ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ভিয়েতনামের পথে : ২০তম পর্ব

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ২৭ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভিয়েতনামের পথে : ২০তম পর্ব

ফেরদৌস জামান : কারেন বসতিতে মনকে বেশিক্ষণ টেকানো গেল না। যতক্ষণ অবস্থান করলাম তার সম্পূর্ণটাই ছিল ভিষণ নিস্প্রাণ। ঘুরে ফিরে বারবার শুধু তিনটি মেয়েকে আর কতক্ষণ দেখা যায়।

যাক সে কথা, এখন যেতে হবে মে ইয়েন ঝরনায়। বেলা বোধহয় এগার কি বারটা বাজে। অর্থাৎ, দিনের অর্ধেক গত হয়ে গেছে। হঠাৎ দেখা পাওয়া সেই অশীতিপর তরুণ দম্পতির দেওয়া তথ্য মোতাবেক বাকি সময়টা ঝরনায় যাতায়াতের জন্য যথেষ্ট। বসতি থেকে বেরিয়ে আবারও এসে পথে উঠলাম।

পাথুরে মেঠো পথ। তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা সেই সরু খাল। দুই পাশটা পাকা করে বাঁধানোর ফলে এটাকে পরিস্কার পানির নালা বলা যেতে পারে। মাঝে মধ্যে কাঠের কবাট দিয়ে অর্ধেক পানি আটকানোর ব্যবস্থা এবং পানির ধারার কিছু উঁচুতে দেয়াল ফুটো করা। সহজেই বোঝা যায় এই পানিতে অত্র এলাকার ক্ষেতে সেচের ব্যবস্থা হয়ে থাকে। পথ চলতে চলতে খালটা যে কখন আপন পথ ধরে অন্যদিকে হারিয়ে গেছে তা খেয়াল করা হয়নি। সামনেই পথের শেষ।

জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে স্বচ্ছ পানির উন্মুক্ত ধারা।  পথের শেষ প্রান্তকে স্পর্শ করে ডানদিকে বাঁক নিয়ে আবারও এগিয়ে গেছে আপন খেয়াল মত। সামনে গিয়ে হয়তো এই খালই বাঁধা পরেছে ইট সিমেন্টের অনুচ্চ দেয়ালের মধ্যে। এই খানটায় অর্থাৎ রাস্তার শেষ প্রান্তে একটি স্কুটি দাঁড় করানো কিন্তু তার চালকের কোনো হদিস নেই। উভয়পাশের পাহাড়ে ঘন বৃক্ষ। তার মাঝখান দিয়ে এগিয়ে এসেছে ছোট্ট এই খাল। কাঁপা কাঁপা স্বচ্ছ পানির নিচে বালি কণা ও ছোট পাথর খণ্ডগুলো কি চমৎকার করে তাকিয়ে আছে।

 



মানচিত্র দেখে বুঝে নিলাম এই খালটার ঠিক উজানেই আমাদের পথ। কিন্তু তার আগে আমাদেরকে যে বিষয়টি মোটামুটি ভাবনায় ফেলে দিল তা হল এই বনের মাঝে একাকি স্কুটি। এদের সমাজে চুরি-ডাকাতি বলে বিষয়টি আসলেই নেই! নিরব জঙ্গলের মধ্যে পরে থাকা একাকি এক স্কুটি দেখে মনের মধ্যে এমন প্রশ্ন দেখা দিতে পারে কী না? অধিকন্তু এই ঘটনাকে কী তাদের সমাজ বৈশিষ্ট্যের একটা উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করা যায় না? বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এমন ঘটনা আমার নিকট এক রকম বিস্ময়করই মনে হয়েছে। কারণ আমার সমাজ বাস্তবতা আমাকে অতি সাধারণ এই ঘটনায় আমাকে বিস্মিত হওয়ার শিক্ষাই দিয়েছে। পরিস্থিতিটা আর একটু গভীর করে ভাবতে গিয়ে নিজের কাছে তা যেন লজ্জার কারণ হিসেবে আভির্ভূত হল।

বুট জোড়া খুলে পলিথিনে ভরে হাঁটা ধরলাম রাবারের চপ্পল পায়ে দিয়ে। এই পাদুকা জোড়া যে, কত দিন সেবা দিয়ে আসছে তা সঠিক মনে নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের রোয়াংছড়ি বাজার থেকে কেনা ১৪০ টাকার চপ্পল, তাও বোধহয় বছর দুই হয়ে গেছে, পাহাড়-পর্বত আর খাল-খাড়ি যেকোনো জায়গায় একেবারে বুলডোর সম। পানি কেটে এগিয়ে চলছি উজানে। চারদিক থেকে নেমে আসা লতাপাতা তার আপন খেয়ালে পথকে এমনভাবে ঢেকে দিয়েছে যে, কিছুদূর পর্যন্ত কোমর হেলেই এগিয়ে যেতে হল। অন্ধকার প্রায় বেশ ঠান্ডা জায়গা, পায়ের নিচে রঙিন পাথর কুচি। একটু আগে চপ্পল জোড়া খুলে নিয়ে খালি পায়েই চলছিলাম কিন্তু পাথর কুচির সরু মুখগুলোর আঘাতে মনে হচ্ছিল পায়ের তলা ফুটো হয়ে রক্তের ফিনকি বেরিয়ে আসবে। ওদিকে মোবাইল ফোন দিয়ে সুজিৎ ভিডিও করেই চলেছে। মে ইয়েন ঝরনার ওপর একটা প্রমাণপত্র বা ডকুমেন্ট করবে। এ যেকোনো দিনই হবার নয় তা আমার জানা।

সে কথা জেনেও ওর আগ্রহে সাড়া দিয়ে নিজেকেও দু’চারটা কথাবার্তা বলে যেতে হচ্ছে। ভিডিও ক্যামেরায় গভীর মনোনিবেশের ফলে প্রমাণপত্রকার কয়েকবার চিৎ হয়ে উল্টেও পড়লেন, তবুও ছাড়বার নয়। যত এগিয়ে যাচ্ছি বন গভীর হয়ে আসছে। এত সুন্দর বন, বোধহয় কোনোদিন একটি গাছের গোড়াতেও কুঠারের আঘাত পড়েনি। বৃহৎ বৃক্ষগুলো থেকে লতা নেমে এসেছে মাটিতে। একেকটি লতা মানুষের উরুর মত মোটা। বৃক্ষ লতাপাতা একেবারে ঘন জঙ্গল, যার দরুন আশপাশে কোন দিকেই এক দুই মিটারের অধিক দৃষ্টি প্রবেশ করানো দায়।

কতবার যে খালটা পারাপার করতে হচ্ছে তা হিসেবের বাইরে। এদিকে একে খাল আরো সুন্দর ও আকর্ষণীয় রূপ নিয়েছে। কিছু জায়গায় একে ছোট্ট নদীর মত লাগছে। ছোট বাড় পাথরগুলো খালের বুকজুড়ে ছরিয়ে রয়েছে। পানির ছলছলে প্রবাহ তাতে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে প্রতিনিয়তই তৈরি হচ্ছে চিরাচরিত ছলছল, সোঁ সোঁ শব্দ। জায়গায় জায়গায় খালের পাড় ধরে পাথুরে খাড়া দেয়াল, আবার সমতল; জঙ্গলাকীর্ণ।

 



অথবা অনেকক্ষণের জন্য স্বচ্ছ পানির ধারা সে নিজেই পথ থেকে হারিয়ে গেছে। কোনো কোনো জায়গায় স্যাঁতস্যাঁতে দেয়ালে এক দুইটা খাঁজ, যাতে কোনোমতে শুধু পায়ের অগ্রভাগটা ঠেকিয়ে লতায় ঝুলে এগিয়ে যেতে হয়। এখন পর্যন্ত একটি মামুষেরও দেখা মিলল না। লিকলিকে ট্রেইল ছাড়া ভরসা করার মত তেমন আর কিছু নেই। কেবল তাকে অনুসরণ করেই মে ইয়েনের দিকে ছুটছি। জঙ্গলের পিনপতন নিরবতায় শুধু তিন ধরনের শব্দ-খালের বয়ে যাওয়া, ক্ষণে ক্ষণে পাখির কুজন এবং আমাদের দুই জোড়া পায়ের স্পর্শে লতাপাতার কেঁপে ওঠা।

অনেকটা পথ অতিক্রম করেছি। বারবার অনুমান করছি এইতো আর বোধহয় মিনিট বিশেকের মধ্যে ঝরনা পেয়ে যাব। এমন করে যে কত অনুমান চলতি পথের সাথে একাকার হয়ে গেল তার ঠিক নেই! পথে একটা মাচা পেয়ে এখানেই বসে কিছু খেয়ে নিলাম। বাঁশের তৈরি মাচা, মাথার ওপর একটা ছাউনিও দেওয়া আছে। ভোর থেকে শুরু করে যতটা হাঁটলাম শরীর চাইছে এই শান্তির নিবাসে শরীরটাকে কিছুক্ষণের জন্য গড়িয়ে নেই। কোনো এক টুর অপারেটরের কাছে থেকে জেনেছিলাম ঝরনা আগে বেশ উঁচু একটা পাহাড় ডিঙাতে হবে। এখনও জানি না কতদূর সেই উঁচু পাহাড়। আরো কয়েকবার খালের এপার-ওপার হয়ে উপস্থিত হলাম পাহাড়টার গোড়ায়। ট্রেইল যেভাবে তির তির করে আকাশের দিকে ওঠে গেছে তা দেখে ধারণা করা যায় এই সেই পাহাড়। আরোহণ করতে গিয়ে পাহাড়ের সেই চিরাচরিত স্বভাবের পরিচয়টা এখানেও পেলাম, শুধু উঁচু নয় বরং অনেক উঁচু! সে আর শেষ হতে চায় না।

উঠতি পথের হঠাৎ বাঁকটায় বিপরিত দিক থেকে সামনে এসে হাজির এক ইয়োরোপিয়ান, সাথে একটা কুকুর। আমরা দুজন চমকেই উঠলাম! এতক্ষণ তো ভেবেছিলাম মে ইয়েনে আজ আমরাই একমাত্র দর্শনার্থী। কয়েক কথায় উন্মোচন হল খালের মাথায় একাকী স্কুটি রহস্য। এই লোকটি সেই স্কুটির মালিক। পথে যেহেতু ঝরনা ফেরৎ একজনের সাক্ষাৎ পাওয়া গেল, সেহেতু তার সাথে কথা বলে কিছু জেনে নেওয়া উচিৎ। তার পক্ষ থেকেও ইতিবাচক মনোভাব আন্দাজ করা গেল। কথার মাঝে বারবার এসে ঢুকে পড়ছে কুকুরের প্রসঙ্গ।

লক্ষ্য করলাম অন্যান্য কথার পাশাপাশি কুকুর বৃত্তান্তে তার আগ্রহ অধিক। কুকুরের প্রসঙ্গকে সংক্ষিপ্ত রূপ দিলে যা হয় তা হল, সেই পাই থেকে নাকি পিছে পিছে আসছে। একটু আদর-সোহাগ পেয়ে এখন সে পিছে নয় আগে আগে পথ প্রদর্শকের ন্যায় এগিয়ে যাচ্ছে। লোকটির কথায় এত তৃপ্তি আর সন্তুষ্টির বহিপ্রকাশ যেন দেশে ফেরার সময় ওকে সাথেই নিয়ে যায়। তার দেওয়া দিক নির্দেশনা মোতাবেক পাহাড় টপকিয়ে হলকা ঢালু ট্রেইলে নিচে নামার জন্য হাঁটতে হল বিশ মিনিটের মত।

 



কানের আয়োতার মধ্যে ধরা দিল এক সুমধুর ধ্বনি। হালকা করে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। জঙ্গলের ঘন স্তর আর টালমাটাল বাতাস ভেত করে সেই ধ্বনি যেন কত লক্ষ মাইল দূর থেকে ভেসে আসছে! একটু পর বৃক্ষের ফাঁক গলে দেখা দিল কালো কুচকুচে পাথরের দেয়ালে স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠা সাদা ধবধবে ঝরনা মে ইয়েন। কাছাকাছি যেতেই ছুঁয়ে গেল এক শীতল বাতাসের হল্কা। সবুজে ঘেরা পাহাড়ের মাথা থেকে মে ইয়েন অনর্গল গতিতে ঢেলে দিচ্ছে সাদা সাদা পানি। জনমানুষের চিহ্নটি নেই, পাখির গুঞ্জন থেমে গেল, বৃক্ষরাও যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আমাদের উচ্ছাস যেভাবে প্রকাশ পাবার কথা; হল ঠিক তার উল্টোটা। জলের অজস্র ধারা এবং তার চারপাশের আয়োজন যেন আমাদেরকে নির্বাক, নিস্তব্ধ করে দিল। কিছুক্ষণ পর চলে এলো কানাডিয়ান দুই বন্ধু এবং এক প্রেমিকযুগল। পরবর্তীতে এদের উভয়দলের সাথে থাইল্যান্ডের অনেক জায়গাতেই দেখা হয় এবং বহু অভিজ্ঞতার মাঝ থেকে বারবার মে ইয়েনের কথাই রোমন্থিত হয়েছে। একটু পর চলে এলো আরো  কয়েক জন। বেসামাল আবেগের চোটে সংক্ষিপ্ত ধরনের পোশাক পরে তৎক্ষণাত নেমে পড়ল পানিতে। এদিকে এক পর্ব ভেজাভিজির পর আমরা সম্মুখের পাথরটায় বসে পাউরুটি-কলা খাওয়ার কাজ সেরে নিচ্ছি আর বিদায়ের কথা ভাবছি।

আরো পড়ুন :



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ মার্চ ২০১৮/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়