ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

চিৎকাইত হোটেল এবং আমার প্রথম চট্টগ্রাম দেখা

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০২, ২ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চিৎকাইত হোটেল এবং আমার প্রথম চট্টগ্রাম দেখা

ফেরদৌস জামান : চিন্তা-ভাবনা করেই আইইএলটিএস পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে নির্বাচন করি চট্টগ্রাম ব্রিটিশ কাউন্সিল। তার অন্যতম কারণ ফোর ডাইমেনসনাল আইইএলটিএস পরীক্ষার স্পিকিং পর্বে ইংরেজ পরীক্ষক থাকার সম্ভাবনা। একমাত্র এই সুবিধা পাবার আশায় তৎকালীন অনেক পরীক্ষার্থী ঢাকা কেন্দ্রের চেয়ে চট্টগ্রাম বেশি পছন্দ করত। তার একটি বাস্তব কারণও আছে, ঢাকা ব্রিটিশ কাউন্সিলে স্পিকিং টেস্টে বেশিরভাগ সময় বাঙালি পরীক্ষক থাকেন। দেখা যায় ভলো পরীক্ষা দেয়ার পরও অস্বাভাবিক রকমের আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। নবীন হোসাইন এবং আমি দুজন মিলে উক্ত বিষয় মাথায় রেখে রেজিস্ট্রেশন করলাম চট্টগ্রাম ব্রিটিশ কউন্সিলের অনুকূলে।

পরীক্ষার আগের দিন সন্ধ্যায় বগুড়া থেকে দুই বন্ধু রওনা হলাম। সময়টি ছিল ২০০৬ সালের শেষে বা পরের বছর শুরুর দিকে। কিসের পরীক্ষা! এই প্রথম চট্টগ্রাম যাচ্ছি সেই আনন্দে দুদিন আগ থেকেই দুচোখের ঘুম হারাম। বাসে উঠেও একই অবস্থা। ভাবলাম পরের দিন পরীক্ষা; বাসে ঘুমিয়ে নিতে হবে। যমুনা সেতু তারপর ঢাকা, এমন করে পৌঁছে যাই কুমিল্লার দাউদকান্দী- অথচ কারও চোখে ঘুম নেই। পাহাড়ের শহরে যাচ্ছি, পরীক্ষা চলবে দুই দিন ধরে। সুতরাং, কী দেখব আর কোথায় কোথায় যাব সে পরিকল্পনা আর শেষ হয় না। অবশেষে মনের ওপর জোর চালিয়ে বাকি পথটুকু ঘুমিয়ে নিতে হলো।

ঘুম ভাঙল, এবার বাস থেকে নামতে হবে। রেলস্টেশনের কাছেই বিআরটিসি নামক জায়গায় নেমেই ভোরের কাঁচা আলোয় দুচোখ ঝলমল করে উঠল। প্রথমে থাকার জায়গা ঠিক করা দরকার। ফুটপাথ ধরে মিনিট বিশেক হাঁটছি, রাস্তার অপর পাশে রেলস্টেশন। যে কয়টি হোটেল দেখলাম তার মধ্যে হোটেল ইকবাল উপযুক্ত মনে করলাম। পুরনো দালান, খয়েরি রঙের মেঝে। ছোট্ট একটি ঘর, কোনো মতে দুইজন থাকা যায় এমন দুটি বিছানা পাতা। তার আগে যে কয়টি হোটেল পরখ করে দেখা হলো তার মধ্যে চিৎকইত হোটেল ছিল অধিক আকর্ষণীয়। পরের দিন পরীক্ষা না হয়ে যদি শুধু ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যওয়া হয়ে থাকত তাহলে চিৎকাইত হোটেলের অভিজ্ঞতা  থেকে নিজেদের মোটেও বঞ্চিত করতাম না। মাত্র ত্রিশ টাকায় রাত পার করার বন্দোবস্ত। কাঠের পাল্লা খুললেই সমস্ত ঘর একটি প্রশস্ত বিছানা। সাদা চাদর বিছানো, পাশাপাশি কমপক্ষে বিশ থেকে পঁচিশটি বালিশ পাতা। কোনো মতে শোয়া যায়। এদিক-সেদিক হওয়ার সুযোগ নেই, কেবল চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা। ফিরতে বা কাত হতে চাইলে হতে হবে সাবধানে, কারণ সামন্য এদিক-সেদিক হলেই পাশের জনের শরীরের ওপর উঠে যাওয়ার আশঙ্কা। যাইহোক, আপাতত নিবাস হোটেল ইকবাল। করিডোরের শেষ মাথায় টানা বারান্দা। সামনে মহানগরের ব্যস্ত সড়ক। সারক্ষণ রিকশার টুং টুং এবং গাড়ির প্যা-পো লেগেই আছে।

 



একটা সতেজ গোসলের পর শুরু করলাম খাবারের অনুসন্ধান। তেমন একটা খাবারের দোকান চাই যেখানে দুধ-চায়ে পরোটা চুবিয়ে খাওয়া যেতে পারে। জীবনে প্রথম চট্টগ্রাম ভ্রমণ সুতরাং এই জিনিসটি করা চাই-ই চাই। স্থানীয় এই রীতিটির খবর মুখে মুখে আগে থেকেই জানা ছিল। একের পর এক দোকান ঘুরছি আর পরখ করছি কোনটিতে এমন করে কেউ পরোটা খাচ্ছে। না, কাউক তো খেতে দেখি না! হ্যাঁ, এবার মিলে গেল। অত্যান্ত মনোযোগ দিয়ে একজন একা এক টেবিলে বসে কর্মটি করছে। কেবল শুনেছি কিন্তু দেখা ছিল না, তাই কায়দা করে তার খাওয়ার ধরন রপ্ত করতে হলো কয়েক টেবিল দূরে থেকেই। এরপর এ্যাকশন- পরোটা ছিঁড়ে চায়ের পেয়ালায় চুবিয়ে খাওয়ার অনুভূতিটা ছিল বেশ মজার। অনুকরণ করে খাওয়ার অনভিজ্ঞতা যে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছিল তা আন্দাজ করতে পারি আশপাশের দু’চারজন এবং খাবার সরবরাহকারী কিশোরের দৃষ্টি দেখে। টের পাওয়ার পর ছেলেটির মুখের দিকে তাকাতেই বেচারা ফিক করে হাসি দিয়ে সরে যায়। হোটেলে ফিরে খানিকক্ষণ বিশ্রামের পর ছুট দিতে হলো ব্রিটিশ কউন্সিলের দিকে।

পরীক্ষার সময় বেলা এগারোটা। প্রথম দিন রিডিং, লিসনিং এবং রাইটিং। স্পিকিং পরের দিন আড়াইটায়। রিকশায় এবং আরও কি কি করে যেন পৌঁছে গেলাম কেন্দ্রে। তার আগে টাইগার পাস নামক জায়গাটি দেখে নিতে ভুল করলাম না। কারণ এই জায়গার নাম এতটাই শুনেছি যে, না দেখলে বোধহয় চট্টগ্রাম যাওয়াটাই ব্যর্থ। যা দেখলাম তার বর্ণনা করার কিছুই নেই, কারণ প্রত্যাশা ছিল, টাইগার পাসে টাইগার না দেখতে পেলেও পাহাড়-পর্বত এবং অরণ্য যথেষ্টই থাকবে। যাইহোক, কয়েক ঝাক কাকের দেখা অন্তত মিলেছে। পরীক্ষার কেন্দ্রে সেদিন আমরাই সর্বপ্রথম পরীক্ষার্থী। কয়েক মিনিট পর পা টিপে টিপে প্রবেশ করল আরও একজন। বসলেন কয়েক চেয়ার ফাঁকে। আলাপ পরিচয়ের পর দু’চারটি কথা মাত্র। পরীক্ষা শুরু হলো সময়মতো। এরপর কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে তার সাথে দ্বিতীয় পর্বে আরও কিছু কথা। ঘনিষ্ঠতা পৌঁছে গেল প্রত্যাশার চেয়েও অনেকটা গভীরে। এবার একই রিকশায় কিছুদূর এগিয়ে আসা, সেখান থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আলাদা হতে হতে পেরিয়ে যায় আরও অনেকটা সময়। ততোক্ষণে আমরা আসিফ ইকবালের বাড়িতে। শহরের কোনো একটা জায়গা, ঠিক মনে নেই। বহু পুরনো এক বিদ্যালয়, ঠিক তার সমনেই বাড়ি। দালানের পরিপাটি ছাদে কেটে গেল চমৎকার একটি বিকেল। নাস্তা চলমান, একটা একটা করে পাতা উল্টে দেখছি ছবির অ্যালবাম। অ্যালবামের বদৌলতে জানতে পাই তিনি কিবোর্ড বাদক। স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ের অনেক গায়কের সাথেই তার কিবোর্ড বাজানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। চমৎকৃত হয়ে প্রসংশাস্বরূপ- বাহ্ উচ্চারণ করতেই সে সবিনয়ে হেসে বলল, দোয়া করবেন।

কথাটুকু চট্টগ্রামের আঞ্চলিক টানে তার মুখে এতটাই আকর্ষণীয় এবং মানানসই লাগল যে, পরবর্তীতে বেশ কিছু দিন আমার এবং নবীনের মুখে ঘুরেফিরেই কথাটি উচ্চারিত হতে থাকল। যেমনটি হয়ে থাকে ভালো কোনো গানের দুই লাইন শোনার পর।

পরের দিন স্পিকিং পরীক্ষা শেষে আসিফ ভাইয়ের সাথে বের হই চট্টগ্রাম ঘুরে দেখতে। দেশের বাইরে সমুদ্র সৈকত দেখার অভিজ্ঞতা থাকলেও বাংলাদেশে ততোদিনেও দেখা হয়ে ওঠেনি। এই কথাটি জানার পর ওদের দুজনেরই অভিমত, তাহলে পতেঙ্গা যাওয়া যেতে পারে। সে জন্য অবশ্য শহর থেকে বেশ দূরে যেতে হলো। উঁচু বাঁধ, বাঁধের পরেই সমুদ্র। স্যাঁতস্যাঁতে সৈকতে আছড়ে পড়ছে একটার পর একটা ঢেউ। পাড়ে রয়েছে অসংখ্য কংক্রীটের ব্লক। অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সৈকত। মানুষ অনেক বেশি হলেও নিজেকে একটু নিরিবিলিতে সরিয়ে নেয়া তেমন কষ্টের ব্যাপার নয়, মৃদু লয়ে পা চালিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেই সৈকতের সমস্ত নীরবতায় খুঁজে পাওয়া যায় নিজেকে। আমরাও ঠিক সেই কাজটি করলাম। কোলাহল থেকে একটু দূরে ব্লকে বসে উপভোগ করলাম দিনের সূর্যের বিদায় এবং মাথার ওপর বেশ নিকট দিয়ে বিমানের অবতরণ। এই দৃশ্যটুকু দেখার জন্য অনেকে পতেঙ্গা সৈকতে যায়। বিমান বন্দর সমুদ্র সৈকতের খুব নিকটে অবস্থিত হওয়ায় মাথার ওপর দিয়ে বিমান অবতরণের এই দৃশ্য এখানে সার্বক্ষণিক একটি বিষয়, যা ভ্রমণপ্রিয়দের জন্য অভিজ্ঞতার খাতায় অতিরিক্ত একটি পাওনা হিসেবে যোগ হয়ে থাকে।

 



পেরিয়ে গেছে বেশ খানিকটা সময়, এবার সমুদ্রকে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়ি বিমান বন্দর যাওয়ার জন্য। পথিমধ্যে নবীন পকেটে হাত দিয়ে চমকে উঠে বলে, আমার পকেটে কিছুই নেই!

তার মানে? আটোরিকশা ঘুরিয়ে আবারও চলে যাই সৈকতে, ঠিক যেখানটায় বসে ছিলাম। ব্লকের ফাঁকে মানিব্যাগ ও পাসপোর্ট পরে রয়েছে, যেন যত্ন করে কেউ রেখে দিয়েছে। বাঁধের উপর দিয়ে ঝিনুক-শঙ্খের দোকান, ফিরে পাওয়া মানিব্যাগ থেকে নবীন টাকা বের করল কেনার জন্য। এটি প্রায়শ্চিত্ত। এবার পুনরায় ফেরার পালা। আসিফ জানাল, ১৯৯১ সালের জলোচ্ছ্বাসে সমস্ত এলাকা কয়েক মিটার পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল। বিমান বন্দরের সামনে মিটমিটে আলোয় বসে চললো আমাদের লম্বা আড্ডা। এশার নামায সেখানকার মসজিদে পড়ে নেয়া হলো। উন্নত মসজিদ, নবীনের কথায় অবিকল এমন মসজিদ নাকি সে মালয়েশিয়ায় দেখেছে। রাতের আঁধারে মিটমিটে আলোয় চলন্ত অটো থেকে কী দেখেছিলাম তা ঠিক আজ মনে নেই, তবে দুপাশে জাহাজ সদৃশ কোনো কিছু রয়েছে এমন এলাকার মাঝ দিয়ে অনেকটা পথ এসেছিলাম। রাতের আঁধারের চট্টগ্রামের আরও কী কী দেখেছিলাম তাও ঠিক স্মরণ করতে পারি না, তবে এমন হুটহাট ভ্রমণে একাধিকবার জায়গাটি দেখা হয়েছে নানাভাবে নানা আঙ্গিকে। আশা করছি, আগামীতে এই সাদামাটা অতি সাধারণ গল্পগুলি পাঠকদের সাথে ভাগাভাগি করা যাবে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ মার্চ ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়