ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

প্রজাপতির পাখায় উড়ে ঘুরে এলাম ভুটান : শেষ পর্ব

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২১, ৪ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রজাপতির পাখায় উড়ে ঘুরে এলাম ভুটান : শেষ পর্ব

শিহাব শাহরিয়ার : চেলালাপাস থেকে নেমে আবার পারোর দিকে আমরা যেতে থাকলাম। যেতে যেতে ওয়েংডি এক জায়গায় গাড়ি থামাল, হাতের ইশারায় দেখাল একটি চমৎকার আপেল বাগান। এই প্রথম পূর্ণাঙ্গ একটি বাগান দেখে মন ভরে গেল। লাল ও সবুজ রং ধারণ করে অসংখ্য আপেল ধরে আছে গাছের ডালে ডালে। আহা দারুণ! এরপর ক্রমশ নিচের দিকে নামতে নামতে এলাম পারোর মূল শহরে। তখন সন্ধ্যা। সারা শহর নিয়নের আলোয় ফুটে উঠেছে। তারপরও কেমন জানি এক ধরনের নির্জনতা, শান্ত পরিবেশ। আর এর সব কিছু ছাপিয়ে গেছে চাঁদের আলোর ঐশ্বর্যের ভিতর কল্লোলিত নদীর একটানা ছুটে চলা।

আমরা এসে নদীর পাড়ে বসলাম। নদীর জলের শব্দ আবারো আমাদের আন্দোলিত করে তুললো। বেশ কিছুটা সময় বসে থেকে, হাঁটাহাঁটি করে পারো জং দেখতে গেলাম। জং মানে ভুটানের প্রশাসনিক ভবন এবং উপাসনালয়। এই জং থিম্পু ও পুনাখাতেও রয়েছে, যেখানে বসে রাজাসহ সরকারের লোকেরা প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। নদীর পাড় থেকে জংটি দেখতে অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছিল। চমৎকার লাইটিং করা। আমরা নদীর এক পাড় থেকে কাঠের ব্রিজ পার হয়ে অন্য পাড়ে আলোকিত জং ভবনের কাছে গেলাম। এরপর ফিরে এলাম আমাদের টাউনভিউ রিসোর্টে।



পরদিন বেরিয়ে গেলাম টাইগারনেস্ট দেখার উদ্দেশ্যে। এই টাইগারনেস্ট ১১ হাজার ফুট উঁচু একটি পাহাড়, যার চূড়ায় একটি বহু প্রাচীন আমলের একটি পাকা দালানের মন্দির আছে। টাইগারনেস্টকে ভুটানিজরা বলে তাকসাং মনেস্ট্রি। কথিত আছে, গুরু পদ্মসম্ভবা তিব্বত থেকে বাঘিনীর পিঠে চড়ে এইখানে এসে, এক গুহাতে বসে একটানা তিন মাস ধ্যান করেন। তাকে দ্বিতীয় বুদ্ধ বলা হয়। তিনি বেঁচে ছিলেন অষ্টম শতাব্দীতে আর এই টাইগারনেস্ট হয়েছে তারও নয়শ বছর পর। তাহলে? জানা যায়, পদ্মসম্ভবার জন্ম পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকার এক গ্রামে, সেখান থেকে যান তিব্বতে, মৃত্যুবরণ করেন ভারতে। তিনি ভুটানসহ এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন। কথিত আছে যে, তিনি ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে একেক সময় এক জনের দেহ ধারণ করে মর্তে বাস করতেন। চতুর্থ দেবরাজা তেনজিং ১৬৯২ সালে পারোতে এই মনেস্ট্রি বা টাইগারনেস্ট তৈরি করেন। বলা হয়, পদ্মসম্ভবা দেবরাজা তেনজিং-এর দেহ ধারণ করে এটি তৈরি করেন। তাকে নিয়ে আরো মজার মজার মিথ চালু আছে, যেমন- তিনি যখন গুহাতে বাস করতেন, তখন গুহার উপর দিয়ে ফুলেরা উড়ে বেড়াত আর মেঘেরা পুরাণের চরিত্র-রূপ ধারণ করে ভেসে বেড়াত। এই যে মেঘে! এই মেঘের অতলস্পর্শ এখানে মনকে মাতাল করে দেয়। সেই মাতাল নেশায় উঠতে চায়, ঐ শিখরে।

টাইগারনেস্টে ওঠা যায় দুইভাবে- পায়ে হেঁটে ও ঘোড়ায় চড়ে। তবে ঘোড়ায় চড়ে পুরোটা ওঠা যায় না। মধ্য পথে একটি ক্যাফে আছে, সেখান পর্যন্ত। আমাদের গাড়ি যেখানে থামল, সেখানে সমতল। সারি সারি অসংখ্য ঘোড়া দাঁড়িয়ে রয়েছে আর স্থানীয় অধিবাসীরা বসে আছে ছোট ছোট লাঠি নিয়ে। যারা পায়ে হেঁটে ওঠে, তারা এই লাঠি কিনে নিচ্ছে, স্থানীয় মুদ্রায় ২০-৫০ টাকা দিয়ে। আমাদের দলে ছিল ১৪ জন। আমরা সবাই লাঠি নিয়ে দুঃসাহসিক পাহাড়ে ওঠার অভিযান শুরু করলাম। কিছু দূর যেতেই দেখলাম বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি পরিবারের লোকজন নেমে আসছে। জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, উপরে ওঠা অনেক কঠিন, পারলাম না। আপনারাও পারবেন কিনা সন্দেহ! বললাম যেতে থাকি। এখানে বলে রাখি, থিম্পু, পুনাখা ও পারোতে গত কয়েক দিনে দেখা হয়েছে অসংখ্য বাংলাদেশি বাঙালিদের সঙ্গে। এদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত পরিবার ও বিভিন্ন শিক্ষালয়ের শিক্ষার্থী। এদের  দেখে মনে হলো, বাঙালি ভ্রমণপ্রিয় হয়ে উঠছে। তো আমরা উঠতে থাকলাম। অনভ্যাসের মাথা খেয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করা ভীষণ লক্ষ্য আমাদের। তবে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছে দুপুরের পূর্বক্ষণে, আর যারা ভোর-সকালে উপরে উঠেছিল, তারা এক এক করে সবাই নেমে যাচ্ছে। এরা বিভিন্ন দেশের। উঠতে উঠতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি, কিন্তু হাল ছাড়ছি না। গন্তব্যে যাওয়ার প্রবল আগ্রহ আমাদের সবার ভিতরে।



দুইপাশে অসংখ্য পাহাড়ি বৃক্ষ, ফুল, প্রজাপতি, পাখি উড়ছে, ডাকছে। আমরা কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিচ্ছি, আবার উড়ছি। প্রায় দুই ঘণ্টা পর আমরা এসে পৌঁছুতে পারলাম ক্যাফেতে। এটি একটু সমতল জায়গার ওপর ট্যুরিজম বোর্ডের সহায়তায় গড়ে উঠেছে। এখানে নানান পসরার দোকান ও খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। উঠোনের মতো জায়গায় কাঠের বেঞ্চ বসিয়ে দেয়া আছে, সেখানে বসেই কেউ খাচ্ছে, কেউ বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। এখান থেকে টাইগারনেস্ট খুবই কাছে, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বসে বসে ভাবলাম, এই এতো উপরে কেন বৌদ্ধ মন্দিরটি তৈরি করা হলো এবং কিভাবে ওতো আগে একটি পাকা দালানের মন্দির নির্মাণ করা সম্ভব হলো! আমরা এখান থেকে টাইগারনেস্টের বেশ কিছু ছবি তুললাম। কিছুক্ষণ পর আমরা ক্যাফে থেকে উপরের দিকে আবারো উঠতে শুরু করলাম। তখন দুপুরের কড়া রোদ। দেখতে পাচ্ছি দূর পাহাড়ের গা ঘেষে ভেসে যাচ্ছে সাদা মেঘের ভেলা। ভাবলাম, মানুষের ক্ষণিকের জীবন নিসর্গ ও প্রকৃতির কত অজানা সৌন্দর্য থেকেই না বঞ্চিত। এই আমরা যদি আজ টাইগারনেস্ট দর্শনের নামে বিশাল উঁচু পাহাড়ের ভিতরে যে যজ্ঞ চালাচ্ছি, তাই-ই বা কতজন পারে?

আমরা কিছু দূর এগোনোর পর থেমে গেলাম, কারণ রোদের প্রচণ্ড উত্তাপ আর শারীরিক ক্লান্তি। শুধু আমাদের দুই সন্তান প্রাচুর্য শাহরিয়ার ও সমৃদ্ধ শাহরিয়ার, আমার ভায়রা ভাই ফররুখ আহমেদ এবং তাঁর পুত্র তাহমিদ আহমেদ টাইগারনেস্টের অভিমুখে এগিয়ে গেল। আমরা বাকি ১০ জন ক্যাফেতে ফিরে এলাম। ওরা আরো প্রায় তিন ঘণ্টা পর টাইগারনেস্ট অভিযান শেষ করে ফিরে এলো আমাদের কাছে ক্যাফেতে। আমি আর আমার স্ত্রী উঠতে না পারলেও, আমাদের দুই সন্তান ওখান থেকে ঘুরে এলো, এটি অনেক তৃপ্তি পেলাম। ওদের কাছে শুনলাম, চূড়ার মন্দির ও মন্দির ঘিরে যে সৌন্দর্য তার বর্ণনা। দেখলাম ওদের তোলা অনেকগুলো ছবি। ইতোমধ্যে বিকেল পেরিয়ে গেছে। আমরা ধীরে ধীরে নামতে থাকলাম। এরমধ্যে দেখা হলো বাংলাদেশের তিন কন্যার সঙ্গে যারা বুয়েটে পড়াশোনা করে। তারাও আমাদের সঙ্গে নামতে লাগল। অবশেষে যখন নিচে নেমে এলাম তখন সন্ধ্যার ছায়া ছেয়ে গেছে অরণ্যের গহ্বরে। ওয়েংডি ওর গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে চলল পারোর টাউনভিউ রিসোর্টের দিকে। যেতে যেতে দেখলাম শহর ক্রমশ নীরব হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওয়াংচু নদীটিই একা স্বরশব্দে বয়ে চলেছে।



আমরা আবারো নদীর তীরে নামলাম, হাঁটলাম, ঝুলন্ত ব্রিজ পার হয়ে ওপর পাড়ের জ্যোৎস্না মুখরিত নির্জন পাদদেশ জুড়ে বেড়ালাম কিছুক্ষণ। এমন অনন্য নদী ইহজীবনে আর কখনো দেখা হবে কি? টাউনভিউ রিসোর্টের ভালোলাগা ছিন্ন করে পরদিন সকালের মিষ্টি রোদের ভিতর বেরিয়ে পড়লাম ভারতের সীমান্ত শহর ফোয়েন্ডশোলিং-এর উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে সেই পাহাড়, বৃক্ষ, নদী, ফুল আর প্রজাপতির পাখার রং দেখে দেখে দুপুর কোণায় এসে পৌঁছে গেলাম ফোয়েন্ডশোলিং-এ। এখানে আবারো এক রাত অবস্থান করে তিস্তা বাঁধ দেখে, দুটি সীমান্তের বেড়াজাল পেরিয়ে ফিরে এলাম আপন আলয়ে। 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ মে ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়