ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সীমান্ত পেরিয়ে দক্ষিণে : পথে পাওয়া বন্ধু

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১৫, ২৯ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সীমান্ত পেরিয়ে দক্ষিণে : পথে পাওয়া বন্ধু

ফেরদৌস জামান : স্মৃতিতে জমে থাকা দৃশ্যপট ও ব্যক্তিগত ডায়েরির পুরনো পাতাগুলিই ছিল সম্বল। যার কল্যাণে ‘সীমান্ত পেরিয়ে দক্ষিণে’ ধারাবাহিকের আজ দশম কিস্তির পরিবেশনা। আগের নয় পর্বজুড়ে জানানোর চেষ্টা করেছি ব্যাঙ্গালুরুকে কেন্দ্র করে চারপাশের টুকিটাকি ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে দু-চার কথা।

১৪ বছর আগে কৈশোর পেরিয়ে নব যৌবনকালের সেই স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চায় আরো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার কথা। কিন্তু এক ভিতি কাজ করছে, শিল্পমান রক্ষা করে লেখা এগিয়ে নেওয়ায় আমার জ্ঞান একেবারেই নিম্নপর্যায়ের। সুতরাং, অযোগ্যতা ও মনের দুর্বলতাজাত সায়কে প্রাধান্য দিয়ে এই ধারাবাহিকের ইতি টানার দিকে মনোনিবেশ করতে যাচ্ছি। তবুও ব্যাঙ্গালুরু থেকে চেন্নাই হয়ে কলকাতা পর্যন্ত এবং কলকাতার কিছু অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে করতে আরো দুই-তিন পর্ব পেরিয়ে যেতে পারে।

ট্রেনের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। কাটা হয়ে গেছে মানে রিজার্ভেশন নিশ্চিত নয়। নির্ধারিত আসনের জন্য রয়েছি ওয়েটিং তালিকায়। যাত্রার এক সপ্তাহ আগে থেকে প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় টিকিট কাউন্টারে গিয়ে ধরনা দিতে হল। ধরনা দেওয়া মানে অনুনয় বিনয় বা ঘুষ প্রদান নয় বরং সিরিয়াল মেনেই কাউন্টারে টিকিট প্রদর্শন করতে হয়, নানাবিধ কারণে অনেকেই যাত্রা বিরতি বা বাতিল করে থাকে আর সেই সুবাদে ওয়েটিং-এ থাকা নামগুলি ক্রমেই এগিয়ে যেতে থাকে এবং একপর্যায়ে অনেকেরই আসন রিজার্ভেশন মিলে যায়।

 



কয়েক দিনের প্রচেষ্টা ও অপেক্ষার পর রিজার্ভেশনটা মিলে গেল। ব্যাগ গুছিয়ে প্রিয় শহরকে বিদায় জানাবার পালা। ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার সময় রাত নয়টা কি সাড়ে নয়টা। ব্যাঙ্গালুরুতে শেষ আহারের দাওয়াত বুবুনদের বাসায়। চিকন চালের ধবধবে সাদা ভাত, সঙ্গে পনির-মুরগির বিশেষ তরকারি এবং আরো কি কি যেন। এদিকে ট্রেনের সময় নিকটবর্তী। খাওয়ায় ঠিক মত মনোনিবেশ হচ্ছে না। তাতে বুবুন এবং তার মার খুব আপসোস হল। এমনিতেই বিদায় বেলা তার ওপর দিয়ে কে জানে হয়তো জীবনে এই শেষ দেখা, আর কোনদিন দেখা হবে না! কোনমতে খেয়ে বিদায় নিতে গেলে বলে, চলো অন্তত ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিয়ে আসি। ট্যাক্সি বা অটো কোনটাই মিলছে না, অবলা শিশুর মত রাস্তার পাশে ব্যাগসহ দাঁড়িয়ে রেখে মা-মেয়ে দুজন দুদিকে দৌড় দিল। এক্ষুণি একটা বাহন চাই নইলে বিপত্তি। কয়েক মিনিটের মধ্যে পাশের মোড় থেকে বুবুন একটা ট্যাক্সি নিয়ে হাজির। বিদায় বলে রওনা দিতে হল। অপলক দৃষ্টিতে তারা দাঁড়িয়ে থাকল। ট্যাক্সি এগিয়ে চলল, কয়েক মুহুর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল বুবুন এবং বুবুনের মা। কিছুক্ষণ পর জানালা দিয়ে পেছনে তাকিয়ে আর তাদের দেখা গেল না। মনে পড়ছে নানা কথা, নানা স্মৃতি। এই পরিস্থিতিতে মাথার মধ্যে চেপে বসে সঠিক সময়ে জংশনে পৌঁছে ট্রেন ধরার তাড়না।

ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার মাত্র পাঁচ মিনিট আগে উপস্থিত হই। নির্দিষ্ট বগি এবং আসন পেয়ে গেলাম সহজেই। দীর্ঘ একটা হুইসেল দিয়ে বিশাল দেহি ট্রেনটার চাকা গড়াতে শুরু করল। জানালার পাশে বসে রাতের শহরকে দেখতে থাকলাম। চেনা-জানা অনেক জায়াগার মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলল ট্রেন। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আলো ঝলমলে মহানগর ছেড়ে প্রবেশ করল অন্ধকারে আচ্ছন্ন নির্জনতার মাঝে। নিচের দুইটি এবং সামনের তিন টায়ারের যাত্রী পাঁচজন কোরিয়ান তরুণী। সাথে নিয়েছে কত প্রকার খাবার-দাবার তার ঠিক নেই। উঠেই কিচির-মিচির সোরগোলে খেতে থাকল সমস্ত খাবার। এদিকে আমার কিছুই ভালো লাগছে না, শুধু হাই-হ্যালো সৌজন্যতা করে উপরের টায়ারে উঠে শুয়ে পড়লাম। মনে আছে যেদিন প্রথম ব্যাঙ্গালুরু যাই চেন্নাইয়ে  ট্রানজিটের পর ব্যাঙ্গালুরুর পথে মুখোমুখি বসেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন তরুণ শিক্ষকের সঙ্গে। মুখভর্তি প্রত্যেকেরই চাপা দাড়ি। আদব-কায়দায় খুব উন্নত। আলাপ পরিচয়ের পর যখন জানল, বাংলাদেশ থেকে এসেছি। তখন আগ বাড়িয়ে অনেক যত্ম করেছিল। তারা প্রায় সবাই বিশ্ব ইজতেমার কারণে বাংলাদেশের টঙ্গীর নাম জানে। যদিও উচ্চারণ করতে গিয়ে বারবার টঙ্গা বলছিল।

যাহোক, ঘুম ভাঙল ভোর বেলার কোলাহলে। পৌঁছে গেছি চেন্নাই। কয়েক ঘণ্টার ট্রানজিট এবং তারপর আবার কলকাতার উদ্দেশে দীর্ঘ যাত্রা। সেই ফাঁকে একটা অটো রিজার্ভ করে দেখে নিলাম গোল্ডেন সি-বিচ ও মেরিনা বিচ। মেরিনা বিচে সেদিন বোধহয় আমি একা মানুষ, বহুদূর পর্যন্ত কেউ ছিল না। লালচে বালুকা বেলা মাড়িয়ে ছুঁতে গেলাম সমুদ্রের নোনাজল। অটোচালক ব্যাগ নিয়ে অপেক্ষায় থাকল ঐ দূরে। বাংলাদেশ হলে নিশ্চিতভাবেই এই ভরসা পেতাম না। বহিঃনোঙ্গরে রয়েছে কয়েকটি জাহাজ, বাতাসে মাস্তুলগুলি যেন কাঁপছে। এরপর অটো চালকের পরামর্শে কি কি যেন দু-একটি জায়গা দেখে ফিরে এলাম জংশনে।

 



কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সময়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। সামনের আসনে অর্থাৎ টায়ারে বসেছে নতুন নতুন মানুষ। ইন্ডিয়ার দীর্ঘ ট্রেন জার্নির এই এক বৈশিষ্ট্য, একেক সময় একেক মানুষের পাশে পাওয়া। বিশেষ করে তা যদি ট্রানজিটযুক্ত রুট হয়ে থাকে। মুখোমুখি বসে আছি বেশ কিছুক্ষণ অথচ, কারও সঙ্গে কারোরই কথা নেই। ব্যাপারটা সত্যিই বেমানান। অভদ্রতা বা অসৌজন্যতাও বলা যেতে পারে। দীর্ঘ জার্নিতে আর কিছু না হোক অন্তত হাই-হ্যালো বলা একটি সাধারণ সৌজন্যতা। এরই মধ্যে আমার অনুমান সঠিক প্রমাণিত হল। মায়ের সাথে ছেলে এবং মেয়ে। প্লাটফর্মের ভিড়ে মেয়েটিকে ট্রেনে উঠার আগেই দেখেছিলাম, জিনসের প্যান্টের সাথে সর্ট কামিজ পড়া। বেশ লম্বা। ট্রেন ছুটে চলছে আপন গতিতে। কারও মুখে কোন কথা নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর অন্য একটি জংশনে ট্রেন থামল। এই সুযোগে যাত্রীরা যার যার বোতল বা পাত্রে পানি ভরে নিতে ব্যস্ত হয়ে গেল। অন্যদের মত নিজেও নেমে পড়লাম। খানিক পর হুইসেল দিয়ে ট্রেনের চাকা গড়তে আরম্ভ করল। যথারীতি উঠে পড়লাম। লক্ষ করি সামনে বসা মেয়েটি তখনও উঠতে পারেনি। এক হাতে বোতল তাই অপর হাতে দরজার হাতলটা ধরতে সুবিধা করতে পারছে না, আবার বোতলটা ফেলেও দিচ্ছে না। এদিকে চাকাও গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিছু না ভেবে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে মেয়েটিকে টেনে তুলি। ঘটনাটিকে ঢাকাই সিনেমার অতি সাধারণ একটি সিকোয়েন্সের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। তবে এ ধরনের ঘটনার ধারাবাহিকতায় সিনেমাতে যে অবধারিত পরিণতি দেখানো হয় আমার বেলায় তা ঘটেনি বা সে সুযোগও ছিল না।

পরিচয় পর্ব শেষে ইতিমধ্যেই আলাপচারিতা চলমান। মেয়েটির নাম প্রিয়া রাজ। পেশায়  সদ্য পাস করা চিকিৎসক। ইন্ডিয়ান আর্মিতে মেডিক্যাল কোরে কর্মরত। ছোট ভাই সঞ্জয় রাজ অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। দাদার বাড়ি তামিল নাডু আর নানা বাড়ি উড়িশ্যায়। ছুটিতে মায়ের সঙ্গে নানা বাড়ি বেড়াতে আসছে। সাথে দুইটি বড় বড় ল্যাগেজ। ল্যাগেজগুলি রঙ্গিন কাপড়ের কাভারে মোড়ানো। বাদ্যযন্ত্র  ঢাক-ঢোল অথবা খোল ইত্যাদি যেমন কাপড়ে মোড়ানোর রীতি রয়েছে তেমনি ইন্ডিয়ায় ল্যাগেজ-সুটকেস কাপড়ে মোড়ানোটাও একটি রীতি। লক্ষ করা যায়, পানির পাত্রটাও কাপড়ের মোড়ক বা কাভারের মধ্যে তোলা থাকে। দেড়-দুদিনের পথ তাই অন্য যাত্রীদের মত প্রিয়াদের সাথেও রয়েছে ঘরে বানানো রুটি, হালুয়া জাতীয় নানা খাবার। সুতরাং, বাকি সময় আমাকে আর বাইরের খাবার কিনে খেতে হয়নি।

চলছে নিজ নিজ দেশ ও অভিজ্ঞতা থেকে অনেক গল্প। আপন আপন দেশ নিয়ে এমন কোন জানা গল্প নেই যা শোনা হয়নি। ওদের মা তো গল্পে গল্পে সবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন শৈশব-কৈশোর এমনকি শিক্ষা জীবনে। তারপর থেমে থেমে একাধিক পর্বে আন্তাক্ষারি বা অন্ত-অক্ষরি খেলা, কাগজ ছিড়ে কার্ডস খেলা সঞ্জয়ের সাথে আমরা কেউই পেরে উঠলাম না। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে যে যার সংগ্রহশালা থেকে প্রয়োগ করে গেলাম সামর্থের সবটুকু কিন্তু কম কথা বললেও গানের বেলায় সঞ্জয় ভীষণ পটু এবং সতর্ক। আন্তাক্ষারিতে তাদের মা-ও কম গেলেন না। ইন্ডিয়ায় দীর্ঘ ট্রেন জার্নি মানেই মুখোমুখি বসা যাত্রীদের মধ্যে এক অসাধারণ রকমের সম্পর্ক গড়ে ওঠা। কেটে গেল সম্পূর্ণ একটি দিন এবং রাত। ট্রেন চলছেই। পথে গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনগুলিতে খনিকের জন্য থামছে আর সেই ফাঁকে আমরা ঠান্ডা পানি সংগ্রহে ছুটছি। পরবর্তী সময়ে দেখা গেল বোতলে পানি থাকা সত্বেও দৌড়ে উঠানামা; এইটুকু বিনোদনের জন্য প্রায় প্রতিটি বিরতিতে নামছি।

 



দেখতে দেখতে ট্রেন প্রবেশ করে উড়িশ্যার সেই অঞ্চলে যেখানে কোনো এক স্টেশনে ওদের নেমে যাওয়ার কথা। আধাঘণ্টা আগে থেকে বিদায়ের প্রস্তুতি চলমান। এই বিদায়ে কোনো তাড়াহুড়ো নেই। কোন যুক্তি এবং কারণ ছাড়াই মন যেন যেতে চায় না অথচ, যাওয়ার জন্য অধির হয়ে থাকে। উড়িশ্যার আকাশে বৃষ্টি হয়ে গেছে। প্ল্যাটফর্ম বৃষ্টির পানিতে কালো বর্ণ ধারণ করেছে। বেলা দুইটা কি তিনটা, পাতলা মেঘের পেছনে সূর্যটা এই হারিয়ে যায় তো এই উঁকি দেয়। ট্রেন থামলে ল্যাগেজ নামাতে সাহায্য করলাম। মাত্র একদিন আর একদিনের অর্ধেক অথচ, মনে হচ্ছিল কত আপন আর কত কাল এক সাথে ছিলাম! বিদায় সম্ভাষণ তখনও চলমান, যেন আরও কত রকমে বিদায় হলে ভালো লাগত! ট্রেন ছেড়ে দিল, শত শত মানুষের ভিড়ের মাঝ থেকে একটি হাত বিদায় বিদায় বলছে। ব্যবধান বাড়ছে হাতটিও টান টান হয়ে উপরে উঠছে। ট্রেনের গতি বাড়ার সাথে সাথে চোখে বাতাসের ঝাপটা আর দূরত্বের অস্পষ্টতার মাঝে বিলীন হয়ে গেল বিদায় বিদায় বলে তুলে ধরা সেই হাত!



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জানুয়ারি ২০১৭/ফেরদৌস জামান/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়