিতিংগাছড়ি  ঝরনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের শিক্ষার্থীরা


সুবলং ঝরনা দেখেছি, কিন্তু ঝরনা স্নান না হওয়ায় মন খারাপ হয়েছিল। মিতিংগাছড়ি ঝরনা আমার মন ভালো করে দিয়েছে। আমি চুপচাপ তথ্য সংগ্রহে চলে গেলাম। মিতিংগাছড়ি গ্রাম প্রধানের বাড়িতে তথ্য সংগ্রহ করছিলাম। তিনি খুব খাতির করলেন। কাজ শেষে এসে দেখি ঝরনা দেখতে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এদিকে বন্ধু টগরদের গ্রুপও তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ করে আবুল হাসান স্যারের সঙ্গে ঝরনায় গিয়েছিল। স্যার ওদেরকেও চুপি চুপি নিয়ে গিয়েছিল। দুপুরের খাবারের জন্য সব গ্রুপ একসঙ্গে স্কুলের ঘাটে এলাম। এর মধ্যে ঝরনার খবর সবাই পেয়ে গেছে। অগত্যা অনুপম স্যার অন্যদের নিয়ে আরেকটি ছোট লঞ্চে করে ঝরনায় গেলেন। ট্রলার নিয়ে ঝরনায় যাওয়া সম্ভব না। কারণ ঝরনার ওখানে ঘাট খুব সরু। আধা ঘণ্টার মতো সবাই ঝরনায় গা ভিজিয়ে আবার ঘাটে ফিরে এল। এভাবে রাঙামাটিতে আমাদের সঙ্গে প্রথম ঝরনার মিতালি হলো।

অসম্ভব সুন্দর ঝরনা! মাধবকুণ্ড মিতিংগাছড়ির কাছে কিছুই না বলে মনে করি। তবে রাঙামাটি শহর থেকে বেশ দূরে হওয়ায় এই ঝরনা সম্পর্কে তেমন জানাশোনা নেই। পর্যটকদের আনাগোনাও কম। এই ঝরনা সম্পর্কে প্রচার থাকলে নিঃসন্দেহে পর্যটকদের ভিড় বাড়ত। এদিন ভালোর সাথে একটু তিক্ত অভিজ্ঞাতাও হয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার পথে রাঙামাটির বিখ্যাত ঝুলন্ত ব্রিজ দেখালাম। পানি বেড়ে যাওয়ায় ব্রিজটা ডুবে ছিল। সন্ধ্যায় শহরের শহীদ মিনার ঘাটে এসে দেখলাম পর্যটন দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে। দু’এক মিনিটের মধ্যেই অনুষ্ঠান শুরু হবে। আমরা কিছুক্ষণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। অনুষ্ঠান শুরু হলো, আদিবাসী নৃত্য দেখছিলাম। এর মধ্যে শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি। বৃষ্টি ও মেঘের গর্জন ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল। পরে অনেক ঝুঁকি নিয়ে ভিজতে ভিজতে কোনোমতে ক্যাম্পে ফিরেছিলাম। সেদিনের অভিজ্ঞতা একটু অন্যরকমই ছিল।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ জানুয়ারি ২০১৭/মেহেদী/রাসেল পারভেজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়