ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

হেমন্তের পাতাঝরা দিন || শান্তা মারিয়া

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১৫ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হেমন্তের পাতাঝরা দিন || শান্তা মারিয়া

ট্রেড ফেয়ারের প্রবেশপথে

(লক্ষ্মণ রেখার বাইরে- ১৫)

আমার জীবনে একটা দিকে খুব মিল লক্ষ্য করেছি। সেটি হলো, জীবনে বেশিরভাগ বিদায়ের ঘটনা ঘটেছে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। যখন ঝরা পাতার হাত ধরে আসে শরৎ-হেমন্ত। ওকলাহমায়ও ছিলাম শরৎ-হেমন্ত কালেই। সেখানে বেশ কিছু খনি আছে। খামার ও কৃষির জন্যও এই স্টেট বিখ্যাত। প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ওকলাহমা স্টেট ফেয়ার অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের একদিন নিয়ে যাওয়া হলো স্টেট ফেয়ার দেখতে। শহরের ভিতরেই বিশাল মাঠে তাঁবু পড়েছে। সার্কাসের তাঁবুও রয়েছে। এটা হলো ফেয়ার আর কার্নিভাল। ওকলাহমার ঐতিহ্যবাহী এই মেলা।

বিশাল বড় মেলা। এখানে কৃষিপণ্য, খামারের পশুপাখি প্রদর্শিত হচ্ছে। তার পাশাপাশি আছে আদিবাসীদের অনেকগুলো স্টল। এসব স্টলে নেটিভ আমেরিকান বা রেড ইন্ডিয়ানদের তৈরি নানা রকম ঐতিহ্যবাহী সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। ড্রিম ক্যাচার তো আছেই ছোট-বড় অসংখ্য নকশা আর আকারে, আরও আছে আদিবাসীদের অলংকার, পোশাক, হেয়ার ব্যান্ড আর নানান রকম শোপিস। খেলনা আর পোশাকের স্টলেরও কমতি নেই। সেই সঙ্গে আছে মজার মজার খেলার স্টল। কোনটাতে হয়তো লক্ষ্যভেদের খেলা। তীর ছুঁড়ে ঠিক জায়গায় পাঠাতে হবে। কোনোটাতে হয়তো একটি লাঠির মাথায় রিং পরাতে হবে, কোথাও বল ছুঁড়ে লক্ষ্যে পাঠাতে হবে। কোথাও আবার জলপিস্তল দিয়ে লক্ষ্যভেদ। পুরস্কার কোথাও টেডি বিয়ার কোথাও অন্য কোনো সফট টয়েজ। সবগুলো খেলাই দারুণ মজার। ছোট বড় রঙিন তাঁবুর নিচে চলছে এসব খেলা। কোনো কোনো তাঁবুতে ভাগ্য দেখার খেলাও চলছে। বড় কাঁচের গোলক সামনে নিয়ে বসে আছে জিপসি সাজের নারীরা। তারা ওই ক্রিস্টাল গোলকে আমাদের অতীত ভবিষ্যত সব দেখে আগাম বলে দিতে পারবে।

আরও আছে অনেক রকম রাইড। একটি বিশাল ফেয়ার হুইল রয়েছে। আছে রোলার কোস্টার, নাগরদোলা, মেরি গো রাউন্ডসহ নানারকম রাইড। কোনোটি বিপজ্জনক আবার কোনোটা নেহাতই নিরীহগোছের। আমরা চড়লাম একটি রাইডে। এটি হলো বেজায় উচুঁ একটি টাওয়ারের মাথায় চড়ার মতো। কাঁচের লিফটের মতো বড় বড় প্রকোষ্ঠ রয়েছে। সেগুলোতে চড়লে ধীরে ধীরে টাওয়ারের মাথায় উঠতে থাকে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম ভয় পাবো। অত উঁচুতে চড়লে মাথা ঘুরবে। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম বেশ মজার। এত ধীরে ধীরে লিফট ওঠে যে মোটেই সমস্যা হয় না। উপর থেকে পুরো ওকলাহমা শহর দেখা যায়।

ঘাসের উপর বসে আলুভাজা খাওয়া চলছে


মজাদার আরো একটি রাইডে চড়া হলো। আমাদের শিশুপার্কের স্বপ্নপুরীর মতো অনেকটা। এরপর গেলাম কৃষিপণ্য প্রদর্শনী দেখতে। গ্রীষ্মে ক্ষেতে যেসব সবজি ফলেছে সেগুলোও রয়েছে এখানে। বিশাল আকারের সব কুমড়া দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ। ফুলকপির সাইজ কি! বেগুনও হাতি মার্কা। বেগুনকে ওরা বলে ‘এগপ্ল্যান্ট’। কিন্তু এখানে গোল বেগুনের যেমন বড় আকার তাতে অনায়াসে তাকে এলিফ্যান্ট প্ল্যান্ট বলা চলে। ভুট্টারও আকার কিছু কম নয়। টমেটোগুলো তো টেনিস বলের সাইজ। আর পেঁয়াজ এত বড় যে মনে হয় কারও মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলে নির্ঘাত মাথা ফাটবে। আলু দেখলে মনে হয় পাঁচ নম্বর ফুটবল। মনে মনে বলি, আমেরিকানরা যেমন লম্বা চওড়া তেমনি তাদের সবজি।

বিশাল মেলা। হেঁটে হেঁটে মেলা দেখছি। মজা পাচ্ছি। কিছুক্ষণ হাঁটার পর খিদে পেয়ে গেল বেজায়। আসলে কিছুক্ষণ নয়, আমরা প্রায় দুই ঘণ্টার মতো ঘুরছি এই মেলায়। কিছু খাওয়া দরকার। খাবারের স্টলের অভাব নেই। হটডগ, আইসক্রিম, আপেল পাই, স্মোকড টার্কি, স্মোকড বিফ, বার্গার, অভাব নেই কোনো কিছুর। কে কী খাবে সে বিষয়ে একমত হওয়াই মুশকিল। দশজনের দশরকম রুচি। আমি আইসক্রিম খেতে উদগ্রিব। অন্যদিকে কারও আবার গলায় ব্যথা। শেষ পর্যন্ত সাব্যস্ত হলো আলুভাজা। না ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নয়। আলুর প্যাঁচানো রিং চিপস। পুরো আলুটাই একসঙ্গে কেটে ডুবো তেলে ভাজা। আমাদের সামনেই রীতিমতো ম্যাজিক দেখানোর ভঙ্গীতে একটি আস্ত আলু নিয়ে বিশেষ এক ধরনের ছুরি দিয়ে কাটলেন বিক্রেতা। এই মোড়ানো আলুর চিপস বেশ কয়েকটা কিনে ঘাসের ওপর বসে পড়লাম হারাধনের দশটি ছেলে। দারুণ মজার ছিল সেই আলুভাজা। এক ডজন আলু নিমেষেই খতম।

সব মিলিয়ে ওকলাহমা স্টেট ফেয়ারের সেই বিকেলটি ছিল সত্যিই দারুণ! ওকলাহমায় ফুটবল খুব জনপ্রিয় খেলা। এই ফুটবল অবশ্য আমাদের ফুটবল নয়। এটি হলো আমেরিকান ফুটবল বা রাগবি। আমাদের দশজনকে একদিন লাঞ্চে নিমন্ত্রণ জানালো ওকলাহমার নারী ফুটবল টিম। সেখানে দলটির প্রধান এক চমৎকার বক্তব্য রাখলেন। তার বক্তব্যের সারমর্ম ছিল কোনো কিছুতে কখনও হতাশ হতে নেই। ফুটবলের মূল প্রেরণা শুধু দল বেঁধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে খেলাই নয়, সেই সঙ্গে নিজেও তারকার আলো নিয়ে জ্বলে ওঠা। একই সঙ্গে দলকেও জেতাতে হবে আর নিজেকেও মেলে ধরতে হবে। এই জয়ের পথে সব বাধা ডিঙিয়ে, সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়া। কখনও কখনও বাধা এড়িয়েও যেতে হয়। অনেক সময় বাধা দূর করতে গেলে সময় নষ্ট হয়। তখন বাধাকে পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। আমার কাছে মনে হয়েছিল এই কথাগুলো শুধু ফুটবল টিমের বেলাতেই নয়, জীবনের অনেক ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বাধা জয় করে এগিয়ে যাওয়া, সংগ্রাম করে টিকে থাকা আর বন্ধুদের ও নিজের জন্য জয় ছিনিয়ে আনা এটাই জীবন। আর জয়ের পাশাপাশি পরাজয়কেও মেনে নিয়ে পরবর্তী খেলার জন্য, পরবর্তী সংগ্রামের জন্য নিজেকে ফিট রাখা, মনোবল ধরে রাখাই জীবন।

ওকলাহমার পাতাঝরা দিনগুলো আমাকে সেই শিক্ষাই দিয়েছে। অনেক বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু ওকলাহমার দিনগুলো, প্রফেসর জো ফুট ও সফরসঙ্গীরা প্রত্যেকেই স্মৃতির ফোল্ডারে এখনও সজীব।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ মে ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়