ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

থাইল্যান্ড পারল আমরা পারলাম না

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৮, ২৩ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
থাইল্যান্ড পারল আমরা পারলাম না

(ভিয়েতনামের পথে: নবম পর্ব)
ফেরদৌস জামান : সূর্য এমনভাবে ডুবছে যেন সীমান্তের ওপারে পর্বতের গায়ে আলতো করে বসে পড়বে। তারপর বেলুনের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে নামবে অথবা ভেসে যাবে অন্য কোনো ঠিকানায়। এক ফালি চেড়া কাঠে স্থানীয় ভাষায় কিছু একটা লেখা। ঠিক তার নিচে রেলিংয়ের পাশে বসার জন্য কাঠের বেঞ্চ। এখানে বসে থাকতে থাকতে পশ্চিম আকাশের গোধূলি রং ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। ওদিকে সন্ধ্যার মে হং সন অপেক্ষায় আছে। মন্দির থেকে নেমে সেই যে শুরু করেছি, এখনও হাঁটছি। এই পথ সেই পথ ঘুরেও জনিস গেস্ট হাউস খুঁজে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে ঘুরে ফিরে সেই একই রাস্তায় বারবার আসছি। এই সন্ধ্যা রাতে সমস্ত অলিগলি ঘুমিয়ে পড়েছে। একজন মানুষও কি থাকবে না, যে অন্তত আমাদের গেস্ট হাউস চিনিয়ে দিতে পারে? একেকটা গলির মাথায় ঢুকি আর মনে হয় এই বুঝি পেয়ে গেলাম। এমন করে শহরের অর্ধেক গলি চষে বেড়ালাম। অবশেষে গেস্ট হাউস ঠিক করে দেয়া সেই ট্যুর অপারেটরের দেখা পেয়ে নিস্তার মিলল।

একটু ফ্রেশ হয়ে আবারও বেরিয়ে পড়লাম। এবার আর পথ হারাবার আশঙ্কা নেই। সাবধানে পথ চিনে এগিয়ে গেলাম লেক সাইডের দিকে। লেকের পাশ দিয়ে বসেছে সান্ধ্যাকালীন দোকনপাট। বর্ণিল আলোয় ঝলমলে পরিবেশ। দেশি-বিদেশি পর্যটকের আনাগোনায় মুখর। প্রত্যেকের হাতে কোনো না কোনো খাবার। ঘুরে ঘুরে নানান পদের খাবার চেখে দেখা এখানে আসা পর্যটকদের অন্যতম লক্ষ্য। কেউ একা নয়, প্রত্যেকেরই সঙ্গী আছে অথবা ভ্রমণকালে জুটে গেছে একজন আরেকজনের সাথে। আমাদের হাতে সময় মাত্র একটা রাত। এই অল্প সময়ের মধ্যে হরেক পদের স্থানীয় খাবারের মাঝে কয়টা পরখ করা যায়? বেছে বেছে কয়েকটা খাবারের স্বাদ নিতে গিয়ে পকেট খানিকটা ফাঁকা হয়ে গেলেও এ এক দারূণ অভিজ্ঞতা। ফিশ সসেজ, মাংসের সসেজ ও মাংসের বলের কথা কখনই ভুলবার নয়। স্বাদে যাই হোক না কেন, এত দারূণ পরিবেশন আর এমন জায়গায় দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোনো একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার খাওয়া মানে অভিজ্ঞতার খাতায় নতুন কিছু যুক্ত করা। মন্দির দেখতে গিয়ে পাহাড় চূড়ায় ওঠা-নামা এবং গেস্ট হাউস হারিয়ে হাঁটাহাঁটিতে শরীর থেকে যে পরিমাণ শক্তি ক্ষয়ে গেছে তা পূরণের জন্য ভারি কিছু খাওয়া দরকার। সোজা কথা একটা বাঙালি খাওয়া দিতে হবে। কিন্তু এমন কিছু চোখে পড়ছে না, যা অনেক রুচি করে খাওয়া যাবে। এরই মধ্যে একে একে দোকানগুলোর খাবার শেষ হয়ে আসছে। এরা অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সুতরাং, মাঝরাত পর্যন্ত দোকানে খাবার গড়াগড়ি করবে তা আশা করা যায় না।



পাশের দোকানে কড়াই থেকে এইমাত্র কিছু একটা ভেজে তোলা হলো। তিন কোণাকৃতির বিস্কুটের মতো, সোনালী করে ভাজা জিনিসটার নাম টফু। দেখেই আন্দাজ করা যায় খেতে মন্দ হবে না। সাথে আছে নুডুলস। মাত্র কয়েক সেকেন্ড দেরি হওয়ায় টফুর স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে হলো। ইতিমধ্যেই এক স্প্যানিশ জুটি এসে তা খপ করে কিনে ফেলেছে। এই জিনিসটা কেনা যে আমাদেরও লক্ষ্য ছিল তা জানার পর ওদের আফসোসের শেষ নেই। পারে তো আমাদের খাতিরে দোকানদারকে টফুগুলো ফেরত দিয়ে দেয়। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ওয়াট ফ্রাথাট ডই কং মু এর উচ্চতম মন্দির প্রাঙ্গণে এদের সাথে প্রথম সাক্ষাত। কাল আমরা যেখানে যাব সেই পাই থেকে পিক আপ ভ্যানের পেছনে চেপে মে হং সন এসেছে। এখানে আসার পর আশপাশটা ঘুরে দেখার জন্য ভাড়া করেছে একটা ছোট্ট স্কুটি। আর স্কুটিতে চেপেই পাহাড়ের মাথায় মন্দির দেখতে উঠে গিয়েছিল। সেখানেই আমাদের সাথে দেখা। প্রথম দেখাতে দুজনকে দারুণ লেগেছিল, যেন স্কুটিতে বসা দুটো কার্টুন। ছেলেটা অনেক লম্বা আর মেয়ের উচ্চতা তার চেয়ে এক ফুট বা চৌদ্দ ইঞ্চি কম হবে। সারাদিন দুজনে শুধু টো টো করে ঘুরেছে। কি কি দেখল সে এক লম্বা ফিরিস্তি।

কথায় কথায়  উঠে এলো কাতালানিয়া প্রসঙ্গ। সেখানকার স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে স্পেনে তো এক ধরনের উত্তাল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। খেয়াল করালাম এ নিয়ে তাদের কোনো বিকার নেই। আলাপে প্রবেশ করে দেখা গেল হাজার মাইল দূরে বসে আমরা যে পরিমাণ খবরাখবর রাখি এরা তার সিকি ভাগও রাখে না। তার চেয়ে বরং ভ্রমণসংক্রান্ত আলাপ আলোচনাতেই বেশি আগ্রহী তারা। তাদের দেশে গেলে কী দেখার আছে, কী না খেলেই নয় ইত্যাদি। ভাবলাম এই সুযোগে একটা বিশেষ জায়গা সম্বন্ধে কিছু তথ্য নেয়া যাক। এক সময় স্পেন শাসন করত আরবরা, যারা মুর বলে পরিচিত ছিল। প্রায় পাঁচ শতাধিক বছর কর্ডোবা ছিল তাদের রাজধানী। ইতিহাসে এখানকার এক গ্রন্থাগারের উল্লেখ পাওয়া যায় যেখানে প্রায় চার লক্ষ বইয়ের এক সুবিশাল সংগ্রহ ছিল। আর কর্ডোবা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সারা ইউরোপ তথা পশ্চিম এশিয়ার বিদ্যার পীঠস্থান। তের শতকের প্রথমার্ধে কাস্টিলের খ্রিস্টান রাজার হাতে কর্ডোবার পতন হয়। মুরদের তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় দক্ষিণ স্পেনে। অতঃপর এখানেই তারা গ্রানাডা নামক ক্ষুদ্র এক রাজ্য গঠন করে এবং আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে। গ্রানাডা প্রায় দুই শতাব্দী মুরদের শাসনাধীন ছিল। এক পর্যায়ে রসদ শূন্য হয়ে গেলে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে স্পেনীয়দের নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এরপর তারা অনেকেই স্পেন ত্যাগ করে ভূ-মধ্য সাগর পাড়ি দিয়ে চিরজীবনের জন্য আফ্রিকা চলে যায়। আধুনিক গ্রানাডার নিকটে একটা জায়গা আছে যেখান থেকে সমস্ত শহর দেখা যায়। তার নাম এল আলটিমো সোসপিরো দেল মোরো। অর্থাৎ মুরের (আরবদের) শেষ দীর্ঘনিশ্বাস।



যেদিন এই ইতিহাস জেনেছিলাম, সেদিনই ঠিক করেছি যদি কখনও স্পেনে যেতে পারি তাহলে জায়গাটা অবশ্যই দেখব। আমার কথা শুনতে শুনতে তারা বোধহয় খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল। দুঃখের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জানাল, তাদের দেশে এমন একটা জায়গা আছে অথচ তারা জানতো না। কথা দেয় দেশে ফিরে ভ্রমণ তালিকায় সর্বপ্রথম থাকবে এল আলটিমো সোসপিরো দেল মোরো।

যাই হোক,  টফু এবং নুডুলস যেহেতু শেষ সেহেতু দোকানি নারী আমাদের অন্য খাবার দিতে চাইল। তাতে আমাদের মন যতটা না তার চেয়ে দুই চোখই বেশি নারাজ। কারণ দেখে মনে হচ্ছে না ওটা আমাদের ক্ষুধা নিবারণে যথেষ্ট হবে। আবারও এ দোকান সে দোকান করছি। এরই মধ্যে অনেকেই খাওয়ার পর্ব শেষ করে আলো-আঁধারিতে মেতে উঠেছে অন্যরকম বিনোদনে। জলের কাছাকাছি বসার জায়গাগুলো মানুষে টইটুম্বুর, যেন এখনই সবাই মিলে নেমে পড়বে সাঁতার দিতে। শেষ পর্যন্ত পছন্দসই খাবার না পেয়ে ভরসা পাউরুটি আর কলা। গেস্ট হাউসে ফিরে কলা-পাউরুটির ব্যাগ নিয়ে আবারও বেরিয়ে পড়লাম। তবে এবার আর আগের পথে নয়, পেছনের দরজা দিয়ে ঘাসের চত্বরে। চত্বর পেরুলেই লেকের এই দিকটায় রেলিং দেয়া পায়ে হাঁটার পথ। পাশ দিয়ে ফুল, ঝাউ ও পাতাবাহারের গাছ এবং আতি চমৎকার ভাস্কর্য। আর মাথার উপর মিটমিটে আলোর ছোট বাতি। লেকের এই পাশটা বেশ নিরিবিলি, মানুষজন নেই বললেই চলে। পাড় ঘেঁষে খলবল করছে তেলাপিয়া আর কার্ফু মাছের ঝাঁক। ওপারে মন্দিরের গায়ে অজস্র আলোর খেলা। সেই আলো প্রতিচ্ছবি হয়ে পড়েছে লেকের বুকে। দোকানগুলো থেকে বিচ্ছুরিত রঙ্গিন আলো জায়গা করে নিয়েছে একইভাবে। হালকা বাতাসে পানিতে বয়ে যাচ্ছে মৃদু ঢেউয়ের দোলা। আর তাতেই দুলে উঠছে রংবেরঙের আলোক রশ্মির অসাধারণ রেখাগুলো। এমন মনোরম দৃশ্য সামনে রেখে অনায়াসে পার করে দেয়া যায় এমন একটা রাত। বসার জায়গাগুলো নিঃসঙ্গ পরে আছে। কোনো একটাতে বসে কালা-পাউরুটিতে সেরে নিলাম রাতের খাবার। পরের দিন সকাল বেলা পাই যাওয়ার বাস, তা না হলে সত্যি সত্যিই এই রাতটা লেকের পাড়েই পার করে দেয়া যেত।



নির্বাক বসে থাকতে থাকতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি মনে পড়েছে আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলের কথা। অবহেলা, অদূরদর্শী পরিকল্পনা আর খামাখা জটিলতার কারণে পর্যটনের সম্ভাবনাময় সম্পদগুলোকে ফেলে রাখা হয়েছে। জীবন মানের তথাকথিত উন্নয়নে সৃষ্টি কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদের, যার স্রোতে আজও মানুষের চোখর নোনা জল ভেসে বেড়ায়। প্রায়শ্চিত্তের জন্য হলেও কি আমরা কাপ্তাই হ্রদকে প্রকৃতপক্ষে পর্যটন উপযোগী করে তুলতে পারতাম না? সবুজ-শ্যামল পাহাড়-পর্বতবেষ্টিত কাপ্তাই হ্রদের স্বচ্ছ জলরাশিকে কেন্দ্র করে যেমন বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব তেমনি একই জেলা রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ির প্রত্যন্ত রাইক্ষ্যাং লেককেও অতি উচ্চমানের পর্যটন কেন্দ্রে রূপ দান করা সম্ভব। সম্ভব কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটানো। ওদিকে বান্দরবান রুমা উপজেলার বগালেক তার রূপ মাধুর্যের কারণে দেশজোড়া পরিচিতি লাভ করেছে। কিন্তু পর্যটনের নামে এসব নিয়ে চলছে হীন, সস্তা এবং অত্যন্ত নিচু মানের কায়কারবার। অথচ, থাইল্যান্ড নামক দেশটা সময় মতো এসবের গুরুত্ব ঠিকই অনুধাবন করল এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়ে নিল। ফলে থাইল্যান্ড আজ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। মে হং সনের সামান্য এই লেক, যাকে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের লেকগুলোর সাথে তুলনাই করা চলে না। সেই সামান্য সম্পদকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে অতি ক্ষুদ্র অথচ বিশ্বখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র। এর টানে সারা পৃথিবী থেকে ছুটে আসে অসংখ্য মানুষ।



রাত অনেক হয়ে গেছে, পারিপার্শ্বিকতার গভীর টান ছিঁড়ে এবার উঠতেই হলো। গেস্ট হাউসে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখা গেল দরজায় তালা। দুজন অতিথি বাইরে আছে জানলে নিশ্চই তালা লাগিয়ে দিতো না। তাতে অবশ্য তেমন সমস্যা হয়নি কারণ সীমানা প্রাচীরের উচ্চতা খুব বেশি ছিল না। (চলবে)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ জানুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়