ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

চর থেকে চিরসবুজের ডাকে : ৫ম কিস্তি

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৫, ১৭ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চর থেকে চিরসবুজের ডাকে : ৫ম কিস্তি

ফেরদৌস জামান: নতুন চর দেখতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসি আমাদের থাকার জায়গায়। দেখি অনেক মানুষের ভিড়ে বাড়ির কর্তার বিদায়-পর্ব চলমান। অর্থাৎ তিনি সদরে যাচ্ছেন। আমাদের দেখে তাড়াতাড়ি ব্যাগ নিয়ে বের হতে বললেন- তার সঙ্গে সদর পর্যন্ত যেতে হবে। আমাদের জন্য ভালোই হলো, দুপুর পর্যন্ত আর ট্রলারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। ব্যাগ নিয়ে ফিরে এসে দেখি তিনি বিদায় হয়েছেন। উপস্থিত একজন জানালেন, আমাদের দ্রুত ঘাটে যেতে বলেছেন। ছুটলাম ঘাটের দিকে। বিশ-পঁচিশ মিনিটের পথ যেন আর শেষ হতে চায় না। তাকে ধরতে না পারলে পরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগবে অনেক। সে বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

যাক, শেষ পর্যন্ত তাকে ঘাটে পেলাম। তিনি স্পিডবোটে বসে আছেন আমাদের অপেক্ষায়। পাশে একটি মরা গাছের শেকড়ে বসে গালে হাত দিয়ে আনমনে তাকিয়ে আছেন বাবুল চাচা। আবারও আসব বলে আশ্বস্ত করায় খুশি হয়ে বললেন, হ ভাতিজা আইবেন, যেমনে হোক এবার নিয়া যামু!

স্পিডবোট ছেড়ে দিল। কর্তা আর গত রাতের মানুষটি নন। সে যেন অন্য কেউ। পরবর্তী ঘাট পর্যন্ত কোনো কথা নেই। কালো চশমা পরে মূর্তির মতো সোজা হয়ে বসে থাকলেন। দু’একবার চেষ্টা করেও কথা বলাতে ব্যর্থ হয়ে ভাবলাম, আর একবার চেষ্টা করে দেখব কিনা? পরে অবশ্য হাল ছেড়ে দিয়ে বোটের রেলিং ধরে শক্ত করে বসে থাকলাম। ঢেউয়ের প্রচণ্ড ধাক্কায় পানি ছিটে আসছে, একেকজনের শরীর আধভেজা। মাথা মুছে ফেলার জন্য মাঝে কেবল একবার গামছা চেয়ে নিলেন। ঘাটে পৌঁছে হাত বাড়িয়ে দিলে হাতটা মিলিয়ে অপেক্ষায় থাকা মোটর সাইকেলে চেপে বিদায় হলেন।


আমরা রিকশায় চেপে বসলাম। এরপর বাস; এমনি করে ফিরে এলাম চরফ্যাশন সদরে। ইমরান ভাইয়ের অফিসে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে জেনে নিলাম চাঁদপুর যাওয়ার পথ। যেতে হবে লালমোহন উপজেলার ঘোষের হাট। সেখান থেকে বিকেলে ঢাকার উদ্দেশে লঞ্চ ছেড়ে যাবে, আর অমরা নেমে পড়ব চাঁদপুর। তারপর ভোর পাঁচটায় চট্টগ্রামের ট্রেন। ছোটবেলা থেকেই আমরা সধারণ জ্ঞানের কয়েকটি প্রশ্নের সাথে ভীষণভাবে পরিচিত- ভূস্বর্গ কোথায় অবস্থিত? পৃথিবীর ছাদ কোনটি? সূর্যদয়ের দেশ কোনটি? বাংলাদেশের স্বাস্থ্যকর জায়গা কোনটি? সেই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা পর্যন্ত প্রশ্নগুলো পিছু ছাড়েনি। আমাদের এবারের গন্তব্য উপরোক্ত প্রশ্নমালার সর্বশেষেরটির উত্তর- দেশের স্বাস্থ্যকর স্থান সাজেক উপত্যকা। এখন পর্যন্ত অনেক জায়গা ঘুরে দেখা হয়েছে, বাদ রয়েছে সাজেক। জায়গাটি অতীতের মতো দূর্গম নয়, হরদম পর্যটক যাচ্ছে। দ্রুত গিয়ে অটোরিকশায় চেপে এক ঘণ্টায় উপস্থিত হলাম ঘাটে। যাত্রী ও মালামাল বিশেষ করে ইলিশ মাছের বড় বড় খাঁচি ওঠানো হচ্ছে। সাশ্রয়ের কথা ভেবে কেবিন রিজার্ভ না করে বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধান করতে থাকি। তুলনামূলক সস্তায় প্রায় প্রতিটি লঞ্চেই এক ধরনের কেবিন মেলে যা লঞ্চের মাস্টার বা উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দ। তারা সাধারণত নিজেরা ব্যবহার না করে আমাদের মতো  যাত্রীদের নিকট ভাড়া দেন।

শত চেষ্টা করেও নাছোড়বান্দাদের আটশ টাকার নিচে নামাতে পারলাম না। বিশ মিনিটের প্রচেষ্টায় হার মেনে আটশ টাকাতেই নিতে হলো। উপর নিচে দুইটি কেবিন, ঠিক যেন বাসাবাড়ির গোসলখানার উপর ফলস ছাদ। চেয়ার দিয়ে উঠে কোনমতে শুয়ে থাকার ব্যবস্থা। বসতে গেলে মাথা লেগে যায় ছাদে। ছোট ছোট পাল্লা দুটি বন্ধ করে দিতে বলা হলো- জিনিসপত্র খোয়া যেতে পারে এই আশঙ্কায়। একে তো পাল্লা বন্ধ করে দিলে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম, তার উপর দিয়ে ছয় ফুট লম্বা সুজিতকে কবুতরের খোপের মধ্যে ধরতে চায় না। নিরুপায় হয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে ওপর তলায় উঠে ডেকের খোলা জায়গায় চেয়ার নিয়ে বসলাম। মুগ্ধ চোখে দেখছি দু’পাশের সবুজ-শ্যামল জনপদ। চরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল ধরে এগিয়ে যেতে যেতে প্রায় প্রতিটি ঘাট থেকেই যাত্রী উঠতে থাকল। দামাল শিশুর দল লঞ্চের কাছে হার মানতে নারাজ। নদী দিয়ে লঞ্চ আর ডাঙ্গার পাশে বৃক্ষময় পথ দিয়ে তাদের দৌড়। কে আগে যেতে পারে! কিছু কিছু জায়গায় ঘাট নেই কিন্তু যাত্রী ওঠানামা ঠিকই চলে। তারা ট্রলারে বোঝাই হয়ে মাঝ নদীতে এসে লঞ্চে ওঠে।


বেলা ডুবতে শুরু করল। বাতাস ঠান্ডা হতে হতে কাঁপন ধরিয়ে দেয়ার পর্যায়ে পৌঁছে গেল। তবুও রেলিং ধরে বসে থাকতে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ বসে থাকি। লঞ্চ এখন অথৈ জলের মেঘনার বুকে সাঁতার কেটে এগিয়ে চলছে। গায়ে পরে একজন এসে কথার ঝাপি খুলে বসলেন। তার প্রতি সম্মান রেখেই কয়েকবার বোঝাতে চেষ্টা করলাম- কথা বলার চেয়ে চুপচাপ বসে থাকতেই ভালো লাগছে। কিন্তু কে শোনে সে কথা! এই চরের হরিণের মাংস খুব টেস্ট, তো ঐ চরে এত বড় অজগর আছে যা আস্ত মানুষ গিলে ফেলতে পারে, বন্ধুবান্ধব মিলে প্রতি দুই আড়াই মাসে হরিণের মাংস না খেলে তাদের চলেই না ইত্যাদি প্যাঁচাল। এক পর্যায়ে কায়দা করে লোকটিকে আমার নিকট সপে দিয়ে সুজিত চম্পট দিল। হু, হা, জি বলে চালিয়ে নিতে হলো। ওদিকে তার বিরতিহীন রেডিও চলমান। সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে তালি, তুড়ি এবং রেলিং-এর পাইপে কষে দুই-একটি করে থাপ্পর চলতে থাকল। চল্লিশ-পয়তাল্লিশ মিনিট পর সামান্য একটু ফাঁক পেতেই কেটে পরলাম। না হলে বোধহয় রাতটাই পার করে দিত! কেবিনে ফিরে দেখি সুজিত জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে রয়েছে যেন পাগলের ধাওয়া খেয়ে পালিয়েছে। চাঁদপুর পৌঁছুতে রাত তিনটা বেজে যাবে। আগের রাতে পর্যাপ্ত ঘুম হয়নি। পরের দিনটিও পেরিয়ে যাবে জার্নিতে। সুতরাং কষ্ট করে হলেও দুই-তিন ঘণ্টা ঘুমিয়ে নেয়া দরকার।

সময়মত চাঁদপুর নেমে রিকশায় যেতে হলো রেলস্টেশন। শেষ রাতের স্টেশন রোড যেন আমাদের রিকশার ঘটর ঘটর শব্দেই জেগে উঠবে। স্টেশনে হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন মানুষ, বসে বসে ঝিমুচ্ছে। আবার কিছু মানুষ হেঁটে বেড়াচ্ছে, তো কেউ চায়ের দোকানে বসে চা পানে ব্যস্ত। ছোট্ট স্টেশনটিতে ভোর পাঁচটা বাজার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেন। লাঠি আর টর্চলাইট হাতে দুই পুলিশ পায়চারী করছে স্টেশনের এমাথা-ওমাথা। টিকিট কাউন্টার বন্ধ, কখন খোলা হবে কেউ বলতে পারে না। আগস্ট মাসের রাতেও হালকা শীতের ভাব। দূরে ফাঁকে ফাঁকে দুই-তিনজন করে মানুষের জটলা, দেখে মনে হবে বড় কোনো অপকর্মের পরিকল্পনা চলমান। প্রকৃতপক্ষে একেক জটলায় একেক বিষয়ের সাধারণ কথাবার্তা। মালামাল ওজন করার যন্ত্রটির পাটাতনে বসে ঝিমুচ্ছে ময়লা কাপড় পরা উস্কো চুলের যুবক। কে জানে ঘর বিবাগী যুবকের এটিই হয়তো রাতের নিবাস। লোকজন ক্রমেই বাড়ছে। পুলিশ সাহেব নিজ থেকেই বললেন, একটু পরেই কাউন্টার খুলবে। সবাই লাইনে দাঁড়ান।


তার কাছে জানতে চাইলাম, চট্টগ্রামের দূরত্ব এবং ভাড়া কত? সবকিছু জেনে বললেন, খাগড়াছড়ি যেতে শুধু শুধু চট্টগ্রাম যাওয়ার দরকার নেই। তার চেয়ে বরং ফেনি নামলেই সুবিধা হবে। সেখান থেকে খাগড়াছড়ির বাস মিলে যাবে। তার পরামর্শে চট্টগ্রামের পরিবর্তে ফেনির টিকিট কাটলাম। ফেনি পরিচিত স্টেশন। এর আগেও দুইবার গিয়েছি। টার্মিনালে গিয়েই বাস মিলে গেল। বাস ছুটতে শুরু করল। আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করলাম উঁচুনিচু টিলাময় ফটিকছড়ি উপজেলায়। মাটিরাঙ্গা পেরিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পথ উঠতে থাকল আলুটিলা পাহাড়ে। যে আলুটিলা পাহাড়ে মেঘের খেলা নিত্যদিনের বিষয়। পাহাড়ের তলদেশ দিয়ে রয়েছে একটি চমৎকার গুহা। চাইলেই ভেতরে গিয়ে আদিম যুগের অনুভূতি নিয়ে ফিরে আসা যায়।

সেখানে আরও রয়েছে তেরাং তৈ কালাই নামক নয়নাভিরাম ঝরনা। অল্প পরিশ্রমেই যাওয়া যায় দেশের এমন ঝরনার তালিকায় এটি একটি। সারা বছরই পানি থাকে। ক্রমেই আমাদের বাসটি হারিয়ে গেল আলুটিলা পাহাড়ের ঘন সবুজ অরণ্যের মাঝে। উপর থেকেই দেখা যায় উপত্যকা শহর খাগড়াছড়ি। পাহাড় পেরিয়ে খানিক এগিয়েই শহর। মনের মধ্যে নানান স্বপ্ন ও ভাবনা সেখান থেকেই গাঁথা শুরু হতে থাকে- কেমন হবে সাজেকের পথ, কতটা উঁচু, কেমন সেখানকার মানুষ, কী তাদের জাতিসত্তা বা পরিচয়? সেখানে নাকি মেঘ নেমে আসে ঘরের ভেতর, দৃষ্টিসীমা ছাড়িয়ে শুধু পাহাড় আর পাহাড়! এখন অপেক্ষার পালা- কখন গিয়ে পৌঁছুব দেশের সর্বাপেক্ষা স্বাস্থ্যকর জায়গা সাজেক উপত্যকায়?




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ মে ২০১৭/তারা  

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়