ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথ এখানে ‘শেষের কবিতা’ সৃষ্টি করেছিলেন

তপন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৮, ২৯ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রবীন্দ্রনাথ এখানে ‘শেষের কবিতা’ সৃষ্টি করেছিলেন

(রবীন্দ্রনাথ কেনো বার বার শিলং যেতেন: তৃতীয় পর্ব)

তপন চক্রবর্তী: গৌহাটিতে অনেক দর্শনীয় জায়গা আছে। কিন্তু আমাদের সময় নেই। গৌহাটি থেকে শিলং যাওয়ার পথে গৌহাটিতেই মাড়োয়ারিদের গড়া খুব সুন্দর, পরিচ্ছন্ন বড়-ছোট মিলিয়ে তিনটি মন্দির পরিক্রমা করি। এগুলো ‘বালাজি মন্দির’ নামে খ্যাত। মন্দিরের বিশাল প্রাঙ্গণ, শ্যামলী নিসর্গ ও শৃঙ্খলা সব মিলিয়ে সকল ধর্মের মানুষের জন্য বিনোদনের এক অনবদ্য আয়োজন। এর ঘিয়ে পাকানো খিচুরির স্বাদ ভুলবার নয়। তারপর কিছু দূরে দুপুরে এক পাঞ্জাবি ধাবায় খাওয়া সেরে উমিয়াম লেকে চলে আসি।

উমিয়াম লেক স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন লেকসমূহের মধ্যে অন্যতম। এটি পাহাড় ঘেরা। বিস্তার কয়েক কিলোমিটার। নৌকাবিহারের ব্যবস্থা আছে। পর্যটকরা মনে রাখবেন যে, এখানে রবিবার সব বন্ধ থাকে। দর্শনীর বিনিময়ে দ্রষ্টব্য স্থানগুলোও। যে কারণে আমরা অনেক দর্শনীয় স্থানে গিয়ে ফিরে এসেছি। শিলংয়ে দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো- এলিফ্যান্ট ফল, শিলং পিক, লেডি হায়দারি পার্ক, ওয়ার্ডস লেক, ক্যাপ্টেন উইলিয়ামসন সংমা স্টেট মিউজিয়াম, ডন বস্কো উপজাতীয় মিউজিয়াম, কীট-পতঙ্গের মিউজিয়াম, ক্রাইসেলিস গ্যালারি, ক্যাথেড্রাল অফ মেরী হেল্প অব ক্রিষ্টিয়ানস, সুইট ফলস ও অন্যান্য। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো মওলিনঙ (Mawlinnog) গ্রাম। এই গ্রাম শিলং থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে, ডাউকি যাওয়ার পথে। এই গ্রাম এশিয়ার মধ্যে পরিচ্ছন্নতম গ্রাম হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে।



উমিয়াম লেক থেকে গল্ফ কোর্স হয়ে আমরা ক্যাথেড্রালে পৌঁছি। গল্ফ কোর্স বসা ও বেড়ানোর সুন্দর জায়গা। এর বিশেষত্ব হলো পাহাড়ের উপরে প্রাকৃতিকভাবে উঁচু-নিচু হয়ে কৃত্রিম গল্ফ কোর্সের মতো গড়ে ওঠা। এটি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুন্দর গল্ফ কোর্সসমূহের মধ্যে একটি। এটি বিশাল জায়গাজুড়ে অবস্থিত। প্রাঙ্গণ ও ঘরগুলো ছবির মতো সাজানো ও ছিমছাম। এখানে ক্রশের সামনে ক্রুশবিদ্ধ যিশুকে কোলে নিয়ে বসে আছেন স্বর্গীয় সুষমামণ্ডিত এক নারী। রয়েছে মা মেরীর অপূর্ব সুন্দর ভাস্কর্য। প্রার্থনা গৃহ, শিক্ষার্থীর হোস্টেল, স্কুল- সব মিলিয়ে এক নান্দনিক পরিবেশ। রয়েছে নিখুঁত পরিকল্পনা ও রুচিবোধের ছাপ। শিলং-এ প্রথম দিকে আসা মূলার সাহেবের কালো পাথরের ভাস্কর্য রয়েছে। মূলার সাহেবের উক্তি খোদিত আছে। তিনি বলেছিলেন: ‘যদি খাসিয়াদের এক করতে না পারি তাহলে আমাদের এখানে আসা বৃথা।’

সন্ধ্যার ঠিক আগে ব্রাহ্ম গেস্ট হাউজে ফিরে আসি। আমি আর সুব্রত গেস্ট হাইজের রিসেপশনে এসে বসি। অন্যরা শহরে কেনাকাটার জন্য চলে যায়। আমি সুরজিত বাবুর খোঁজ নেই। রিসেপশন থেকে জানায় যে, আধ ঘণ্টার মধ্যে এসে যাবেন। মিনিট পনেরো পর তিনি এলেন। তাঁকে জানাই যে, গাড়ির ড্রাইভারসহ পথচারীদের জিজ্ঞেস করে ঠাকুরের বাসভবনের হদিশ করতে পারিনি। তিনি বললেন, গাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন? আমার হাঁ-বাচক শব্দ শুনে আমাকে বললেন, চলুন। তিনি পুলিশ বাজার থেকে রিলবং আসা যাওয়ার জন্য দুশ টাকা ভাড়ায় একটা ট্যাক্সি ঠিক করলেন। আমরা ওই ট্যাক্সিতে রিলবং পৌঁছে গেলাম। রবীন্দ্রনাথ দুই বাড়িতে আতিথ্য নিতেন। একটি ব্রুকসাইটে ও অপরটি কিঞ্চিৎ দূরে জিৎ ভূমিতে। মেঘালয় সরকার আন্দোলনের মুখে ব্রুকসাইটের বাড়ি দখল করে রবীন্দ্র মেমোরিয়েল বনাম মিউজিয়াম তৈরি করতে বাধ্য হন। এই বাড়ির মালিক বাড়ি ভেঙে কাঠামো পরিবর্তনে উদ্যোগী হলে শিলংয়ের বিখ্যাত কবি ঊমা পুরকায়স্থ ও সেন্ট এডমন্ট কলেজের অধ্যক্ষ সিলভ্যানাস ল্যামারের নেতৃত্বে ঠাকুরের বাসভবন সরকারের এক্তেয়ারে আনার জন্য আন্দেলন শুরু হয়। এর সঙ্গে খাসি কবি হেমলন ডিয়েংডো খাসিদের নিয়ে আন্দোলনে ইন্ধন যোগান। হেমলন রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’সহ অনেক রচনা অনুবাদ করেন। টেগোর’স মেমোরিয়েল প্রতিষ্ঠা তাঁদেরই আন্দোলনের ফসল। মিউজিয়াম রোববার বন্ধ। কাচের ভিতর দিয়ে দেখারও উপায় নেই। কারণ পর্দাঘেরা। সাদাসিধে আটপৌরে বাড়ি। সামনে পেছনে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। পাশে বেয়ে চলেছে ক্ষীণ স্রোতস্বিনী। সামনের প্রাঙ্গণে কবির ভাস্কর্য যেনো আমাদের আহ্বানের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। পেছনের প্রাঙ্গণে মৌন শতবর্ষী তিনটি বড় ইউক্যালিপটাস বৃক্ষ আজো কবির স্মৃতি মেখে দাঁড়িয়ে আছে।



রবীন্দ্রনাথ এই বাড়িতে বসে ‘শেষের কবিতা’ সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর বাসভবন ছুঁয়ে আমি একটু আবেগাপ্লুত হয়েছিলাম। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে দেখে সুরজিত বাবু বললেন, চলুন জিৎভূমি দেখতে যাই। ঠাকুর যেখানে বসে ‘রক্তকরবী’ লিখেছিলেন। সেই বাড়ির উত্থুঙ্গ তোরণের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। বিশাল লোহার গেট হাতি বাঁধার শিকলে বিশাল তালাবদ্ধ। এখানে কারো প্রবেশাধিকার নেই। বাড়িটি জনৈক চক্রবর্তী কিনে নিয়েছেন। বাড়ির সামনের বিস্তীর্ণ প্রান্তর উন্মুক্ত। প্রান্তর ঘিরে ঘন পাইন ও দেরদারু গাছের নিবিড় সখ্য। তোরণের ডান পাশে শ্বেত পাথরে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা রয়েছে যে এই বাড়িতে বসে কবি ‘রক্তকরবী’ সৃজন করেছিলেন। জানা গেলো স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীরা এখনো এই জিৎভূমি অধিগ্রহণ করার জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন। তবে তাঁদের অভিযোগ এই বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। এজন্য ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। সুরজিত বললেন, আপনারাও লিখুন না। গবেষকরা এখানে বিশ্বকবি সম্পর্কে আরো অনেক নূতন তথ্য পেতে পারেন।



গেস্ট হাউজে ফিরে সুরজিত বাবু আমাকে চা-পানে আপ্যায়িত করলেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি জানান যে, তাঁর বোন শিলং শহরের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট। বোনের নাম সুবর্ণ প্রভা দাস। তিনি ও তাঁর মা সারদা সুন্দরী দত্ত শিলংয়ের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার মূল কারিগর। সুরজিতের পিতামহ হার্বার্ডের ফার্মাসিস্ট। পিতা চিকিৎসক। শিলং-এ এঁদের পরিবারের সমৃদ্ধ অবদান রয়েছে। তিনিও আমার মতো লক্ষ্মীছাড়া। এখন সমাজসেবাই তাঁর ব্রত। তাঁর সম্যক পরিচয় জানার কৌতূহল থাকলেও চেপে যাই। তিনিও এই ব্যাপারে উচ্চকিত নন। ১৮৯৪ সালে এখানে ব্রাহ্ম গেস্ট হাউজের পত্তন ঘটে। এখন তিনি দেখাশোনা করেন। এখানে সর্বসাধারণের জন্য একটি রবীন্দ্র গ্রন্থাগার তিনি গড়ে তুলেছেন।



সুব্রত ডরমিটরিতে চলে যাওয়ার পর গৌতম আসে। মনে মনে আমাকে আমার সেই প্রশ্ন তাড়া করে। আমি সুরজিতকে জিজ্ঞেস করি, এই দুর্গম পথে কবি কীভাবে বার বার আসতেন! তখন তিনি কি ভেবে এক ভদ্রলোককে ফোন করলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, চলুন কাছেই এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। তিনি এই শহরের আদি লোক। তাঁর মুখ থেকে শুনবেন। গৌতমসহ আমরা হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে জানালেন হাঁটা পথের আশপাশের সকল দোকান ও সম্পত্তি আহমদ হোসেন সাহেবদের। একসময় শিলংয়ের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ভূসম্পত্তি তাঁদেরই ছিল। বুঝতে পারলাম আমরা আহমদ হোসেন সাহেবের সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছি।
(চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ মে ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়