ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ফকিরের ডেরায়

সুমনকুমার দাশ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৩, ১০ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফকিরের ডেরায়

আরকুম শাহ’র মাজারে বিভিন্ন কাফেলায় বসেছে গানের আসর। ছবি : লেখক

সুমনকুমার দাশ : বাতাস কেটে কেটে চলছে আমার মোটরবাইক। পেছনে বসা চম্পকদা। এই মাঝরাতে ঘন অন্ধকার ঠাওরে তিনিই পথ বাতলে দিচ্ছিলেন। পেছনের বাইকে লিটনদা আর মামুন। অলিগলি পেরিয়ে ভাঙাচোরা রাস্তা মাড়িয়ে যখন সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার ধরাধরপুর গ্রামে পৌঁছলাম, তখন রাত সাড়ে ১২টা। চতুর্দিকে মানুষ আর মানুষ। পির-ফকির-মস্তান-আশেকানদের ভিড়।

কাফেলা ঘিরে রয়েছে উৎসুক মানুষের জটলা। মন্দিরা-ঢপকি-ঢোল-বাঁশির ধ্বনি কেমন যেন মনকাড়া এক সুরেলা শব্দ তৈরি করে। এ-রকমই এক কাফেলায় যেতে ভিড় ঠেলেঠুলে যখন আমরা এগুচ্ছিলাম, তখনই কানে বাজে মাইকের আওয়াজ, ‘আরকুম শাহের কালামের বই মাত্র ত্রিশ টাকা। শেষ হওয়ার আগেই কিনুন।’ অন্য কোনো সময় আরকুম শাহ’র গানের অর্থাৎ কালামের একটি বই সংগ্রহ করব মনস্থির করে সামনে এগোই। প্রথমেই চোখে পড়ে সুদৃশ্য এক ভবন, যার ভেতরেই শায়িত রয়েছেন মরমি কবি ও সুফি সাধক আরকুম শাহ (১৮৫১-১৯৪১)। ভবনে ঢুকতেই দেখি, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আরকুমের কবর জিয়ারত করছেন, কবরের পাশে মোমবাতি-আগরবাতি জ্বালাচ্ছেন, আবার কেউ কেউ কবরের ওপরে পেতে রাখা গিলাফে গোলাপ জল ছিটিয়ে দিচ্ছেন।

ভবনের ভেতর ঘুরে দেখতে থাকি। দুটো কক্ষ। একটি কক্ষে শায়িত রয়েছেন আরকুম শাহ, অন্যটিতে তাঁরই অন্যতম প্রধান তিন খলিফা/শিষ্য হজরত সুফি শাহ কাছিদ উল্লাহ, হজরত ইব্রাহিম আলী আর হজরত সুফি শাহ আব্দুল মুতলিবের কবর। যে কক্ষে আরকুম শাহ’র কবর, সেটির এক কোণে বসে জনাচারেক ব্যক্তি মোম আর আগরবাতি বিক্রি করছেন। আন্দাজে বোঝা যায়, বিক্রেতাদের সবাই মাজার পরিচালনা কমিটিরই লোক।এঁদেরই একজন জানালেন, প্রধানত পির-ফকির-সুফি-দরবেশ-মুর্শিদে কামেল-ওলিদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁদের শিষ্য-ভক্ত-আশেকানদের উদ্যোগে ওরস হয়ে থাকে। সে হিসাবে এবার আরকুম শাহ’র ৭৬তম ওরস পালিত হচ্ছে।এসব কথার ফাঁকে হঠাৎ সামনে তাকাতেই দেখি, কয়েকজন ব্যক্তি আরকুমের কবরে লাল রঙের গিলাফ দিচ্ছেন।গিলাফ পাতা শেষে তাঁরা কবরের ওপরে গাঁদা ফুলও ছড়িয়ে দেন, সেই সঙ্গে ছয়টি মোমবাতি আর দুই প্যাকেট আগরবাতি জ্বালানো শেষে গোলাপজল ছিটান। সেসব কাজ শেষ করে কবরের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরা মোনাজাত শেষে কক্ষ থেকে বেরোনোর প্রস্তুতি নেন। এ পর্যায়ে তাঁদের যাত্রাপথের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করি, কতদিন ধরে আসছেন? এর জবাবে সিলেটের ভার্তখলার বাসিন্দা মো. সিরাজ মিয়া নামের ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিটি বললেন, ‘১৯৭২ সাল থেকে এখানে আসছি। ৪৬ বছর ধরে আরকুম শাহের মাজারে গিলাফ দিচ্ছি।’

 


মাজারে কাফেলায় গান গাইছেন এক নারী ভক্ত


মাজারের ভেতরে দাঁড়িয়ে পেশায় ব্যবসায়ী ভার্থখলার সিরাজের সঙ্গে যখন আলাপটা বেশ জমে ওঠে, তখন অনেকটা আচমকাই যেচে যেচে আলাপে যোগ দেন মাজার পরিচালনা কমিটির সদস্য পরিচয়দানকারী খোজারখলা গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব আলী হোসেন মতিন। তিনি জানান, ৩৩ বছর ধরে তিনি নিয়মিতভাবে ওরসে আসছেন। দেশ-বিদেশের নানা অঞ্চল থেকে ভক্ত-আশেকানরা এসেএখানে গিলাফ বিছিয়ে থাকেন। প্রতিবছর গড়ে ৮০ থেকে ৮৫টি গিলাফ বিছানো হয়। আন্তরিক আলাপের বদৌলতে আলী হোসেন মতিন মুহূর্তেই আমাদের কাছে ‘মতিনভাই’ হিসেবে অভিধা পেয়ে যান। সেই মতিন ভাই আমাদের নিয়ে গেলেন ‘সুফি শাহ আরকুম আলীর (রহ.) আসন কোঠা’য়, যেখানে আরকুম শাহ বসে ধ্যান করতেন।সুফির সেই ডেরায় ঢুকে আরকুমের ব্যবহৃত খিরকা, লাঠি, উলের টুপি, চশমা, দোতরা, হুক্কা, আসন, জায়নামাজ আর বেশ কিছু কিতাব দেখে মনে তৃপ্তি ভাব এলো। মনে সেই পরিতৃপ্তি নিয়ে মাজারের বাইরের খন্ড খণ্ড কাফেলার দিকে রওয়ানা দিই।এপাশ-ওপাশ চারপাশ থেকে গান, হট্টগোল আর বাদ্যের শব্দ কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। এত এত শব্দ উপেক্ষা করেও এক কাফেলায় অসংখ্য তরুণ-তরুণীদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আপনমনে নেচে-গেয়ে যাচ্ছিলেন দুজন বয়স্ক ব্যক্তি। গানের সঙ্গে বাজছিল মন্দিরা-ঢপকি আর কাঠিঢোল। আমি গিয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়াই। ওরা অনবরত ডানে-বামে মাথা দুলাচ্ছিলেন আর গাইছিলেন :

সোনারও পিঞ্জিরা আমার, করিয়া গেলায় খালি রে

হায় রে আমার যতনের পাখি

সুয়া রে, একবার পিঞ্জিরায় আও দেখি ॥

আর, আজ্ঞামতে এই দেহাতে করলায় পরবাস

এখন মোরে ছাড়িয়া গেলায় করিয়া নৈরাশ রে ॥

 

আর, যেই কোঠায় থাকিয়া তুমি সদায় কইলায় খেলা

সেই কোঠারও মাঝে আমার লাগিয়া গেল তালা রে ॥

 

আর, তুমি আমি একই ঘরে ছিলাম এতদিন

আজি হইতে ভিন্ন ভিন্ন পিঞ্জিরা মলিন রে ॥

 

আর, পাগল আর কুমে কয় মিছা ঘরবাড়ি

সুয়াপাখি উড়িয়া গেলে পিঞ্জিরা রয় খালি রে ॥

 


আরকুম শাহ’র কবর



গান শেষ হলে ওই বয়স্ক দুই ব্যক্তির মুখোমুখি হই।এঁদেরই একজন মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব আবদুর রউফ। তাঁর নামেই এ কাফেলা। এতক্ষণ সেই কাফেলা ঘিরেই ছিল জনাপঁচিশেক মানুষের জটলা।নারী-পুরুষ সবাই মিলে তাল বাদ্যের সঙ্গে নেচে-গেয়ে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার চেষ্টায় রত ছিলেন। রউফ জানালেন, তিনি তৈমুছ শাহের মুরিদ। আরকুম শাহ তাঁর দাদা-পির। প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি এখানে কাফেলা বসাচ্ছেন। বলেন, ‘ওলি-আউলিয়ার মাজারে যাই। যদি আল্লা আসি ধরা দেয়, এই আশায় মাজারে মাজারে ঘুরি ফিরি। ইবাদত-বন্দনা-জিকির করি। দোয়া-দুরুদ পড়ি। আর মনের আনন্দে কালাম মুখে নিই, কালামের মাধ্যমে আল্লারে বন্দনা করি।’ রউফই জানালেন, আরকুম শাহ নানা পর্যায়ের গান রচনা করেছেন। এর মধ্যে আল্লাহ বন্দনা, মুর্শিদ বন্দনা, মনঃশিক্ষা, দেহতত্ত্ব, সুফিবাদ, সৃষ্টিতত্ত্ব, নবিতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, বিচ্ছেদ উল্লেখযোগ্য। পাশ থেকে হ্যাঁ-সূচক মাথা দুলিয়ে রউফকে সমর্থন দেন একই কাফেলার সহচর পাঁচগাঁওয়েরই সত্তরোর্ধ্ব আছকির মিয়া। তাঁদের সঙ্গে আলাপ সেরে আরও সামনে যাই। আরেক কাফেলায় দেখি, বেশ কয়েকজন বৃদ্ধগোছের লোক চোখ বুজে সমস্বরে গাইছেন, ‘তোরা আও রে ভাই, খাজাসাবের গুণ গাই’। তাঁদের প্রত্যেকের গলায় লাল-সাদা কাগজের মালা। তাঁরা দীর্ঘক্ষণ ধরে গাইলেন শিতালং শাহ, দীনহীন, আরকুম শাহ, শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহদের দেহতত্ত্ব ও মুর্শিদি পর্যায়ের গান।

কাফেলাটি যৌথভাবে বসিয়েছেন সিলেটের ফতেপুরের পঁচাত্তর বছর বয়সী মো. দুদুমিয়া ও ছাপ্পান্ন বছর বয়সী সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার বড় কুরমা গ্রামের সাইফুল আলম জালালী। ২০ বছর ধরে তাঁরা এই কাফেলা বসিয়ে আসছেন। এ কাফেলাতেই আলাপ হয় পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী সিলেটের ওসমানী নগর উপজেলার তাজপুরের বাসিন্দা শিল্পী মো. আনোয়ারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভাবের টানে, দেহের টানে মাজারে মাজারে ঘুরি, গান গাই। আমি জানি, আল্লা পাইতে হইলে নবী পাইতে হইব, নবী পাইতে হইলে মুর্শিদ পাইতে হইব। সেই মুর্শিদের সন্ধানেই আছি এখন আমি।’ এ কথা বলেই তিনি আপন মনে ধরেন দীনহীনের লেখা গান:

‘মুর্শিদ ধরিয়া যে জন করে অবহেলা

তারে বানায় আল্লা আজাজিলের ঘোড়া’

 


আরকুম শাহ’র আসন



একই কাফেলায় অবস্থান নেওয়া বিশ্বনাথ উপজেলার পিঠাকড়া গ্রামের মাসুক মিয়া ও বড় কুরমা গ্রামের মঞ্জুরুল ইসলাম আল্লাকে পেতে মুর্শিদের দেখানো পথে পা বাড়িয়েছেন বলে জানালেন। তাঁদের সঙ্গে আলাপ শেষ করে অন্য কাফেলার দিকে ছুটতেই কানে বাজল রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থের একটি বহুল জনপ্রিয় গান।চমকে উঠলাম, ফিরে তাকালাম পেছনে। দেখি, মন্দিরা বাজিয়ে মো. আনোয়ার গাইছেন রাধারমণের গান। পাশে গোল হয়ে আশেকান-মুরিদ-ভক্তেরা অবতীর্ণ হয়েছেন দোহারের ভূমিকায়। ভাবি, কী বিচিত্র এই লোকবাংলার লোকভুবন! আর বিচিত্র বলেই তো ওরসে আল্লার নৈকট্যলাভের প্রত্যাশায় মগ্ন আশেকানরা বৈষ্ণব সহজিয়া এক সাধকের গান কণ্ঠে তুলে নিতেও কোনো রকমের দ্বিধা বোধ করেন না।সুফিবাদ আর চৈতন্যবাদ মিলেমিশে কত একাকার এখানে! তাঁদের কাছে যে জাতপাত বড়ো বিষয় নয়, সেটা এ ঘটনা থেকে সহজেই অনুমান করা সম্ভব, আর লৌকিক ধর্মের আসল প্রাচুর্যটাই বোধ করি এটা!

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়