ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আনন্দ মনে নেপালে

ইমরান মাহফুজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৯, ২৫ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আনন্দ মনে নেপালে

ইমরান মাহফুজ : আনন্দের জন্য পৃথিবী । আনন্দ করতে হলে ঘুরতে হবে। পাখি হয়ে ঘুরে বাড়োনো আমার স্বভাব। একটু ফুসরত পেলেই হাওয়া। গ্রাম কিংবা শহর কোথাও নেই দ্বিধা। সাধ্যের মধ্যে করি জীবনানন্দ ফেরি। অনুপ্রেরণা পাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মানস ভ্রমণ’ কবিতায়: ইচ্ছে তো হয় সারাটা জীবন/এই পৃথিবীকে/এফোঁড়-ওফোঁড় করে যাই দুই/পায়ে হেঁটে হেঁটে অথবা বিমানে’। আমিও গত ১৩ এপ্রিল দুপুরে বাংলাদেশ বিমানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যেতে যেতে একলা পথে’ চলি। আর মনে করি কবি গুরুর ঘুরে বেড়ানোর দারুণ নেশাকে। প্রচুর ভ্রমণ করেছেন বিশ্বকবি। ট্রেন, জাহাজ, নৌকায়, পালকি কিংবা গরুর গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশে-বিদেশে।

আমরা যারা সৃজনসংসারে মানুষ, ভ্রমণ আমাদের মনোমন্দিরে সব সময় উঁকি দেয়। তবে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে বিদেশ বলতে প্রথমেই যে নামগুলো মনে আসে- ভারত, নেপাল ও ভুটান। নেপাল তাদের মধ্যে অন্যতম। (একমাত্র ভারতীয়দের জন্য পাসপোর্ট-ভিসার কোনো ঝামেলা নেই, কেবল নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে সচিত্র কোনো পরিচয়পত্র প্রয়োজন ) পাসপোর্ট যেহেতু করা আছে আমিও বেছে নিলাম নেপাল। তাছাড়া খরচও আয়ত্তের মধ্যে, যাকে বলে সাধ্যের মধ্যে সাধপূরণ। কবি আশিক রেজার আন্তরিক সহযোগে জীবনের প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে তাই নেপালকেই বেছে নিয়েছিলাম। সাংবাদিক কাজল রশীদ শাহীন ভাই ব্যস্ততার কারণে, বন্ধু দেলোয়ার জাহান অসুস্থতার জন্য যেতে পারেনি। সেখানে যে জায়গাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেছি সে কথা এখন বলছি-

স্বাগতম ত্রিভুবন: পাসপোর্ট-টিকিট এসব কাগজ ঠিক থাকায় ঝামেলা হয়নি এয়ারপোর্টে প্রথমবার দেশের বাইরে যাওয়া, স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা এক্সাইটেড ছিলাম। সেই সাথে এয়ারপোর্ট পুলিশ জানতে চাইলো কেন যাচ্ছি? কার কাছে যাচ্ছি? বলার পর তারা স্বাভাবিকভাবেই শুভ কামনা জানাল। চেকিং শেষে প্লেনে উঠি। প্লেন ঠিক সময় থেকে ৩০ মিনিট দেরিতে ছাড়লো। একজন যাত্রী আসতে দেরি হওয়ায় এই বিলম্ব। খেসারত দিতে হলো নেপাল ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে প্লেন স্টে করতে ১ ঘণ্টা লেইট।

ঢাকা থেকে আকাশে ওড়ার কিছুক্ষণ পর দুপুরের খাবার দেওয়া হয় বাংলাদেশ বিমানের পক্ষ থেকে। খেয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখলাম- এতো সুন্দর সব কিছু ছবির মতো! দেখতে দেখতে কাঠমান্ডুর কাছাকাছি এসে বিমানের ক্যাপ্টেন জানালো, নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে জ্যাম আছে। বাধ্য হয়ে আরও প্রায় ১ ঘণ্টা আকাশেই! ঢাকা থেকে যখন উড়াল দেই, তখন জানানো হয় যাত্রার সময় থেকে আনুমানিক দেড় ঘণ্টা। এখন তা দাঁড়াল প্রায় আড়াই ঘণ্টায়।

অবশেষে পাখির মতো উড়ে নামলাম ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে। নেমে একটা সেলফি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখি আশিক ভাই হাসি মুখে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনার জন্য। তাকে নিয়ে ভিসা-সংক্রান্ত কাজ সেরে বিমানবন্দর থেকে যখন বাইরে আসি, তখন সূর্য হেলে পড়ছে। হালকা ঠান্ডাও অনুভব করলাম। গরম পোশাক পরে আশিক ভাইয়ের অফিসের গাড়িতে উঠি। উদ্দেশ্য কাঠমান্ডুর থামেলস সার্ক সচিবালয়। ট্যাক্সিতে দুজনই বেশ আনন্দে দেশের খোঁজ-খবর নিতে দিতেই অফিসে আসি। সেই সাথে জানলাম- নেপালের সংস্কৃতিতে কারো সঙ্গে দেখা হলে প্রথমে প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাত জোর করে নমস্তে বা নমস্কার বলতে হয়। যদি কোনো প্রবীণকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে হয়- তবে নারীর ক্ষেত্রে দিদি এবং পুরুষের ক্ষেত্রে দাই সম্বোধন করতে হবে। নেপালে পায়ে ধরে সম্মান দেখানোর কোনো রীতি নেই।

নাগরকোট: বেলা প্রায় তখন ৪টা। দুপুরের খাবার খেলাম। মিনাশিক ভাবি খুবই চমৎকার রান্না করেন। এমন ভোজে প্রায় সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। বেলা গড়াতে আমরা প্রস্তুতি নিলাম পহেলা বৈশাখ উৎসব অংশগ্রহণ করতে নাগরকোটে যাওয়ার। বলে রাখা ভালো- আমাদের দেশের বাংলা সনের সাথেই তাদের দেশেরও মিল আছে। ফলে আনন্দে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সে জন্যে আমরা যথারীতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নাগরকোটের উদ্দেশ্যে মাইক্রোতে রওনা হলাম।



২০১৫ সালের ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত স্থাপনা দেখতে দেখতে কাঠমান্ডু শহর পার হতেই সূর্য সেদিনের মতো বিদায় জানালো। আমরা হাওয়ায় উড়ছি। মাঝে মাঝে রাস্তার অবস্থা দেখে চক্ষু চড়কগাছ। এইভাবে গাড়ি চললো প্রায় ৪ ঘণ্টা। কিন্তু তবুও গন্তব্যে পৌঁছতে পোরলাম না। নির্ধারিত হোটেল খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। এখানকার মানুষ কেউ কারো খোঁজ রাখে না। প্রত্যেকে নিজের কাজে ব্যস্ত। চারদিকে সবুজে ঘেরা পাহাড়, সাথে চুলকালো অন্ধকার।

তবে নাগরকোট যাবার পুরোটা পথ পাহাড়ি আঁকাবাঁকা, সবুজে ঘেরা। মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম। কিছুটা মিল পেলাম আমাদের বান্দরবান-এর নীলগিরি যাবার পথটার সাথে। সারি সারি উঁচু পাহাড়ের মাঝখানে আঁকাবাঁকা পথ। একপাশে বাড়ি অন্য পাশে পাহাড় এমন দৃশ্যে চমৎকার লাগছিল! দারুণ এ পারস্পরিক মিল, পাহাড়, পথ আর লেকের মাঝখানে একবার হোটেলে থামল কিছুক্ষণের জন্য।

দীর্ঘ সময় পার হয়েও হোটেল না পাওয়ায় ভয় ভয় লাগছে। অবশেষে দুই জোয়ানের সহযোগিতায় ‘নাগরকোট হিলসাইড ভিলেজ রিসোর্টে’ এসে উঠলাম। আর হোটেল দেখেই আমাদের কি আনন্দ! প্রায় সারারাত অনেক মজা আর বিভিন্ন স্বাদের খাবারে ব্যাপক কেটেছে বছরের শুরুটা। হোটেল থেকে নিচে তাকাতেই পাহাড়ের মাঝে মাঝে অচেনা অনেক দারুণ গাছের সমাহার। পুরো জায়গাটা মন মাতোয়ারা করে রাখল। সত্যি অনন্য সেখানকার প্রকৃতি।

আমরা অনেক উচ্চতায় উঠে গেছি, মোবাইল এ্যাপসের মাধ্যমে জানলাম প্রায় ২৮০০ ফিট উপরে। ওখান থেকে চারপাশের ভিউ দেখে রেজাভাইসহ বলে উঠলাম ‘ওয়াও।’ এখানকার হিমালয়ের সর্বোচ্চ শিখরের নাম প্যানরোমা। হিমালয়ের আরো কিছু চূড়া যেমন- মানাস্লু, গণেশ হিমেল, লেঙ্গান, গৌরীশঙ্কর নাগরকোট থেকে স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

আমরা ভোর-রাতেই গাড়িতে চলে গেলাম পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে। সূর্য ওঠার সময় অপার্থিব সোনালি আভা যখন প্রকৃতি আর মন ছুঁয়ে যায়, তখন সত্যিই মনে প্রশ্ন ওঠে-  যাপিত জীবনে এতো এতো হিংসা বিদ্বেষ কেন করি?

চিতওয়ান ন্যাশনাল পার্ক: একরাত দুইদিন পর বাসায় এসে ভোর ৬টার আগেই চলে গেলাম রত্নপার্ক হয়ে থামেলস্থ ট্যুরিস্ট বাস স্পটে। বাস ছাড়বে ৬-৩০-এ। আমরা যাবো নেপালের দক্ষিণাঞ্চলের চিতওয়ান ন্যাশনাল পার্কে। সেখানে দেখা মিলবে রয়াল বেঙ্গল টাইগার এবং এক শিং বিশিষ্ট বিরল প্রজাতির গন্ডারসহ নানান ধরনের প্রাণী। উদ্ভুত এক রোমান্সে সরাসরি দেখা যাবে-  ৩৬০ বর্গমাইলের চিতওয়ান ন্যাশনাল পার্ক। এটি ত্রিশূলী নদীকে বাঁ দিকে রেখে সবুজ পাহাড়ের শরীর বেয়ে কাঠমান্ডু থেকে নামতে নামতে প্রায় মাটির কাছে আসছে। নেপালের প্রথম এই ন্যাশনাল পার্ক ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত।



যেতে যেতে প্রায় দুপুর একটা বেজে গেলো। সবুজ অরণ্যে বাস স্টপেজ। যেন একখণ্ড বাংলাদেশ। এখানকার একটা বিশেষত্ব হচ্ছে- মূল শহরের বাইরে যানবাহন রাখার স্থান, আর এতে পর্যটকদের গাড়ির শব্দে কোনো রকম বিরক্তি আসে না। তাছাড়া নেপালে তো গাড়ির হর্ণ দেওয়ার নিয়মও নেই। আমরা হোটেলের গাড়ি করে হাওয়ায় নাচতে নাচতে চলে গেলাম চিতওয়ানের বুকে।

বিকালে লেকের ধারে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-প্রাণীর পরিচয় দিলো গাইড। এখানকার প্রত্যেকটি বিষয় এমন গোছানো যা আমাদের গ্রহণীয়- কিভাবে সবুজ বনায়নসহ প্রকৃত সৌন্দর্যকে ইকো টুরিজমের আওতায় আনা যায়। সত্যি ভাবনার বিষয়। চারদিক মুগ্ধকর সবুজ, আর তাছাড়া নেপাল মানেই এক ধরনের রহস্যময়তা। যেভাবে মিহি কুয়াশার চাদর এখানকার মখমলে পাহাড়ের শরীরকে কখনও আড়ালে, কখনও গোপনে, কখনও চোখের সামনে এনে ফেলে, ঠিক সেই রহস্যময়তাই যেন ছেয়ে আছে সারা কুমারী মাতার শরীরজুড়ে!

পরদিন সকাল আটটায় বের হলাম। ‘জঙ্গলের হৃদয়ে’ হাতি আর হাতি- এতো হাতির কথা শুনে চমকে ওঠার কিছু নেই। কারণ এই জঙ্গলের একমাত্র বাহন এই হাতিই। হাতি সম্পর্কে অনেক কিছু জানা গেছে গাইডের আলোচনায়। এবার শুরু আশিক ভাইয়ের পরিবারসহ ‘জঙ্গল সাফারি’। হাতির পিঠে ঘন জঙ্গলে দু’ঘণ্টার অ্যাডভেঞ্চার। চিতওয়ানের জঙ্গলে মাছির মতো ভিড় গন্ডার আর হরিণের। ওখানে পরিচয় হলো এক ভারতীয় পরিবারের সাথে। বেশ মজায় সময়টা কাটলো। ‘রাপ্তি’ নদীতে গোসল করলাম জলের অনুভবে। দুপুরের খাবার বেশ উপভোগ্য মনেই খেলাম।

তারপর ক্যানো রাইডিং। ‘রাপ্তি’ নদীতে জঙ্গলের গা ঘেঁষে ক্যানোয় চরে বয়ে যাওয়া। জঙ্গলে পাখি দেখার এ এক সুবর্ণ সুযোগ। বহু প্রজাতির পাখির মিলন মেলা এই অঞ্চলে। মাঝে মাঝে দেখা যায় কুমির। সেই সাথে চিতওয়ানেই মিলেছে পৃথিবীর অন্যতম হাতি প্রজননকেন্দ্র। বলে রাখা ভালো পৃথিবীতে হাতি প্রজনন কেন্দ্র একেবারেই হাতে গোনা।

এমন মজার দৃশ্যে চিতওয়ান ন্যাশনাল পার্কে থেকে যেতে ইচ্ছা করবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। উল্লেখ্য যে, এই পার্কটি হলো পর্যটকদের জন্য নেপালের প্রধান আকর্ষণ এবং তা ইউনেস্কোর বিশ্ব উত্তরাধিকার তালিকার অন্তর্ভুক্ত। দুই হাজার আট সালের এক হিসাব অনুযায়ী, চিতওয়ানে দেখা যায় চারশ আটটি গন্ডার।

ভক্তপুর: চিতওয়ান ন্যাশনাল পার্ক থেকে এসে গেলাম প্রাচীন রাজাদের আবাসস্থল ভক্তপুর ও পশুপতিনাথ মন্দির। এক সময়ের নেপালে রাজধানী ছিল ভক্তপুর। যেটি বর্তমানে কাঠমান্ডু থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানে প্রবেশ মূল্য আমাদের থেকে রাখা হয়েছে জনপ্রতি ৫০০ নেপালি রুপি। আর নেপালিদের ইতিহাসে আগ্রহী করতে কোনো মূল্য নেওয়া হয় না। যে চিন্তাটি চাইলে বাংলাদেশ গ্রহণ করতে পারে।

এই শহরটি মধ্যযুগীয় শিল্প-সাহিত্য, কাঠের কারুকাজ, ধাতুর তৈরি মূর্তি ও আসবাবপত্রের যাদুঘর বলে পরিচিত। শহরটিতে বৌদ্ধ মন্দির ও হিন্দু মন্দিরের অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায়। ৫৫টি জানালা সমৃদ্ধ রাজপ্রাসাদ ও তার অপূর্ব কারুকাজ নেপালের ঐতিহ্য বহন করে। বেশ কিছু ধর্মীয় উপাসনালয় রয়েছে এখানে। প্রাচীন কৃষিভিত্তিক জীবনযাত্রার ছোঁয়াও এখানে পাওয়া যায়। এখানকার স্থানীয়রা এখনও কাঠমান্ডু ভ্যালির অনেক আবাদি জমিতে ফসল ফলায়। এর চিহ্ন মিলে, স্থানীয়দের বাড়ির জানালায় ঝুলে থাকা খড়ের ব্যবহারে। আমরা দেখার সাথে এসবের কিছু ছবি নিলাম অনুমতি নিয়ে। দায়িত্বে থাকা লোকজন দর্শনার্থীদের আন্তরিক সহযোগে সব সময় থাকে, যা বলার মতো। তবে কেনাকাটায় একটু খেয়াল রাখতে হবে!

পশুপতিনাথ মন্দির: ১৮ এপ্রিল এখান থেকে যোগ হলো আমারদের যাত্রায় কবি জামসেদ ওয়াজেদ। গেলাম পশুপতিনাথ মন্দিরে।  কাঠমান্ডু শহরের পূর্বদিকে বাগমতি নদীর তীরে মন্দিরটি অবস্থিত। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও বিখ্যাত এই শিবমন্দির ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। এটি এই দেশের প্রাচীনতম হিন্দু মন্দির। বলা হয় হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান দেবতা শিবের আরেক নাম পশুপতি। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মন্দির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে বিভিন্ন পৌরাণিক প্রচলিত কাহিনিতে বলা হয়েছে একবার শিব ও পার্বতি কাঠমান্ডু উপত্যকায় বাগমতী নদীর তীরে বেড়াতে আসেন। নদী ও বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে শিব-পার্বতী মুগ্ধ হয়ে নিজেদের হরিণে পরিণত করে এই এলাকায় ঘুরে বেড়ানো শুরু করলেন। কিছুদিন পরেই দেবতা ও মানুষ শিবকে খুঁজতে শুরু করলেন। বহু পরে দেবতারা শিবকে খুঁজে পেলেও তিনি এই স্থান ত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। শেষ পর্যন্ত শিব ঘোষণা করলেন যেহেতু তিনি বাগমতীর তীরে হরিণ বেশে ঘুরেছেন সেহেতু তিনি এখানে পশুপতিনাথ বা পশুদের অধিকর্তা বলে পরিচিত হবেন। আর তাই হলো।



দেখা যায় পশুপতিনাথের মূল মন্দিরটি নেপালের প্যাগোডা রীতিতে তৈরি। কৌণিক গঠন, কাঠের কারুকার্য এ সবই নেপালের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যরীতির অংশ। মন্দিরটি চারকোণা। একস্তর বিশিষ্ট ভিত্তিভূমির ওপর স্থাপিত মন্দিরটি ভূমি থেকে ২৩.৬ মিটার উঁচু। মন্দিরটির গায়ে সোনা ও রূপার কারুকাজ করা। হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি খোদাই করা হয়েছে মন্দিরের দেয়ালে।  দু'স্তর বিশিষ্ট ছাদ তামার তৈরি তাতে সোনার প্রলেপ দেওয়। মন্দিরটির চারটি প্রধান দরজা। চারটি দরজাই রূপা দিয়ে মোড়া। প্রতিটি দরজার দু'পাশে সোনা দিয়ে প্রধান দেবদেবীদের মূর্তি তৈরি করা হয়েছে। মন্দিরের ভিতরে রয়েছে একটি পবিত্র কক্ষ। এখানে একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে। এটি একমিটার দীর্ঘ ও চতুর্মুখ। এই চারটি মুখ শিবের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কিত চার দেব বিষ্ণু, সূর্য, পার্বতী ও গণেশের। মন্দিরের চূড়া সোনার তৈরি। পশ্চিম দরজার সামনে রয়েছে একটি বিশাল ষাঁড়ের মূর্তি যার নাম নন্দী। নন্দী মূর্তিটি ব্রোঞ্জের তৈরি সোনার প্রলেপ দেওয়া। মূল শিবলিঙ্গটি কালোপাথরে তৈরি ৬ ফুট দীর্ঘ। মন্দিরের ছাদের নিচের দেয়ালে সপ্তদশ শতাব্দীতে কাঠের অপূর্ব কারুকার্যের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে শিব, পার্বতী, গণেশ, কুমার কার্তিক এবং যোগিনীদের মূর্তি। এছাড়া রয়েছে হনুমান, রাম, সীতা, লক্ষ্মণসহ রামায়ণের বিভিন্ন চরিত্র ও পুরাণের বিভিন্ন কাহিনি ও দেবদেবীর ছবি।

মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা বাগমতী নদী- হিন্দু ও বৌদ্ধ দুই সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেই পবিত্র। পুণ্যার্থীরা এই নদীতে স্নান করেন। দেখলাম- এজন্য নদীর দু'তীরে রয়েছে অনেক ঘাট। লেখা আছে- এর মধ্যে উনিশ শতকে প্রতিষ্ঠিত আর্য ঘাট বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এ ঘাটে শুধুমাত্র নেপালের রাজপরিবারের সদস্যদের মরদেহ দাহ করা হতো। নদীর তীরে গেলেই দেখা যায় সারি সারি চিতা জ্বলছে। গৌরি ঘাট হলো নারীদের স্নানের জন্য বহুল ব্যবহৃত ঘাট। মন্দির তার অপূর্ব শৈল্পিক কারুকার্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিশ্ব বিখ্যাত। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক দেখতে আসছে। মানুষ আর মানুষ যেন মিলন উৎসব!

(আগামী পর্বে সমাপ্য)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়