ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শেখ মুজিব ও পিকিং শান্তি সম্মেলন

ড. তানভীর আহমেদ সিডনী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১২, ১৭ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ১৪:২৭, ২৩ ডিসেম্বর ২০২০
শেখ মুজিব ও পিকিং শান্তি সম্মেলন

চীনে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যোগ দিয়েছিলেন রাজনীতিবিদ ও লেখক আতাউর রহমান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া [সাংবাদিক], খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস [লেখক, গবেষক] ও উর্দু লেখক ইবনে হাসান।

বাংলাদেশ থেকে প্রথমে মিয়ানমারের রেঙ্গুন, এখানে তিনি দেখলেন গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত এক রাষ্ট্র। তিনি লিখলেন, কারেন বিদ্রোহী এবং কমিউনিস্টদের লড়াইয়ের কথা। এখানে লিখে রাখা যায় যে কারেনরা মূলত মিয়ানমার-থাইল্যান্ড সীমান্ত অঞ্চলে বসবাস করতো তারা শিকারি এবং বন্য ফলমূল খেয়ে জীবন ধারণ করতো। পরে তারা চাষাবাদ ও পশুপালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো। মিয়ানমারে ব্রিটিশ শাসনামলে এরা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে এবং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়। ১৮৬১ সালে তারা কারেন ন্যাশনাল এসোসিয়েশন গড়ে তোলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান মিয়ানমার দখল করলে কারেনরা ব্রিটিশদের সমর্থন করেছিল। একই সময়ে কারেন ও বার্মার মূল ভূখণ্ডের অধিবাসীদের মাঝে জাতিগত সংঘাতের সূচনা হয়। যার কারণে বহু কারেনকে হত্যা এবং গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে কারেন নেতারা পৃথক রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ নেন কিন্তু ব্রিটিশরা তাদের দাবি প্রত্যাখান করে।

১৯৪৭ সালে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন গঠিত হয়। তারা পৃথক রাষ্ট্র গড়ে তোলার আন্দোলন অব্যাহত রাখে। মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভ করার পরপরই রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে যায় সেনাবাহিনীর হাতে। ১৯৪৯ সালে নে উইন ক্ষমতা দখলের পর কারেন সৈন্য এবং সাধারণ মানুষকে নির্যাতন করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এই সময়ে কারেন রাইফেল, মিলিটারি পুলিশ যৌথভাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তারা রেঙ্গুনের নয় মাইলের ভেতরে চলে আসে। সামরিক রসদ এবং খাদ্যাভাবের কারণে কারেনরা অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। এই সময়ে মিয়ানমারে রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা থেকে বোঝা যায়। তিনি যে হোটেলে ছিলেন সেখানেও নিরাপত্তার জন্য সশস্ত্র সিপাহী রাখা হয়েছে। কোনো কিছুই তাঁর নজর এড়ায়নি। এ বিষয়ে তিনি স্পষ্টই লিখেন: ‘রেঙ্গুন শহরের একদিন শ্রী ছিল। এখনও কিছুটা আছে, তবে লাবণ্য নষ্ট হয়ে গেছে।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী ২২৪]

হংকং গিয়ে চীনে প্রবেশ করেন রেল গাড়িতে, ক্যান্টন প্রদেশ দেখে তাঁর মনে হয় এ যেন বাংলাদেশের মতোই সুজলা সুফলা। তিনি যেখানেই যান না কেন বাংলাদেশ ছিল তাঁর হৃদয়ে। শোষনের পরও ক্যান্টন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। চীনের যে চেহারা তিনি এঁকেছেন তা সত্যিই নতুন এক চীনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবে। এ বিষয়ে তাঁর লেখা: ‘পূর্বে অনেক জাতি পিকিং দখল করেছে। ইংরেজ বা জাপান অনেক কিছু ধ্বংসও করেছে। অনেক লুটপাট করেছে, দখল করার সময়। এখন সমস্ত শহর যেন নতুন রূপ ধরেছে। পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি পেয়ে প্রাণভরে হাসছে।’ [অ আ ২২৬] তাঁর লেখা থেকে অনুভব করা যায় স্বাধীনতার জন্য পরাধীন একটি জাতির নেতার আকুতি কতটা।

চীনের স্থাপত্য ও ঐতিহ্য দেখার পাশাপাশি দেখেছেন জনগনের অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন। জাদুঘর, গ্রন্থাগার, পার্ক, হ্রদ ইত্যাদি রাজারা নিষিদ্ধ করে রাখলেও রাজনৈতিক বদলের মধ্য দিয়ে সাধারণ জনগণ ব্যবহার করতে পেরেছে। চীনের ‘সামার প্যালেস’ দেখে মুগ্ধ শেখ মুজিব যেন নতুন এক চিন্তায় প্রবেশ করেন। তাঁর মনে এটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রমোদ নগরী। কেননা স্থাপনা, হ্রদ, মন্দির, দ্বীপ ইত্যাদি মিলে প্রাসাদটি ভিন্ন এক পরিবেশ সৃজন করেছে। চীনের শৃঙ্খলাও তাঁকে মুগ্ধ করেছে যার সঙ্গে ছিল সততা। চীনের জনসাধারণের সততা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন।

শেখ মুজিব পিকিং শান্তি সম্মেলন গিয়ে অংশগ্রহণের পাশাপাশি তিনি ঘুরে দেখেছেন এই রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চল। যা দেখে একটি রাষ্ট্র তার প্রকৃতি, রাজনীতি ইত্যাদি অতি সহজেই বোঝা যায়। তিনি এই ভ্রমণে পে ইয়ং পার্ক ও স্বর্গ মন্দির দেখেছিলেন। চীন দেশের লোকবিশ্বাস বিষয়েও তাঁর পাঠকদের জানিয়ে দেন। তিনি জানান যে স্বর্গ মন্দিরে চীনের লোকেরা পূজা দিত যাতে ফসল ভালো হয়। শান্তি সম্মেলন শেষ হওয়ার পর চীনের শিল্প-কারখানা, কৃষকের অবস্থা, সাংস্কৃতিক মিলনের স্থান ও জাদুঘর দেখার জন্য আরও কয়েকদিন থেকে যান। এখানে তিনি জাতীয়তার পরিচয় পান। চীনে কোথাও দাড়ি কামানোর জন্য ব্লেড পাননি। কেননা সেখানে ব্লেড উৎপাদনের কারখানা নেই। শুধু ব্লেড কেন, চীনের তৈরি সিগারেট ছাড়া আর কোনো সিগারেট পাওয়া যায় না। আমরা পাঠ করতে করতে বুঝে নেই একটি রাষ্ট্র কেমন করে তার উঠে দাঁড়ানোর পথ পায়।

পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা পীর মানকী শরীফসহ নানকিং শহরের সান ইয়েৎ সেনের সমাধি দেখতে যান। উল্লেখ্য নানকিং এক সময় চীনের রাজধানী ছিল। সান ইয়েৎ সেন চীনের রাজবংশের শাসন অবসানের অন্যতম বিপ্লবী নেতা। এই সফরের উল্লেখযোগ্য পর্ব হচ্ছে সাংহাই ভ্রমণ। এই শহরের নতুন চীনের কলকারখানা তারা ঘুরে দেখেন। জাতীয়করণকৃত এই কারখানাসমূহ শ্রমিক মালিক আবার কোনটি সরকারি পরিচালনায় চলছে। শ্রমিকদের স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়েছে সর্বাগ্রে।

প্রতিনিধিদল একটি শ্রমিক পরিবারে গমন করে। এখানে তাদের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়। শেখ মুজিবুর রহমান নববিবাহিত এই শ্রমিক পরিবারের বধূর হাতে নিজের আংটি উপহার দেন। নববধূকে প্রথম দেখায় উপহার দেওয়ার প্রচলন তিনি বিদেশে গিয়ে ভুলে যাননি। তাই চীনে দেখা নববধূকে নিজের আঙুলের আংটি উপহার দিয়ে নিজ সংস্কৃতিকে যেমন প্রকাশ করেছেন তেমনি এর চর্চাও করেছেন। নারী শ্রমিক ও তার স্বামী পরদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে ‘লিবারেশন পেন’ উপহার দেন।

সাংহাই থেকে হ্যাংচো গিয়ে সেখানকার প্যাগোডা ও হ্রদ দেখেন। তিনি ভ্রমণের বর্ণনা লেখার সময় বিস্তারিত লিখেছেন। বিশেষ করে জীবনযাত্রা, রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব আলোচনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জীবনকে তিনি তাঁর লেখায় তুলে এনেছেন। আমরা তাঁর লেখা থেকেই জানতে পারি হ্যাংচোয় মেয়েরা নৌকা চালায়। এই শহরের বর্ষাকালের একমাত্র বাহন নৌকা। শেখ মুজিব এখানে নৌকা চালিয়ে হৃদের দ্বীপে যান। এখানে ভুলে যাননি যে তিনি পানির দেশের মানুষ। চীনের সাধারণ জনগণের দেশপ্রেম ও সরকার পরিচালকদের জনগণকে রাষ্ট্রের নানা কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তকরণ মুগ্ধ করেছে পূর্ববাংলা থেকে যাওয়া এই রাজনৈতিক নেতাকে।

পিকিং শান্তি সম্মেলনে সাইঁত্রিশটা দেশের প্রতিনিধি যোগ দেয়। তিনশ আটাত্তর জন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আতাউর রহমান ও শেখ মুজিবুর রহমান বক্তব্য উপস্থাপন করেন। ভাষা-আন্দোলনের স্মৃতি জাগরুক তাই তিনি ইংরেজি নয়, বাংলায় বক্তৃতা দিলেন। যা বাংলা-ভাষাভাষীদের মাঝে প্রবল আলোড়ন তৈরি করেছিল। নিজের বাংলায় বক্তৃতা প্রদানের কারণ হিসেবে তিনি রচনা করেন: ‘পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য।; [অ আ ২২৮]  সম্মেলনের প্রতিনিধি পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক মনোজ বসু তাঁকে জড়িয়ে ধরেন। শেখ মুজিবুর রহমানের সফরসঙ্গী খন্দকার ইলিয়াসও আবেগাপ্লুত হয়ে যান। এই সাইঁত্রিশ দেশের প্রতিনিধি একজন বাঙালির কাছে শোনে শান্তির কথা তাও বাংলায়। অবশ্য বহু বছর আগে শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের কল্যাণে বাংলার সঙ্গে যোগ ঘটেছিল চীনের।

সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধি ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা পরস্পর পরস্পরকে দাওয়াত দিয়ে আপ্যায়ন করেন। একই সঙ্গে রুশ প্রতিনিধিদের দাওয়াত করা হয়। এই দাওয়াতে আসেন আইজ্যাক আসিমভ। যিনি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী রচনার জন্য বিশ্বময় খ্যাতিমান। একই সঙ্গে আলাপ হয় তুরস্কের বিখ্যাত কবি নাজিম হিকমতের সাথে। তিনি কমিউনিস্ট মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তুরস্ক থেকে বিতাড়িত হয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই সম্মেলনে অনেক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তবে যে বিষয়টি উল্লেখের দাবি রাখে তা হলো এ সময় মাদাম সান ইয়েৎ সেনের সঙ্গে দেখা করেন শেখ মুজিব ও খন্দকার ইলিয়াস।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ মার্চ ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়