ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

বুঝতে পারলাম বেছে বেছে আমার পাসপোর্ট দেখার হেতু

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৭, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বুঝতে পারলাম বেছে বেছে আমার পাসপোর্ট দেখার হেতু

(ভিয়েতনামের পথে: ১১তম পর্ব)

ফেরদৌস জামান: কাউন্টারে রাখা ব্যাগ ফেরত নিয়ে গাড়ির খোঁজ করে জানতে পারলাম, বড় বা মিনিবাস নয়, এই পথে মাইক্রোবাসে যাত্রী পরিবহণ হয়ে থাকে। তার আগে তো ভেবেছিলাম পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা চতুর্দিক খোলা লম্বা এবং কদাকার গাড়িটা আমাদের হয়ে থাকবে। প্রথমে আঁৎকে উঠলেও পরোক্ষণে ভাবতে ভালোই লেগেছিল, পাহাড়ি পথের প্রকৃতি প্রাণ ভরে দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে।

দুপুর বারোটার গাড়ির জন্য অন্য সকল যাত্রী আগেভাগেই উপস্থিত। কালো কাঁচে ঘেরা সাদা ধবধবে অতি উন্নত মাইক্রোবাস। এক গাড়িতে দশ জন। নির্দিষ্ট পোশাক পড়া চালক যত্নের সাথে ব্যাগগুলো ছাদে তুলে নিয়ে এবার সকলকে আসন গ্রহণের জন্য বললেন। সামনের আসনটায় বসার ইচ্ছা ছিল কিন্তু সম্ভব নয়, টিকিটে বরাদ্দকৃত জায়গাতেই বসতে হবে। বিষয়টা একেবারেই বাধ্যতামূলক না হলেও ভিক্ষু মহাশয় যেমন আরাম করে বসেছেন তাতে প্রস্তাব করার সাহসটাই পেলাম না। তবুও যে আসনটা পেলাম তা মন্দ নয়, ঠিক তাদের পেছনে। চালক এবং ভিক্ষুর মাঝে ফাঁক দিয়ে সামনের প্রায় সমস্তটাই সুন্দর দেখা যায়, যেন টেলিভিশনের প্রশস্ত পর্দা।

সুদক্ষ চালনায় নিঃশব্দে এগিয়ে চললো মাইক্রোবাস। পাহাড়-পর্বতের আজর-পাঁজর আর শীর্ষদেশ দিয়ে অতি মনোরম পথ। ঘন সবুজের নিচ দিয়ে কালো পথের সাদা, হলুদ রেখাগুলো যেন এখনই  কেউ এঁকে দিয়ে গেছে। প্রতিটি মোড় ও ওঠা-নামার আগ থেকেই সাইনবোর্ড ও সতর্ক বাণী লিখে রাখা। যাত্রীদের সুবিধার্থে মাঝে মাঝে পায়খানাও রয়েছে। যানবাহণের সংখ্যা নিতান্তই কম। পশ্চিমা পর্যটকের বেশিরভাগই এই পথটা মোটর সাইকেলে ভ্রমণ করে। সেক্ষেত্রে ভ্রমণ শুরু হয়ে থাকে পাই থেকে। অর্থাৎ আমরা যেখানে যাচ্ছি। সেখান থেকে মোটর সাইকেল ভাড়া করে দুএক দিন মে হং সন ও আশপাশটা ঘুরে পুনরায় পাই ফিরে যায়। সে হিসেবে এখানে এখন পর্যন্ত আমরাই বোধহয় একমাত্র উল্টো পথে ভ্রমণ করছি। হাতে গোনা দু’একটা বাদে প্রায় সব মোটর সাইকেলই স্কুটি ধরনের। অধিকাংশ স্কুটিতে দুইজন করে। এখানে যারা এসেছে তাদের কেউ একা নয়, যেন প্রেমিক যুগলের মিলন মেলা। আবার কোন যুগল আলাদা আলাদা স্কুটি নিয়ে পাশাপাশি বা আগে-পিছে আনন্দ করতে করতে এগিয়ে চলছে। মধ্য বিরতির আগে চেকপোস্টে গাড়ি থামিয়ে দুইজন এসে গাড়ির ভেতর সুচারু দৃষ্টিতে চোখ ঘুরিয়ে নিল। এই পথে সাধারণত এমন চেকপোস্ট এমনিতেই আছে এবং সচরাচর চেকিং কার্যক্রমও চলে থাকে। কিন্তু আজকের বা বর্তমানের চেকিংয়ের ধরন খানিকটা ভিন্ন। তা বুঝতে পারলাম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্য ও চালকের কথোকপথনে। আরও বেশি পরিষ্কার হলো গাড়ির ভেতরে যাত্রীদের গুঞ্জন শুনে। সন্ত্রাস দমনের উসিলায় মিয়ানমারে চলতি জাতিগত নির্মূল অভিযানের কারণে সীমান্তবর্তী মে হং সনেও সতর্কাবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম বেছে বেছে আমার পাসপোর্ট দেখার হেতু। কারণ আমাদের দুজনের চেহারা থাইদের সাথে যায় না। আড়াই থেকে পোনে তিন ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম পাই।

 


এরই মধ্যে বুঝে গেছি রিজার্ভেশন করা হোটেল বা রেস্ট হাউসে ওঠার ব্যাপারটা সম্পূর্ণই মর্জি নির্ভর। অধিকন্তু, ঠিকানা ধরে একটার পর একটা থাকার জায়গা খুঁজে বের করা চরম ভোগান্তি। এই বুকিং বা রিজার্ভেশন আসলে ইমিগ্রেশন আনুষ্ঠানিকতার অংশ ছাড়া অন্য কিছুই মনে হলো না। তাছাড়া, আমাদের মতো যেখানে রাত, সেখানে কাত ধরনের  পর্যটকদের জন্য এই সমস্ত বিষয় বিড়ম্বনা বৈ অন্য কিছু নয়। অতএব, রিজার্ভেশন লিস্ট ব্যাগে ঢুকিয়ে সাধ্যের মধ্যে পছন্দসই থাকার জায়গার খোঁজে সামান্য হেঁটে আদালত ভবনের পাশ দিয়ে গলিটায় প্রবেশ করলাম। একটু খানি এগিয়ে আবারও বামে বাঁক নিয়ে দুই কি তিন বাড়ির পরেই কেন্টার হাউস নামক গেস্ট হাউস। সদর দরজায় দেখা হয় ফরাসি এ্যামো লাইটের সাথে। মে হং সনে সে একই গেস্ট হাউসে আমাদের পশ্চিম পাশের ঘরটায় ছিল এবং সুজিতের সাথে কোন এক ফাঁকে আলাপ পরিচয়ও হয়েছিল। সেই সূত্রে এ্যামো এখানে থাকার জন্য পরামর্শ দেয়। কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙেই কাঠের বারান্দা এবং তার পর ঘরের দরজা। কাঠের মেঝে, দুপা হাঁটলেই মচমচ ধ্বনিতে চারপাশটা যেন সজাগ হয়ে ওঠে। বারান্দায় বেঞ্চি পাতা টেবিল। ঘর পছন্দ হলো। ভাড়া দুইশ বাথ প্রতি রাত। কথা এক রকম পাকা করে দুপুরের খাবারের সন্ধানে বের হলাম। পারলে আরও দুএকটা থাকার জায়গায় ঢুঁ দিয়ে পরখ করে দেখতে দোষ কী? আর কিছু না হোক বাঙালি বলে তো কথা!

কয়েকটা বাড়ির পরে আর একটা গেস্ট হাউস। তার সম্মুখে দোকানের বারান্দায় বিশেষ কর্মরত লোকটির কাজে গভীর মনোযোগ আমাদের পথ ও ক্ষুধা উভয়ই থামিয়ে দিল। সামনের টেবিলে বেশ কিছু অর্ধেক করে কাটা পানির বোতল। দুই-আড়াই ইঞ্চি সমান এক টুকরো খোসা ছাড়ানো আখের গায়ে একটা করে ভ্রমরার মত কালো পোকা জুড়িয়ে তা বোতলে রাখা। অতঃপর স্ট্যাপল করে বোতল বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। পোকাগুলো ভ্রমরার মত কালো এবং অনেক মজবুত ও পুরু দেহাবরণে আবৃত। তবে আকারে একটা পরিণত বয়সের ভ্রমরার দুই কি তিন গুন হবে। সামনে, পাশে এবং পেছনে তিন জোড়া ছড়ানো পা। দেহটা দুই ভাগে বিভক্ত। কপাল এবং থুতনি থেকে দুইটা শক্ত ও চোখা ঠোঁট আকৃতির অঙ্গ অনেকটা ব্যবধান বজায় রেখে খানিকটা সামনের দিকে এগিয়েছে। তারপর আবার উভয় ঠোঁটের চোখা প্রান্ত প্রায় একত্রিত হওয়ার মত করে বাঁক নিয়েছে। ফলে মাঝখানে একটা গোলা ফাঁকের মত তৈরি হয়েছে। অদ্ভুত এই পোকার দেহ এতটাই ঝকঝকে এবং মসৃণ যে, দেখে মনে হবে এখনই বার্নিশ লাগানো হয়েছে। ষাঁঢ়ের লড়াই অথবা মোরগের লড়াইয়ের কথা জানা আছে। পোকার লড়াইয়ের কথা প্রথম জানলাম।  স্থানীয়ভাবে বিশেষ এক খেলার প্রচলন আছে যা, বাগ ফাইট নামে পরিচিত। এই খেলায় পোকায় পোকায় লড়াই হয়ে থাকে। বাগ ফাইট দেখার সুযোগ আমাদের হলো না। তবে পরিচর্যাকারীর কথায় জানা গেল এর গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা আছে।

 


থাকার জায়গা আরও একটা দেখা হলো কিন্তু প্রথম প্রেমের মত কেন্টার হাউসই মনে ধরল। সুতরাং দেরি না করে বরং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উঠে পড়াই উত্তম। রেস্ট হাউসে ফিরে ব্যাগ রেখে দৌড় দিতে হলো খাবারের জন্য। এ গলি সে গলি ঘুরে থাকার জায়গা খুঁজতে খুঁজতে কেন্টার হাউসের চেয়ে সুবিধাজনক কোন জায়গা না মিললেও একটা খাওয়ার জায়গা মিলেছে। তখনই জানিয়ে দিয়েছে বিকেল সাড়ে তিনটার পর দুপুরের খাবার আর পাওয়া যাবে না। এক দৌড়ে গিয়ে বসে পড়লাম। দেখতে শুনতে মধ্যম মানের তবে ব্যস্ত রেস্টুরেন্ট। পাশেই সামান্য ব্যবধানে রন্ধনশালা। অর্ডার মোতাবেক রান্না চলছে। কড়াইয়ে রসুন কুঁচি ছেড়ে দিতেই এক মনমাতানো সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। কয়েক মিনিটের মধ্যে পরিবেশিত হলো ফ্রাইড মিট উইথ গার্লিক অন রাইস এবং রাইস পিপার কারি উইথ মিট। তার আগে দেয়া হয়েছে গ্লাস ভরা বরফ খণ্ড।  থাইল্যান্ডে যে কোন রেস্টুরেন্টে খেতে বসলে এই জিনিস বিনা পয়সায় মেলে এবং যত খুশি নেয়া যায়। সাথে সামান্য পরিমাণ পানি ঢেলে প্লাস্টিকের নল দিয়ে টেনে টেনে খাওয়া। এরা পানিতে বরফ নয় বরং বরফে পানি দিয়ে পান করতে অভ্যস্ত।  একেবারে কড়কড়ে ঠান্ডা পানি ছাড়া এদের চলে না। রসুন কুঁচি দিয়ে রান্না করা মাংসের ভাজাটা স্বাদে অতুলনীয়। পাই-এ অবস্থানকালে পরবর্তী সময়ে যত বার খেলাম, পারোতপক্ষে এই দোকানের শরণাপন্ন হয়েছি এবং পদ হিসেবে বারবার এটাই বেছে নিয়েছি। (চলবে)

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়