এই সেই বদমাশ!
সহকর্মীর সঙ্গে লেখক (ডানে)
(লক্ষ্মণরেখার বাইরে-২৫)
শান্তা মারিয়া: শ্রীলঙ্কা গিয়েছিলাম ২০০৬ সালের মার্চ মাসে। আগের পর্বগুলোতে সে-দেশে যাওয়ার কারণ বলেছি। সুতরাং নতুন করে আর বললাম না। শুধু এটুকু স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি- বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিলাম আমরা ১১৪ জন। আমাদের হোটেলে রুম শেয়ার করে থাকতে হয়েছিল। আমি আর সাংবাদিক আংগুর নাহার মন্টি ছিলাম একটি ডাবল বেডরুমে। হোটেলে উঠেছে অন্য কোনো দেশের একটি বাস্কেটবল দলের সদস্যরা। শ্রীলঙ্কার বাস্কেটবল দলও আছে ওখানে। আরও আছে বিভিন্ন দেশের অনেক শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ। আমাদের রুমের আশপাশের রুমে কয়েকজন বিদেশি চোখে পড়লো। রুমে ঢোকা ও বের হওয়ার পথে এক কৃষ্ণবর্ণের তরুণকেও দেখলাম।
যেদিন পৌঁছেছি তার পরদিন রাতের ঘটনা। আমাদের রুমের টেলিফোন বেজে উঠলো। ফোন ধরলাম। ওপাশে রহস্যময় পুরুষকণ্ঠ। আমার নাম জানে এবং আলাপের ইচ্ছা। কথা হচ্ছে ইংরেজিতে। লোকটি তার নিজের নাম বলছে সিমন। জানি না এটা কোন দেশী নাম। তবে বাঙালি নয় বুঝতে পারছি। কারণ বাঙালি অ্যাকসেন্টে ইংরেজি নয়। একটু অন্য ধাঁচের অ্যাকসেন্ট। সে নিজের পরিচয় দিচ্ছে বাস্কেটবল টিমের সদস্য বলে। আমাদের রুমে আসতে চায়। অচেনা অজানা মানুষকে তো রুমে আসতে বলার প্রশ্নই ওঠে না। মন্টি আর আমি দুজনেই একটু একটু করে আলাপ চালাচ্ছি। আমাদের জানার ইচ্ছা লোকটি কে। আমাকে নাকি সে সকালে ডাইনিংয়ে দেখেছে, শাড়ি পরা। দেখে মুগ্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি।
ফোন রেখে আমরা দুজনেই কিছুক্ষণ হাসাহাসি করলাম। পরদিন সকাল থেকে আমাদের অনুষ্ঠান শুরু। বিহারা মহাদেবী পার্কে। প্রত্যেকেরই প্রচুর ব্যস্ততা। এর মধ্যেই এক ফাঁকে পার্থদাকে ঘটনাটি জানালাম। পার্থ হলেন অক্সফ্যামের কর্মী। তিনি আমরাই পারি জোটের সদস্য। আখতার ভাইও শুনলেন। দুজনেরই অভিমত হলো, কোনো ফচকে লোক রসিকতা করছে। যা হোক বললেন, আবার যদি ফোন করে তাহলে তাকে বলবেন কাল সকালে ডাইনিংয়ে আসতে। ওখানে আমরা একশ চৌদ্দজন বাঙালি আছি। বদমাশটার হাড় গুঁড়ো করে দেব।
সারাদিন অনুষ্ঠানের পর ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরেছি। বুফে ডিনার। ডিনার হলে আমরা ছাড়া অন্য কয়েক দেশের বিদেশীরা রয়েছে। এদের মধ্যে কে যে আমাদের ফোনকর্তা বুঝতে পারছি না। ফলে সন্দেহ হচ্ছে প্রত্যেককেই। বিশেষ করে আমাদের সন্দেহ, লোকটি হয়তো শ্রীলঙ্কারই অধিবাসী। হোটেলের রেজিস্টার থেকে নাম ধাম জেনেছে। খাওয়ার পর সংক্ষিপ্ত আলোচনা হোটেলের লবিতে। কালকের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সেশন রয়েছে। সে বিষয়ে কথাবার্তা হলো।
যাই হোক, রুমে ফিরে মাত্র একটু রিল্যাক্স করছি এর মধ্যে ফোন। আবার সেই লোক। জিজ্ঞাসা করলাম তুমি কি শ্রীলঙ্কান? জবাব ইতিবাচক। তাহলে তো আমরা ঠিকই অনুমান করেছি। পার্থর পরামর্শ অনুসারে বললাম, তুমি কাল সকালে হোটেলের ডাইনিংয়ে আসো। সেখানে তোমার সঙ্গে আলাপ হবে। আচ্ছা বেশ। অনেক ধানাইপানাই করে সে রাজি হলো। ফোন রেখে দিয়ে আমরাও মুচকি হাসলাম। কাল সাইজ করা যাবে ওই বদমাশকে। রাতে দুজন মিলে ভেবে ঠিক করলাম, ব্যাটাকে কিভাবে তুলোধুনো করা হবে তা নিয়ে। তারপর দিলাম ঘুম।
সকালে সাড়ে সাতটার দিকে আমরা ডাইনিংয়ে হাজির। আমাদের টেবিলে আটজন আছেন। তাদের সবাইকে ঘটনাটা বলেছি। আমাদের টেবিলে আছেন শিল্পী রেজাউর রহমান রেজাভাই, ফাওজিয়া খন্দকার ইভা আপা, পার্থ, আখতার ভাই এবং আরও দুজন। আমরা অপেক্ষা করছি। এর মধ্যে ইভা আপা একটি কালো যুবকের দিকে ইঙ্গিত করে আমাকে ফিশফিশ করে বললেন, ওই যে, মনে হচ্ছে ওই লোকই কালপ্রিট। আমিও তাকিয়ে দেখলাম। মাঝারি উচ্চতার কালো যুবক। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। চোখে সানগ্লাস। পরনে ফুলকাটা প্রিন্টের শার্ট আর জিন্স। দেখেই বোঝা যায় একটা বদমাশ। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজছে। একটু পর সে এগিয়ে আসতে লাগলো আমাদের টেবিলের দিকে। রেজা ভাই উল্টোদিক ফিরে থাকায় লোকটিকে দেখতে পাননি। কিন্তু তিনিও আমাদের কথা শুনে ওকে পেটানোর জন্য রীতিমতো রেডি। পার্থ বললো, ওর মাথায় পানি ঢালা হবে প্রথমে। তারপর মাইর।
লোকটি দ্রুত পদে আমাদের টেবিলের বেশ কাছে চলে এসেছে। আমরা তৈরি। এর মধ্যে রেজা ভাই ঘুরে দাঁড়িয়ে লোকটিকে দেখে হইহই করে উঠলেন। আরে শুভ, তোর না কাল আসার কথা ছিল।
এই লোক হচ্ছেন রেজা ভাইয়ের শ্যালক। তিনি থাকেন শ্রীলঙ্কাতেই। তার স্ত্রী এখানকার মেয়ে। তার স্ত্রী ও শাশুড়ি বিউটি পার্লারের মালিক। সব শুনে শুভ ভাই বললেন, কি সর্বনাশ! আমাকে দেখে কি এত বদমাশ বলে মনে হয়? আর আমার গায়ের রং এতই কালো যে শ্রীলঙ্কান ভেবে ভুল করলেন? আমরা ভীষণ লজ্জিত। ভাগ্যিস রেজা ভাই ছিলেন। নইলে যদি সত্যিই ওর মাথায় পানি ঢালতাম, তাহলে?
সেদিন রাতে আবার সেই রহস্যময় ফোন পেলাম। বললাম, ‘ইউ ডিডনট অ্যাপেয়ার ইন দ্য মর্নিং। জবাবে তার বক্তব্য হলো, সকালে তোমরা অনেকজন বাঙালি এক জায়গায়। ওখানে যেতে আমি শাই ফিল করেছি। বুঝলাম আমাদের মতলব সে ধরে ফেলেছে।
হেনতেন অনেক কথা। এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি, যতদিন শ্রীলঙ্কা ছিলাম ওই লোকের সাথে আমাদের শেষ অবধি দেখা হয়নি। রহস্যময় কণ্ঠস্বরের অধিকারী কে জানা হয়নি। তবে শুভ ভাইয়ের সঙ্গে আরও দেখা হয়েছে। তাকে বিদেশি বদমাশ ভাবার জন্য প্রতিবারই তিনি আমাদের সঙ্গে মজা করতেন।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ আগস্ট ২০১৭/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন