ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নেপালে পবিত্র গুহার পথে

মাহী ফ্লোরা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৭, ১৫ নভেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নেপালে পবিত্র গুহার পথে

(দেখে এলাম হিমালয়কন্যা নেপাল: ২য় কিস্তি)


মাহী ফ্লোরা : ঈদের দিন ভোরে উঠে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়তে গেলো বড় ছেলে আর তার বাবা। ফিরে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়লাম পোখারার উদ্দেশ্যে। অহরহ বড় মাইক্রোবাসগুলো যাচ্ছে পোখারার দিকে। টিকিট কেটে লাগেজ গাড়ির মাথায় উঠিয়ে বসে পড়লাম। সময় মতো ছাড়লেও কাঠমান্ডু পেরোনোর মুখেই আড়াই ঘণ্টার জ্যামে পড়লাম। জায়গার নাম কলাঙ্কি। প্রতিদিন এই জায়গা পার হতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা লাগে। যাওয়া এবং আসা দুবেলায় এখানে জ্যাম। বুঝি না যে জায়গায় প্রতিদিন একই ঘটনা ঘটে সে জায়গা কী কোনো প্ল্যানের ভেতর থাকা উচিত ছিল না?

একটা এভোমিন আসলে বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাদের। মাইক্রোতে এসি ছিল না। বাইরে গরম! কাঠমান্ডু গিয়ে যদি এসির ভেতর থাকতে হয় তবে ভাবুন একবার কেমন দুঃখ লাগে! জ্যামটুকু পেরিয়ে চোখ মেলতেই পাহাড় তখন। ততক্ষণে অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম পাহাড় দেখব বলে। পাহাড়ে গাড়ি ঢুকতেই গরম কমে গেল একটু একটু করে। চারপাশে তখন শুধু গাছ আর গাছ। পাহাড় কাটা। নদী দেখলেই বুকের রক্ত ছলকে উঠছে। পাহাড়ের মাটি ধোঁয়া পানি, ভীষণ স্রোত। ব্রিজ পেরোলাম একে একে গোমতী ব্রিজ, হুগদি ব্রিজ, থাডেখোলা ব্রিজ, সান্ধিখোলা ব্রিজ। মাঝে গাড়ি থামল একটা ধাবায়। একেকজনের জন্য কার্ড নিয়ে বুফে স্টাইলে যা ইচ্ছে খাও। ভাত, ডাল, সবজি, টক, মাছ দারুণ রান্না। মন ভালো হয়ে গেল খেয়ে। গত কদিনের খাবারের কষ্ট ভুলে গেলাম মুহূর্তে। এরপর গাড়িতে উঠে পাহাড় দেখা আর পোখরার অপেক্ষা। পথ যেন শেষ-ই হয় না।

প্রায় আট ঘণ্টা মাইক্রোবাসের ভেতর। ছোট ছেলে বিরক্তির শেষ সীমায়। চলো চলো। আমরা এই তো এসে গেছি বলে থামিয়ে রাখছি। শেষে পৌঁছালাম। হোটেলের গাড়ি এলো পিক করতে। গাড়িতে উঠতেই ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজে হোটেলে ঢুকলাম। হোটেল ফেওয়া হলিডে ইন। ছাতাও মানে না এমন বৃষ্টি। কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি শেষ। এত জল কোথায় যে গেলো সব!

একটু বিশ্রাম নিয়েই পাশের এক হোটেলে রাতের খাবার খেতে গেলাম। ঘুম প্রয়োজন। সারা শরীরে ব্যথা। পরের দিন পোখারা দেখার উত্তেজনা। হোটেল ফেওয়া হলিডে ইন-এর দোতলার একটা ব্যালকনিসহ রুমে আমাদের আরামের ঘুম শেষে ভোর হলো। পোখারা হচ্ছে সমতল একটা জায়গা চারপাশ উঁচু পাহাড়ে ঘেরা বলে কাঠমান্ডুর চেয়েও এখানে গরম বেশি। বিদ্যুৎ সরবরাহের অবস্থাও করুণ। ফ্যান প্রায় চলেই না বলতে গেলে। ভোর হতেই ফ্রেশ হয়ে হোটেলেই আলু পরোটা খেয়ে আমরা লেকের দিকে গেলাম। লেক হাঁটা পথ। দুধারে হোটেল। রাস্তাটাও বিচে যাবার মতো। পুরী ভ্রমণে ঠিক এরকম একটা রাস্তা পেরিয়েই আমরা সমুদ্রে যেতাম।



রোদ নেই। একটু আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। ছায়া ছায়া একটা দিন। লেকের কাছে পৌঁছেই মন ভালো গেলো। কেমন শান্ত চারপাশ। লেকের রঙিন নৌকাগুলো মাছের মতো পাশাপাশি বুক পেতে আছে। লেকের ওপাড়ে উঁচু পাহাড়। ঘন বৃক্ষরাজি। ছবি বা কথায় এর সৌন্দর্য বর্ণনা একেবারেই অসম্ভব। ওখানে গিয়ে আমরা কেবল নির্বাক হয়ে বসে রইলাম খানিকটা সময়। ছবি তুললাম। রাস্তার এপাশের সুপার শপ থেকে আইসক্রিম খেয়ে গরমটা হজম করার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। কারণ দুপুরের আগেই আমরা বেরুবো পোখারার দর্শনীয় স্থান দেখতে। হোটেল থেকেই গাড়ি ম্যানেজ করা। কোথায় যাবেন, কী করবেন শুধু বলবেন তারাই সাইট সিয়িং-এর ব্যবস্থা করবে। প্রথমেই রওনা হলাম ডেভিড ফলস-এর দিকে।

আগে এক হোটেলে ঢুকে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম আমরা। নেপালি থালি। ভাত, সবজি বিভিন্নরকম, পাঁপড়, চাটনি, দই।  এর মাঝেই টুকটাক নেপালি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। বাংলা এবং নেপালি ভাষার মধ্যে অনেক মিল। আমরাও পানি বলি তারাও পানি বলে। আমরা ভাত বলি, তারাও ভাত বলে। হিন্দিতে আবার ভাতটা চাউল (চাবাল) হয়ে যায়। ঠান্ডা পানি হচ্ছে চিসো পানি। গরম হলো তাতো। মজা পাচ্ছিলাম এসবে। প্রথমে তো আমরা আধাখেচড়া হিন্দি চালাচ্ছিলাম, পরে দেখি আরে এরা তো সব বোঝে! ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম আম হচ্ছে আব। ডালিম হচ্ছে আনার।



রুপির ব্যাপারটা বলে নেই এর মাঝে। আমরা একশো ডলার ভাঙিয়ে নেপালি দশ হাজার চারশো রুপি পেয়েছিলাম। খাবারের মূল্য আকাশচুম্বী। উদাহরণ দিই। একটা ডালিম আমরা কিনেছিলাম ২০০ রুপি দিয়ে। একটা আলু পরোটার দাম ২৭৫ রুপি। খেতে গিয়ে মজার ব্যাপার সালাদে তারা পেঁয়াজ মুলা শশার একটা করে টুকরা রাখে। কিন্তু মরিচ? আহা মরিচের দামটাই যে ঝাল। এক মিরচি (মরিচ) দাশ (দশ) রুপিয়া বাবু। শুনে ভারতীয় এক পরিবার আঁতকে উঠে বলল- রাখদিজিয়ে দিদি রাখদিজিয়ে!

বেশ মজা পেয়েছিলাম এই ঘটনায়। দোকান ভেদে ১৫০-২৫০ রুপিতে নেপালি থালি পাওয়া যায়। খাবারের টেস্ট দারুণ। মশলাদার খাবার। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা প্রতিবার ভাবতাম খাবারের ছবি তুলে রাখবো। খাবার সামনে পেয়ে আমরা ভুলেই যেতাম ছবি তুলতে!

ডেভিড ফলস: খেয়ে বের হয়ে ডেভিড ফলস-এর ভেতর ঢুকলাম একেকজনের ২০০ রুপি টিকিট। তবে একটা ব্যাপার ভালো নেপালি যে ভদ্রলোক আমাদের গাইড ছিলেন তার কোনো টিকিট লাগে না কোথাও। শুধুমাত্র পর্যটকের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা। যে ফলসটা দেখছি আমরা এখন সেটা ফেওয়া লেকের পানিই পাহাড়ের ভেতর প্রবেশ করছে। ফলস দেখা শেষ করে আমরা পানিটা কোন গুহার ভেতর যাচ্ছে রাস্তার উলটো দিকে গিয়ে গুহার ভেতর প্রবেশ করব আবার।



ততক্ষণে মাথার ওপর চান্দিফাটা রোদ যাকে বলে। সেটা এক অর্থে শাপেবরও। ভীষণ রোদে ফলসটার পানি সামনের পাহাড়ের উঁচু অংশে ধাক্কা লেগে মেঘ তৈরি হচ্ছে আর গাছের পাতার কাছে গিয়ে সাথে সাথেই ঝিরঝির বৃষ্টি। রঙধনুও তৈরি হচ্ছে একপাশে। নেপালি পোষাকের মাথা ছাড়া পুতুলের কাছে গিয়ে মাথা তুলে ছবি তুললাম আমরা। ছোট ছেলে ভীষণ ভয় পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করেছিল। একটা পেটমোটা লাফিং বুদ্ধ নিয়ে এলাম ডেভিড ফলস থেকে। আসুক আমার কাছে আনন্দ সুখ শান্তি! থাকুক আমার কাছে হাসিমুখে শান্তির মানুষটা।

এবার ডেভিড ফলস-এর জল কোথায় যাচ্ছে সেটা দেখার পালা। গুহার ভেতর দিয়ে ঢুকতেই এক পশলা দারুণ বাতাস। প্রাকৃতিক এসি যাকে বলে। কিছুদূর পরপরই সিসি ক্যামেরা। অহরহ পর্যটক ঢুকছে বেরোচ্ছে। যাদের সাথে গাইড নেই তারা একে অন্যকে জিজ্ঞেস করতে করতে এগুচ্ছে। আর পথ নেই ভেবে ফিরেও আসছে। আমরা গাইড ছিল বলে শেষ পর্যন্ত গেলাম। ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে ভেতরটা। পাথরের গায়ে যুগের পর যুগ জল বাষ্প কণায় শ্বেত পাথরের জন্ম নিচ্ছে। এসবই চুনাপাথর। ঢোকার সময় দারুণ বাতাস সামনে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, ফেরার সময় বুঝলাম গরম কাকে বলে। ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে অবস্থা থেকে বেরিয়ে পানি পানি করে জান বেরিয়ে যাচ্ছিল। একটা চিসো পানির ২৫০ মিলির বোতল কিনলাম ১৫০ রুপি দিয়ে।

যাই হোক বেরিয়ে এবারের গন্তব্য আমাদের শ্বেতি নদী। ২৫ রুপির টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম আমরা। খুব নিচ দিয়ে হিমালয় গলা শাদা ঠান্ডা পানি বয়ে যাচ্ছে। পাম্পের সাহায্যে সেই পানি ওপরে উঠিয়ে শহরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। একটা ছোট বালতি বাঁধা কুয়োর মতো। বালতিতে পানি তুলে সেই ঠান্ডা পানি নিজ হাতে একটু ছুঁয়ে দেখার ব্যবস্থা। ঠান্ডা পবিত্র পানি! (চলবে)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ নভেম্বর ২০১৭/সাইফ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়