ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অভিবাসীদের মাহফিলে || শান্তা মারিয়া

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৩, ১১ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অভিবাসীদের মাহফিলে || শান্তা মারিয়া

(লক্ষ্মণরেখার বাইরে: ৬ষ্ঠ পর্ব)

 

নেদারল্যান্ডস-এ ২০০৭ সালের শরতে আমি গিয়েছিলাম অক্সফ্যাম নভিবের আমন্ত্রণে। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন। নেদারল্যান্ডসে অনেক শরণার্থী আছেন। মূলত আলজেরিয়া, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে তারা সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। আফ্রিকারও কয়েকটি দেশ এর মধ্যে রয়েছে।

এই শরণার্থীরা মুসলিম। তারা তাদের ধর্ম পালন করেন। সেসঙ্গে ‘ধর্মীয় বিধান নয়’, অথচ তারা মনে করেন সেটি ‘ধর্মীয় বিধান’ এমন কিছু রীতিনীতিও তারা পালন করেন যেগুলো মূলত তাদের গোত্রীয় রীতিনীতি। এর মধ্যে নারীর প্রতি নির্যাতনমূলক বেশকিছু রীতিও রয়েছে। যেমন একেবারে শিশু মেয়েকে বিয়ে দেওয়া, মেয়েদের খৎনা করা, অনার কিলিং বা পারিবারিক সম্মান রক্ষার নামে নারীকে হত্যা, মেয়েশিশুকে স্কুলে যেতে না দেওয়া, স্ত্রীকে, বোনকে, মেয়েকে প্রহার ইত্যাদি। নেদারল্যান্ডস সরকার এসব রীতিকে বাধা দিতে গেলেই শুনতে পায় এগুলো নাকি তাদের ধর্ম। ফলে এগুলোতে বাধা দিলে তাদের ধর্ম পালনে বাধা দেওয়া হবে।

একদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন অন্যদিকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। এজন্য আইনের পাশাপাশি সমাজ সচেতনতামূলক কাজ চালাতে হয় সরকার এবং বিভিন্ন মানবাধিকার ও সেবামূলক সংস্থাগুলোকে। অক্সফ্যাম নভিবের একটি বড় কাজ হলো এই অভিবাসীদের নিয়ে।

অভিবাসীরা ‘রামাদান ফেস্টিভ্যাল’ করে প্রতি রোজার মাসে। সে সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বক্তারা আসেন। সেমিনার হয়। সেই সেমিনারে পারিবারিক নির্যাতন বিষয়ে পেপার উপস্থাপন করা হয়।

আমি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট উই ক্যান ক্যাম্পেইনের সদস্য। আমার এবং পার্থ (মৃগাংক শেখর ভট্টাচার্য) এর ওপর ভার পড়ল যে ওই অনুষ্ঠানে আমরা দুজন দুটি পেপার উপস্থাপন করব। শুধু তাই নয় অভিবাসীদের সঙ্গে কয়েকদিন কয়েকটি সেশনে আলোচনাও হবে বিভিন্ন বিষয়ে।

যেমন মূল বিষয় হলো মেয়েদের খৎনা এবং তার ভয়ানক ফলাফল। এখানে আফ্রিকার যেসব অভিবাসী আছেন তাদের মধ্যেই এই সমস্যাটা তীব্র। অনেক কিশোরী মেয়ে এই নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করে। অনেকে চিরদিনের জন্য অঙ্গহানির শিকার হয়।

সেমিনারে পেপার উপস্থাপনের পর আসে প্রশ্ন-উত্তর পর্ব। আমি যখন বাংলাদেশে পারিবারিক নির্যাতন প্রসঙ্গে তাদের সঙ্গে কথা বলি প্রথমেই তারা জানতে চায় আমি মুসলিম কি না। বিদেশে যখন আমি কোনো অনুষ্ঠানে যাই বা নিজের দেশকে রিপ্রেজেন্ট করার মতো কোনো ভূমিকায় থাকি তখন সবসময়ই আমার পরনে থাকে শাড়ি। কপালে টিপ, হাতে চুড়ি এবং অন্যান্য অলংকারও থাকে পুরো মাত্রায় বাঙালি ঘরানায়। এই সাজসজ্জা বিশেষ করে কপালের টিপটাই তাদের বিশেষ কৌতূহলের জন্ম দেয় যে, এই নারী মুসলিম কি না। আমি তাদের ব্যাখ্যা করে বলি যে আমার ধর্ম ইসলাম কিন্তু আমি বাঙালি। তাই বাঙালি সংস্কৃতির রীতিনিতি মেনে চলি। তবে যদি সেটা নির্যাতনমূলক হতো তাহলে মেনে চলতাম না। আমার সংস্কৃতি যদি হতো নরবলি দেওয়া তাহলে সেটা নিশ্চয়ই মানতাম না। তেমনি মেয়েদের খৎনা ধর্মীয় বিধান নয়। এটা আফ্রিকার এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের বর্বর রীতি।

আফগানিস্তানের অভিবাসীদের মধ্যে বাল্যবিবাহের বেশ প্রকোপ। আর স্ত্রী প্রহার তো মনে হয় কোনো ঘটনাই নয়। নেদারল্যান্ডস এ পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধে চমৎকার একটি আইন রয়েছে। সেটা হলো যদি কোনো স্ত্রী অভিযোগ করে তাহলে পুলিশ এসে নির্যাতনকারীকে ধরে নিয়ে যাবে এবং তাকে আটক রাখবে। যাতে ভিকটিম নিরাপদ থাকতে পারে। কিন্তু আফগান ও আলজিরিয়ান নারীরা মনে করে স্বামীকে ধরে না গিয়ে যদি তার আচরণটা পরিবর্তন করানো সম্ভব হতো সেটা বেশি ভালো হতো।



উইক্যান এর চেঞ্জমেকার হিসেবে আমরাও অবশ্য আইনগত পদক্ষেপের পাশাপাশি সমাজের নারী ও পুরুষ সবারই আচরণগত পরিবর্তনের দিকে অনেক বেশি গুরুত্ব আরোপ করি।

বাংলাদেশ বিষয়ে তাদের বেশ আগ্রহ। এখানে ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে  পরস্পর বন্ধুত্ব আছে কি না, এসব বিষয়ে। তাদের সামনে আমি ও পার্থ নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে বললাম, আমরা দুটি ভিন্ন ধর্মের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে যথেষ্ট বন্ধুত্ব রয়েছে। পারিবারিকভাবেও রয়েছে বন্ধুত্ব। তার পূজার উৎসবে আমি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেড়াতে যাই, সেও স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ঈদের সময় আমার বাড়িতে আসে।

অনুষ্ঠানটি হচ্ছিল আমস্টারডামের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ভবনে। সেকি বিশাল ভবন। স্থাপত্যটাও দারুণ সুন্দর। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিটা অবস্থিত উপসাগরের কাছে বন্দর এলাকায়। বহুতল বিশাল ভবনের ওপরের অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠান। অডিটোরিয়ামের বাইরে বড় বারান্দায় দাঁড়ালে চোখে পড়ে সন্ধ্যার আঁধারে আলোকজ্জ্বল আমস্টারডাম। ওপর থেকে শহরের অনেক অংশই চোখে পড়ে। আরো চোখে পড়ে বন্দরের জলের বুকে আলোর খেলা।

যেহেতু ‘রামাদান ফেস্টিভ্যাল’ তাই ইফতারের দাওয়াত তো ছিলই। আমার কৌতূহল ছিল যে ওরা ইফতারিতে কী পরিবেশন করে। বুফে খাবার ছিল। ঐতিহ্যিবাহী ডাচ রুটি। বিশাল লম্বা। আরো অনেক রকম রুটি। কোনোটা তিল দেওয়া, কোনোটা মোরব্বাযুক্ত। নানা রকম আকারের রুটি। সঙ্গে হরেক রকম পনির তো আছেই। আরো  আছে জ্যাম, জেলি, মার্মালেড। রয়েছে বিভিন্ন রকম স্যুপ। তার মধ্যে  টমইয়াম স্যুপ, ক্রিম স্যুপও রয়েছে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল বড় বড় গ্রিলড লবস্টার। নেদারল্যান্ডস সমুদ্রের তীরবর্তি দেশ। এখানে সামুদ্রিক মাছ প্রচুর পাওয়া যায় এবং খাওয়া হয়।

যেহেতু ইফতারের দাওয়াত তাই কোনো হার্ডড্রিংকস ছিল না বলাই বাহুল্য। তবে সফট ড্রিংকস ছিল নানা রকমের। সেখানে অভিবাসীদের বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবারদাবারও ছিল। সেগুলোও বেশ মজাদার। বিশেষ করে ঘোলজাতীয় একটা পানীয় আমার খুব মজা লেগেছিল। এমনিতে ঘোল খেতে পছন্দ না করলেও ঘোল পানে আপত্তির তো কোনো কারণ নেই।

দেশের বাইরে ইফতারের সেই সন্ধ্যাটি এখনও মনে রয়েছে আর বিশেষ করে মনে আছে গ্রিলড লবস্টার আর ভিনদেশি ঘোল খাওয়ার (পান করার) স্বাদ।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ মার্চ ২০১৭/মারিয়া/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়