ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ভাই ভাত আছে?

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৮, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভাই ভাত আছে?

(সূচনা পর্ব)

প্রিন্সেস স্ট্রাস দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। একটার পর একটা রেস্টুরেন্ট। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খাবারের পসরা। দামি-কমদামি সব রকমের রেস্টুরেন্ট রয়েছে। কোনো কোনোটার বাইরের চাকচিক্য দেখলেই ভয় করে। মনে হয় আমার মতো হালকা পকেট নিয়ে এগুলোতে ঢোকার সাহস করাই উচিত নয়। আবার কোনোটা দেখলে মনে হয় হ্যাঁ, এটাতে ঢোকা যেতে পারে।

আমার মনে হলে কি হবে পার্থর সেকথা মনে হচ্ছে না। পার্থর পুরো নাম মৃগাঙ্ক শেখর ভট্টাচার্য। যে সময়ের কথা লিখছি, সেসময়ে তিনি চাকরি করতেন অক্সফ্যাম জিবির বাংলাদেশ অফিসে বেশ বড় একটি পদে। আমরা দুজন একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকা থেকে উড়ে এসেছি নেদারল্যান্ডস-এর বিশাল শহর দ্য হেগ-এ। থাকছি ইবিস হোটেলে। সাতদিন হলো এসেছি। প্রতিদিনই কোনো না কোনো অনুষ্ঠানে যাচ্ছি হয় আমস্টারডাম, ইউট্র্যাক্ট, রট্যারডাম অথবা হেগ শহরের ভিতরেই।

আমাদের নিমন্ত্রণ করেছে অক্সফ্যাম নভিব নেদারল্যান্ডস। খাওয়ার ব্যবস্থাও তারাই করেছে। খাওয়াচ্ছেও ভালোই। কিন্তু ভাত, মাছ, ডাল, ভর্তা না হলে কি বাঙালির চলে? অন্তত আমার চললেও পার্থর চলছে না। যদিও তিনি আমার চেয়ে অনেক বেশি দেশ ভ্রমণ করেছেন। আমাদের এই নেদারল্যান্ডস ভ্রমণের গল্পটা ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের। সেসময় আমি জনকণ্ঠের নারী পাতা ‘অপরাজিতা’র বিভাগীয় সম্পাদক। প্রতি সপ্তাহে নারী অধিকার নিয়ে গরম গরম লিখি আর পুরুষতান্ত্রিক পাঠকের গালি খাই। পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের সঙ্গেও আছি (এখনও আছি)। সেই সূত্রেই যেতে হয়েছিল নেদারল্যান্ডস। যাহোক। সেদিন সন্ধ্যায় পার্থ বললেন, আজ ভাত খেতে হবে। ওদের ইউরোপীয় ডিশে আর পোষাচ্ছে না। চলেন আজ রেস্টুরেন্ট পাড়ায় ঘুরে দেখি ইন্ডিয়ান খাবার অন্তত পাওয়া যায় কি না।

দ্য হেগ শহরের রেস্টুরেন্ট পাড়ায় অনেকক্ষণ থেকে ঘুরছি। কোনোটাই মনে ধরছে না পার্থর। ঘুরতে ঘুরতে একটি মাঝারি মানের রেস্টুরেন্টের সামনে থমকে দাঁড়ালাম। ‘রমনা রেস্টুরেন্ট’ নামটি দেখেই মাথার মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠলো। এর মালিক বাংলাদেশের না হয়ে যায় না।

কাচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। বেশ জমজমাট খাওয়া দাওয়া চলছে টেবিলে টেবিলে। সবাই শ্বেতাঙ্গ। গুটি গুটি পায়ে কাউন্টারের সামনে গিয়ে বাংলায় বললাম, ‘ভাই ভাত আছে?’

কাউন্টারে বসা ভদ্রলোক চমকে ঘুরে তাকালেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বাংলায় বললেন, ‘কী বললেন আপনি?’

আমি আবার বললাম, ‘ভাই, আপনার এখানে ভাত আছে কি?’

ভদ্রলোক কাউন্টার থেকে লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। আনন্দিত হাসির সঙ্গে বললেন, ‘আপনি বাঙালি?’

‘হ্যা ভাই বাঙালি।’

‘আপনি বাংলাদেশের বাঙালি?’

‘হ্যাঁ, বাংলাদেশের বাঙালি, ঢাকার বাঙালি।’

ভদ্রলোক খুশিতে প্রায় আমাদের জড়িয়ে ধরেন আরকি! তার সঙ্গে আমাদের আলাপ জমে উঠল। জুয়েল ভাই নামে এই ভদ্রলোকই রেস্টুরেন্টটির মালিক। তিনি আগে ছিলেন লন্ডনে। এরপর নেদারল্যান্ডস-এর হেগ শহরে চলে এসেছেন। এখানে বেশ ক’জন বাঙালি কাজ করেন। শেফ হিসেবে আছেন সিলেটের এক ভদ্রলোক। তিনি নিষেধ করায় তার নামটি আমি প্রকাশ করলাম না। নিষেধ করছেন কেন জিজ্ঞাসা করতে ভদ্রলোক একটু কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন,‘ আপা আমি ইঞ্জিনিয়ার। বুয়েট থেকে পাশ করেছি। এখানে শেফের কাজ করছি। দেশে জেনে গেলে সম্মান থাকবে না।’

জুয়েল ভাইয়ের বাড়ি ধানমন্ডিতে। আমি ঢাকার মানুষ জেনে আরও বেশি করে গল্প জমালেন। তাঁর হোটেলে পোলাও বা ফ্রাইড রাইস এবং চিকেন, বিফ, মাটন কারি ছিল। ছিল আরও নানা রকম মোগলাই খাবার। শ্বেতাঙ্গ ক্রেতাদের পছন্দের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মেন্যু। জুয়েল ভাই আমাদের সে খাবার খেতে দিলেন না। বললেন, আমার কাছে নাজিরশাহি চাল আছে। আজ ভাত, মাছ, ডাল, ভর্তা খাবো। শেফভাই খুব উৎসাহ করে আবার ভাত বসালেন। নতুন করে তরকারি রান্না শুরু করলেন। ডিপ ফ্রিজে রাখা দেশ থেকে আনা ইলিশ বের করলেন। দেড় ঘণ্টার মধ্যে খাবার রেডি হয়ে গেল। রেস্টুরেন্টের একটা টেবিলে আলাদা করে আমরা সবাই বসলাম। কাঁটা চামচ নয়। হাত দিয়ে ভাত খাওয়া শুরু হলো। ভাত, আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, মাছ ভাজা, বেগুন ভাজা, ফোঁড়ন দেওয়া দেশী স্টাইলের ডাল আর সবজি ভাজি। বিদেশে দেশী ভাইদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না।

গোল বাঁধলো বিল দেওয়ার সময়। জুয়েল ভাই কিছুতেই টাকা নেবেন না। বলেন, ‘এক বেলা নিজের ভাইবোনকে খাওয়াতে পারবো না, আমি কি এত গরীব?’ আবার বলেন, ‘এখানে ব্যবসা খুলেছি ঠিকই। খাবার বিক্রি করেই সংসার চলে। কিন্তু নিজের ভাইবোনের সঙ্গে তো আমি ব্যবসা করতে বসিনি।’

যতই বুঝাই এই খাবারের বিল পরিশোধ করবে আমন্ত্রণকারী সংস্থা। তিনি বলেন, ‘তাহলে মেমো দিয়ে দেই। আপনারা ওদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিতে পারবেন।’

শেষ পর্যন্ত কিছুতেই আমরা খাবারের মূল্য শোধ করতে পারিনি। তবে আমার কাছে মনে হচ্ছিল, সবকিছুর মূল্য শোধ করতে চাওয়া উচিতও নয়। যে আন্তরিকতা, যে ভালোবাসা দিয়ে তিনি আমাদের আপ্যায়ন করলেন সেই অনুভূতির মূল্য পরিশোধ করতে চাওয়াটাই ভুল। তার ওখানে আড্ডা দেওয়ার সময়ই খবর পেয়ে আরও ক’জন বাঙালি এলেন। তারাও থাকেন সেই এলাকাতে। একজনের একটি দোকান আছে। ইউটিলিটি শপ। আমি ওখান থেকে কিছু কেনাকাটা করলাম। দাম নিতে হবে সেই শর্তেই গিয়েছিলাম তার দোকানে। জুয়েল ভাই এবং অন্যদের ফোন নম্বর আমি হারিয়ে ফেলি। কারণ নম্বরগুলো সেভ করা ছিল মোবাইলে। আমার সব ফোন নম্বর নিয়ে সে হারিয়ে যায়। তখন ফেসবুকের এমন রাজ্যপাট ছিল না। তাই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আর হয়নি। তবে এখনও মনে আছে সুদূর নেদারল্যান্ডস-এ একটি সন্ধ্যায় সেই একখণ্ড বাংলাদেশের কথা। (চলবে)

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়