ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ভিয়েতনামের পথে : পঞ্চম পর্ব

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৯, ৫ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভিয়েতনামের পথে : পঞ্চম পর্ব

ফেরদৌস জামান : ব্যাংককে খোলা পানি পান করার চল নেই। ঘরে অথবা বাইরে- বোতলজাত পানি ছাড়া উপায় নেই। হোটেল-রেস্টুরেন্ট সবখানে বোতল। বাসাবাড়িতে কী নিয়ম জানা নেই। হাতে হাতে দুই কি আড়াইশ মিলিলিটারের বোতল দেখে সহজেই অন্দাজ করা যায় তারা খুব বেশি পানি পান করেন না। দোকানে আধালিটারের উপর বোতল চোখেই পড়ে না। অল্পক্ষণ আগে দুই ঠোঙা আমের ফালি খেয়েছি। ফল কেটে ফালি করে প্লাস্টিকের মগ অথবা পলিথিনের ঠোঙায় ভরে বরফের কুচির উপর সারি করে রাখা। সাথে নিজ ইচ্ছামতো যোগ করা যায় লবণ, মরিচগুঁড়া এবং চিনি। এত স্বাদ আর মিষ্টি আম এর আগে কখনও খেয়েছি বলে মনে হয় না।

জানি না টকজাতীয় ফল খেলে অধিক পিপাসা লাগে কি না? আম খাওয়ার পর পিপাসা লাগলে পানির সন্ধান করতে গিয়েই অভিজ্ঞতার খাতায় যুক্ত করি থাইল্যান্ডবাসীর স্বল্প পানি পানের বিষয়টি। ডানে মোড় নিয়ে প্রবেশ করি উইকেন্ড মার্কেটের মূল প্রাঙ্গণে। এখান থেকেই কয়েকটা পথ এগিয়েছে এদিক-সেদিক। ক্রেতা-দর্শণার্থীদের পদচারণায় মুখোর চারপাশ। পায়ে হাঁটা পথ। দুই শে স্মারক উপহার সামগ্রীসহ কাপড়চোপড়ের শত শত দোকান। বিক্রেতার সংখ্যা নারী-পুরুষ প্রায় সমান। রোদের তাপ বেশ। তবে শরীর খুব একটা ঘামছে না। অনেকের হাতে ঢাকনাওয়ালা বড় মগে বরফকুচি মিশ্রিত ফলের জুস। ঢাকনার ফুটা দিয়ে পাইপ ঢুকানো। হাঁটছে আর কিছুক্ষণ পরপর চুমুক দিচ্ছে। এসব দেখে আমাদেরও একটা ঠান্ডা জুস পান করার ইচ্ছা হলো। বিশ কি ত্রিশ বাথে এক মগ লেবুর জুস তবে পাইপ দুইটা। এক জুস দুইজনে হাত বদল করে আমরাও অনেকক্ষণ ধরে পান করলাম। এরপর ঢুকে গেলাম আরো জমজমাট এলাকায়। ডানে-বাঁয়ে পথের শাখা চলে গেছে মার্কেটের অন্য প্রান্তে। খাবারের দোকান অনেক। হালকা আঁচ দিয়ে সাজিয়ে রাখা কমলা রঙের স্কুইডগুলোর শরীর ধারালো ছুরি দিয়ে হালকা চিড়ে দেয়া। চিংড়ি আর তেলাপিয়া মাছের ভাজা এত সুদৃশ্য করে সাজিয়ে রাখা যে, খাওয়ার লোভ সামলানো মুশকিল!

 



এখানে ডাব সহজলভ্য নয়। সৌখিনদের পানীয় বলেই মনে হলো। ব্যাপর এমন নয় যে, গিয়ে বললাম আর বিক্রেতা বাধা থেকে একটা কেটে মুখের সামনে বাড়িয়ে ধরল। প্রতিটা ডাব বিশেষ পন্থায় কেটে একটার উপর একটা সারি করে সাজিয়ে রাখা। তবে ডাবের ভেতর সাশের পুরু থাকা আবশ্যক। তারা কঁচির চেয়ে সাশযুক্ত ডাব খেতে বেশি পছন্দ করে। দেখে অনুমান করা যায় কাঠের লচিয়া বানানো যন্ত্রের মতো কিছু দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ডাবের পেট থেকে সবুজ ছাল তুলে নেয়া হয়েছে। উপর এবং নিচের অংশ সবুজ আর মাঝখানে পেটের অংশটুকু সাদা। তারপর মুখের প্রান্তটা চোখা এবং তলানী সমান করে কাটা। দেখে প্রথমেই বোঝা যায় না ডাব না অন্য কিছু। পাশেই মাঝবয়সী ডাব অর্থাৎ নারিকেলের আরেক রকমের প্রদর্শনী। ছাল উপড়ানো নারিকেলও অনেক সৌখিন করে সাজিয়ে রাখা। তলানী বা মুখের অংশে হালকা পোড়ানো কালো দাগ। ছাল চেছে ডাব সৌন্দর্য বর্ধনের বিষয়টা বোঝা গেলেও অপরিণত নারিকেল পোড়ানোর হেতু শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করতে পারিনি। ডাব অথবা নারিকেল নিয়ে তাদের এই সৌখিনতা বলে দেয় এই জিনিস ভক্ষণ করা নিঃসন্দেহে অনেক উঁচু দরের ব্যাপার।

 



একটু ভেতরে প্রবশ করলেই সম্পূর্ণ এলাকা খাবারের দোকানে ঠাসা। দোকানে টেবিল-চেয়ার পাতা, যে যার পছন্দ মতো জায়গায় বসে বর্ণিল সব খাবরের মাঝ থেকে নিজ পছন্দ মতো খাবারের স্বাদ গ্রহণ করছে। এখান থেকে বেরিয়ে আর একটু সামনে গিয়ে তথ্য কেন্দ্রের পাশে উন্নত সামিয়ানার নিচে প্রয়াত রাজা ভূমিবলের ছবি দেখলাম সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। ছবির সামনে গালিচা বিছানো পরিপাটি মেঝেতে সুদৃশ্য চেয়ার ও টেবিল পাতা। তাতে রাখা আছে শোক বই। শোকার্ত থাইবাসী প্রিয় রাজাকে স্মরণ করে এখনও শোক বইতে স্বাক্ষর করছে। টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হলে এই জায়গাটাকেই আশ্রয়ের জন্য উপযুক্ত মনে হলো এবং এই সুযোগে শোক বইতে স্বাক্ষরটাও করে ফেললাম। এখানে পরিচয় হয় এক ইন্ডিয়ান নাগরিকের সাথে। উত্তর প্রদেশের মানুষ হলেও বাংলা ভালো জানেন। ব্যবসা বা কাজের সূত্রে ব্যাংককে থাকেন। রাজার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে প্রণামরত একটা ছবি তুলে দেয়া থেকেই তার সাথে আলাপ। কথায় বোঝা গেল শেষ পর্যন্ত তিনি বিশ্বাসই করতে পারলেন না যে, বাংলাদেশের মানুষ কাজ ছাড়া শুধু শুধু ঘোরাঘুরির জন্য থাইল্যান্ড আসতে পারে।

 



রোদ পরে গেলে। এখন ক্ষুদ্র ফোঁটার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। ইউরোপ-আমেরিকার আর স্থানীয় ফর্সা মানুষগুলোর মধ্যে হাতে গোনা কিছু শ্যাম বর্ণের মানুষ আর তার মাঝে আমরা দুজন। আবারও পানির পিপাসা পেল। সেই দোকানটা আর খুঁজেই পেলাম না, যেখানে এক লিটারের বোতল দেখেছিলাম। আমরা তো পানির দেশের মানুষ, যে পরিমাণ পিপাসা লেগেছে এদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বোতলে তো হবেই না বরং ব্যাংককের মজুদ করা সমস্ত পানি গলায় ঢাললেও কাজ হবে কি না সন্দেহ! বাধ্য হয়ে হাফ লিটারই কিনতে হলো। এরপর চোখে পড়ল বরফ কুচির উপর সাজিয়ে রাখা রং-বেরঙের জুসের বোতল। দেখে বোঝা যায় কমলা, স্ট্রবেরি, আম ইত্যাদির জুস। ঠান্ডা বোতলের গায়ে দানাদানা পানির আবরণ। বিক্রেতা জানায় এইমাত্র বানিয়ে রাখা। পঁচিশ কি ত্রিশ বাথে এক বোতল। গলায় এক ঢোক পড়তেই যেন শিরশির করা অনুভূতি বয়ে গেল মাথার তালু থেকে পা পর্যন্ত। ভেবেছিলাম আসল জিনিস কিন্তু আমার বন্ধুদের গল্প করা সস্তা ফলের দেশ থাইল্যান্ডেও যে আসল বলে দুই নম্বর জুস বিক্রি হয় তা জানা ছিল না। উপহার সামগ্রীর দোকানে যে কত ধরনের জিনিস তার ঠিক নেই! ইচ্ছা করে সবই কিনি, বিশেষ করে পরিবারের আদরের সদস্যদের জন্য। দুপুরের খাবার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এখনও খাওয়া হয়নি। মার্কেটে ঢোকার সময় ফুটপাথে যে দোকানগুলো দেখেছিলাম সেখানেই ফিরে এলাম। সুজিত নিলো সয়া আর মাংস দেয়া নুডুলস সুপ। আমি বরং ভাতই বেছে নিলাম। ভাতের সাথে মুরগির মাংসের ভাজা। টেবিলে সাজানো আছে লেটুস বা বাধাকপির চিকন করে কাটা সালাদ। সাথে এক ধরনের কঁচি গাছের মতো, যেন এক দেড় ইঞ্চি কান্ডে কেবল মাত্র অংকুরিত দুটো পাতা। সব শেষে বোতলে সরিষার তেলের মতো রঙের এক ধরনের পদার্থ। খাবার পরিবেশিত হলো। দুজনে দুই জোড়া চপস্টিক নিয়ে অভ্যস্ত হতে চেষ্টা চালালাম। খানিক পরে হার মেনে চামচেই ভরসা খুঁজে পেলাম। সবই যখন চেখে দেখছি তাহলে বোতলের তরল পদার্থ আবার বাদ যাবে কেন? এই ভেবে কর্কটা খুলতেই সেই গন্ধ। সকাল থেকে এই গন্ধ পরিচিত হয়ে উঠেছে। যে কোন ধরনের খাবারের দোকান বা রেস্টুরেন্টের আশপাশ দিয়ে গেলেই নাকে এসে এটাই প্রথম ধাক্কা দেয়। মুরগির মাংসের ঠান্ডা ভাজা বা ফ্রাই। ভাতেরও একই অবস্থা। অভিযোগ করে লাভ হলো না কারণ এই সমস্ত খাবার গরম-ঠান্ডা নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা নেই।

 



আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনা এমনভাবে সাজানো যে, কেনাকাটার জন্য আলাদা করে সময় বের করার সুযোগ নেই। কার কার জন্য উপহার কিনতে হবে ভ্রমণের দুই মাস আগেই তার একটা তালিকা তৈরি করেছিলাম। সুতরাং, যা কেনার তা চলার পথেই কিনতে হচ্ছে। হস্তশিল্পের মধ্যে মেয়েদের অলংকারে খুঁজে পাওয়া যায় অসাধারণ মান ও দক্ষতার পরিচয়। বিভিন্ন প্রাণীর হাড় বিশেষ করে শার্কের হাড় দিয়ে তৈরি গহনা শুধু অতুলনীয় নয় বরং শিল্পমানসম্পন্নও। কাঠের টুকরো, গাছের ডাল-বাকল ইত্যাদি যেসব কেবল পরে থাকতেই দেখা যায়; এই সব জিনিস ঘষামাজা করে গড়ে তোলা হয়েছে চমৎকার একেকটা গহনা। বৃষ্টি জোরে এলো। আনন্দে অনেকেই জরাজরি করে ভিজছে, গায়ে মেখে নিচ্ছে বৃষ্টির পরশ। আশপাশ কেমন ফাঁকা হয়ে গেল। এমন ফাঁকা রাস্তা পেয়ে আমরা ছাতা মেলে ধরলাম। এক পর্যায়ে কুলাতে না পেরে আশ্রয় নিলাম পাশের ম্যাসেজ সেন্টারে। চিৎ করে, উপুর করে বা কাত করে শুয়ে বসিয়ে চলছে মালিশের কাজ। সুগন্ধি কেমিকেলে চারপাশ ভরে গেছে। দেড় থেকে চারশ বাথে নানান ধরনের প্যাকেজ। সমস্ত মার্কেটে এমন অনেক সেন্টার রয়েছে। খদ্দের আকর্ষণে রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রচার করছে তাদের অফারের ধরন।

আরাম প্রিয় সৌখিনরা যাচাই-বাছাই করে লুফে নিচ্ছে সাধ্যের মধ্যে পছন্দের প্যাকেজ। আবার অনেকে নেহায়েত নতুন এক অভিজ্ঞতা অর্জনের খাতিরে পার্লারে ঢুকতে কার্পণ্য করছে না। এমন একটা বর্ণাঢ্য বাজার দেখার পর মনে হতেই পারে স্বার্থকতা আর অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে থাইল্যান্ড পর্বের সূত্রপাত করতে পারলাম। সময় অনেকটাই পেরিয়ে গেছে। আমাদের বাসের সময় সন্ধ্যা ছয়টা। কাকতালিয়ভাবে পাওয়া সুযোগ অত্যন্ত সফল ও সুন্দরভাবে অতিবাহিত হয়েছে। অতএব, আর দেরি না করে একই পথে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম চাতুচক বাস টার্মিনালে। (চলবে)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ জানুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়