ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

যদি হয় প্রথম বান্দরবান ভ্রমণ

ইসতিয়াক হোসেন: || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যদি হয় প্রথম বান্দরবান ভ্রমণ

ইসতিয়াক হোসেন: বাংলাদেশের পাহাড়কন্যা বান্দরবান প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এক স্থান। চারপাশে যতদূর চোখ যায় অবারিত সবুজের সমারোহ। হাত বাড়ালে মাথার ওপর যেন মেঘের আনাগোনা।

বান্দরবান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। এটি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অন্তর্গত। চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবান জেলার দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার। মারমা রাজা বোমাংগ্রী উ চ প্রু বান্দরবান সার্কেলের বোমাং রাজা। এই অঞ্চলের অন্য দুটি জেলা হলো রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি। বান্দরবান জেলার নৈসর্গিক বৈচিত্র্যের জন্য বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

লোককথা অনুযায়ী, এই অঞ্চলে বানর একে অপরের হাত ধরে, লম্বা শিকল বানিয়ে নদী পারাপার করত। বানরের বাঁধ থেকে ‘বান্দরবান’ শব্দের উৎপত্তি। এই অঞ্চলের রাজা, তথা সার্কেল চিফ এখনো কর (নামমাত্র) আদায় করেন। প্রতিবছর ঘটা করে ৩ দিনব্যাপী পুণ্যাহ’র মাধ্যমে (নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে) এই কর বা খাজনা আদায় করা হয়।

কী দেখবেন
নীলগিরি: বান্দরবান জেলা সদর থেকে ৪৭ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্ব দিকে লামা উপজেলার অংশে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২০০ ফুট উপরে বাংলাদেশের নতুন পর্যটন কেন্দ্র নীলগিরির অবস্থান। জায়গাটিকে অনেকে ‘বাংলাদেশের দার্জিলিং’ বলেন। যেখানে পাহাড় আর মেঘের মিতালি চলে দিনরাত। আপনিও ঘুরে আসতে পারেন ওই মেঘের দেশে। তবে যারা মেঘ ভালোবাসেন তারা জুন-জুলাই অর্থাৎ বর্ষাকালে ভ্রমণে গেলে বেশি আনন্দ পাবেন। কারণ মেঘ তখন আপনা হতে এসে আপনাকে ধরা দিয়ে যাবে।



নীলগিরি যেতে হলে আগে থেকে জিপ ভাড়া করতে হবে। সময় লাগবে আসা-যাওয়ায় সাড়ে চার ঘণ্টা। ভাড়া সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্ধারিত আসা-যাওয়ার জন্য ছোট জীপ: ৫ সিট ২৩০০ টাকা এবং বড় জীপ: ৮ সিট ২৮০০ টাকা। কিন্তু এখানে ড্রাইভাররা আপনার কাছে আরো অনেক বেশি চাইতে পারে। দরদাম করে নেবেন।

স্বর্ণমন্দির: বর্তমানে স্বর্ণমন্দির উপাসনালয়টি বান্দরবান জেলার একটি অন্যতম পর্যটন স্পট হিসেবে পরিগনিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম এই ‘বৌদ্ধ ধাতু জাদী’ স্বর্ণমন্দির নামে পরিচিত। এটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উল্লেখযোগ্য একটি উপাসনালয়। যা বান্দরবান শহর থেকে ৪ কি.মি. উত্তরে বালাঘাট নামক এলাকায় পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত।
এর নির্মাণশৈলী মায়ানমার, চীন ও থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ মন্দিরের আদলে তৈরি। বান্দরবান ভ্রমণে আপনিও এই জাদী বা স্বর্ণমন্দির ঘুরে আসতে পারেন।

মেঘলা: নাম মেঘলা হলেও মেঘের সঙ্গে মেঘলা পর্যটন স্পটের কোনো সর্ম্পক নেই। বান্দরবান জেলা শহরে প্রবেশের ৭ কি.মি. আগে মেঘলা পর্যটন এলাকা। এটি সুন্দর কিছু উঁচু-নিচু পাহাড়বেষ্টিত একটি লেক ঘিরে গড়ে উঠেছে। সবুজ গাছ আর লেকের স্বচ্ছ পানি পর্যটককে প্রকৃতির কাছাকাছি টেনে নেয় প্রতিনিয়ত। পানিতে যেমন রয়েছে প্যাডেল বোট, তেমনি ডাঙ্গায় রয়েছে মিনি চিড়িয়াখানা। রয়েছে রোপওয়ে কার। এখানে সবুজ প্রকৃতি, লেকের স্বচ্ছ পানি আর পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দেখতে পাবেন বান্দরবানের নয়নাভিরাম দৃশ্য। মেঘলা পর্যটন স্পটের পাশেই রয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের বান্দরবান পর্যটন হোটেল।



শৈলপ্রপাত: শৈলপ্রপাত বান্দরবান শহর হতে ৭ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্বে চিম্বুক বা নীলগিরি যাওয়ার পথে দেখা যাবে।

নীলাচল: নীলাচল বান্দরবান শহর হতে ১০ কি.মি. দক্ষিণে ১৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত একটি পর্বত শীর্ষ। যেখান থেকে নীল আকাশ যেন তার নীল আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে ভূমির সবুজ জমিনে। যে দিকে দুচোখ যায় অবারিত সবুজ ও নীল আকাশের হাতছানি। মুগ্ধতায় ভরে উঠবে মন-প্রাণ।

মিলনছড়ি: মিলনছড়ি বান্দরবান শহর হতে ৩ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্বে শৈলপ্রপাত বা চিম্বুক যাওয়ার পথে পড়ে। এখানে একটি পুলিশ ফাঁড়ি আছে। পাহাড়ের উঁচুতে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পূর্ব প্রান্তে অবারিত সবুজের খেলা এবং সবুজ প্রকৃতির বুকে সর্পিল গতিতে বয়ে যাওয়া সাঙ্গু নদী এখান থেকে ভালোভাবে দেখা যাবে।

চিম্বুক: চিম্বুক বান্দরবানের অনেক পুরোনো পর্যটন স্পট। বান্দরবান শহর হতে ২১ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্বে মিলনছড়ি এবং শৈলপ্রপাত পেরিয়ে চিম্বুক যেতে হয়। এখানে পাহাড়ের চূড়ায় রেস্টুরেন্ট এবং একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে। পাহাড়ের চূড়া থেকে চারদিকের সবুজ প্রকৃতির সৌন্দর্য এখানে প্রকৃতিপ্রেমীদের টেনে আনে।

সাঙ্গু নদী: পাহাড় থেকে সাঙ্গু নদী নেমে এসে বান্দরবান শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে গেছে। বান্দরবান শহরের পূর্বে পাহাড়ি ঢালে বয়ে চলা সাঙ্গু নদী দেখতে দারুণ দৃষ্টিনন্দন।



কীভাবে যাবেন


ঢাকা থেকে বান্দরবান যেতে আপনি ২-৩টি রুট ব্যবহার করতে পারেন। ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে প্রথমে চট্টগ্রাম তারপর চট্টগ্রাম থেকে সোজা বান্দরবান। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট টার্মিনাল থেকে পূরবী এবং পূর্বাণী নামক দুটি নন এসি বাস আছে ৩০ মিনিট পর পর বান্দরবানের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৭০ টাকা। ঢাকা থেকে বান্দরবান সরাসরি বাস সার্ভিস রয়েছে।

খাবার: বান্দরবান শহরে খাবার হোটেলের মান তেমন ভালো নয়। তবে যে হোটেলে আপনি থাকবেন সেগুলোতে রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থা আছে কিনা দেখে নিন। ‘ফিয়েস্তা’ এবং ‘তাজিংডং’ ভালো মানের হোটেল। বান্দরবানে খাবারের মানের চেয়ে দাম বেশি। রান্নায় মসলার ব্যবহার এবং হলুদের আধিক্য রয়েছে। বান্দরবান থাকার জন্য হোটেল বুকিং করতে পারেন জোভাগো ডটনেট (www.jovago.net) থেকে।

জেনে রাখুন
*ভালো, মজবুত ব্যকপ্যাক নেবেন। হাতব্যাগ বা লাগেজ ভোগান্তিতে ফেলবে।
*ট্যুরে ব্যাগ কাঁধে রাখতে হবে। পাহাড়ে ওঠার সময় মেকাপবক্স/পারফিউম ইত্যাদি ফেলে দিতে হবে ওজন কমাতে। অতএব, কাপড় মাত্র ২ সেট নেবেন। অযথা ব্যাগ ভারী করলে পরে কাঁদতে হবে।
*ভালো, মজবুত স্যান্ডেল নেবেন। মাটিতে ভালো গ্রিপ করে, পিছলে যায় না এমন স্যান্ডেল নিতে হবে।
*সঙ্গে সবসময় পানি, সামান্য কিছু হাল্কা খাবার রাখবেন।
*কলার পটাশিয়াম পেশির জন্য উপকারী। পাহাড়ে উঠলে পেশির ওপর অনেক চাপ পরে। অতএব, বান্দরবান গেলে কলা খাবেন।
*বেশি স্যালাইন খেলে রক্তচাপ বাড়ে, ঘাম বাড়ে ফলে আরো বেশি পানি শূন্যতা সৃষ্টি হয়। অতএব, সারাদিন চলার পথে বেশি স্যালাইন খাবেন না। পানি খাবেন। অনেক তৃষ্ণা পেলেও একবারে বেশি পানি খাবেন না। হঠাৎ পেট ভারী হয়ে গেলে হাঁটতে পারবেন না।



*মশা প্রতিরোধের জন্য অবশ্যই Ododmos লোশন নেবেন।
*হাঁটার সময় ফুটবলারদের মতো অ্যাংলেট, নি-ক্যাপ পড়বেন।
*টর্চ নেবেন। কম জ্বালাবেন। তাহলে চার্জ শেষ হলে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না।
*প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠবেন। যত দেরিতে রওনা হবেন, রোদে তত বেশি কষ্ট হবে। অলস কেউ থাকলে তাকে কক্সবাজার পাঠিয়ে দিন। বান্দরবান তার জন্য না।
*জোঁকের জন্য সবার সঙ্গে সামান্য লবণ রাখবেন। জোঁক লাগলেই অযথা চেঁচামেচি না করে আপনার পাশের জনকে লবণ দিতে বলুন। জোঁক মরে যাবে।
*দল ১০ জনের হলে ৫ জনের ২টা দলে হাঁটবেন। কেউ যেন দলছাড়া না হয়ে যায়।
*ক্যাপ পরে নেবেন। এতে রোদের হাত থেকে কিছুটা স্বস্তি মিলবে।
*ছাতা, রেইনকোট নিতে ভুলবেন না।
*ব্যাকপ্যাক কাভার নেবেন সবাই বা সকল জিনিস বড় পলিথিনে ভরে তারপর ব্যাকপ্যাকে ভরবেন।
*জ্বর, পেইন কিলার, আমাশয়, গ্যাস্ট্রিক, স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ইত্যাদি প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে নিতে ভুলবেন না।
*বিস্কুট/চিপস/চানাচুর ইত্যাদির প্যাকেট বা প্লাস্টিকের বোতল, অপচনশীল বস্তু ফেলবেন না যেখানে সেখানে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ