ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মেঘের ভেতর দিয়ে আসা-যাওয়া

তপন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫১, ১ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মেঘের ভেতর দিয়ে আসা-যাওয়া

মেঘের আলয়

(রবীন্দ্রনাথ কেনো বার বার শিলং যেতেন: শেষ পর্ব)
তপন চক্রবর্তী : হাজার হাজার কোটিপতি আহমেদ হোসেনের বাসস্থান নিতান্তই একটি একতলা বাংলো বাড়ি। ঘরের আসবাবপত্রও সেকেলে। আমাদের পৌঁছার পর বেল টিপতেই ভদ্রলোক দরোজা খুলে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানান। সুরজিৎ বলেন, আহমদ হোসেন সাহেব অনন্য বড় ফটোগ্রাফার। ভারতের উত্তর পূর্ব অঞ্চলের প্রাণী ও উদ্ভিদ বিষয়ক তার ফটো সংগ্রহশালা রয়েছে।

আমাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় পর্ব শেষে আহমদ হোসেন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কি জানেন, এই শিলংয়ে বাংলাদেশের একান্ন জন তরুণ কবরে শুয়ে আছেন। এই সকল মুক্তিযোদ্ধাদের কবর তিনি নিজ হাতে দিয়েছেন। তারপর সংক্ষেপে তিনি ও সুরজিৎ বাবুর পরমাত্মীয় সাহিত্যিক ও সমাজসেবী অঞ্জলি লাহিড়ির দীর্ঘ নয় মাসে তাঁদের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভূমিকা পালনের কাহিনি শোনান। তিনি জানান যে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিনি সিলেটে ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন কর্নেল শওকত, মেজর জিয়া ও ন্যাপের আলতাফ হোসেন। অঞ্জলি লাহিড়ি বাংলাদেশের ‘আইন ও সালিশি কেন্দ্র’ প্রকাশিত ‘স্মৃতি ও কথা ১৯৭১’ শীর্ষক গ্রন্থে সিলেট-তামাবিল সীমান্তে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধে তাঁদের ভূমিকা সবিস্তার বলে গেছেন। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে সমৃদ্ধ অবদানের জন্য ২০১২ সালে আহমদ হোসেন সাহেব ও অঞ্জলি লাহিড়িকে সম্মাননা প্রদান করায় তাঁরা গর্বিত বোধ করেছেন বলে জানান।

আহমদ হোসেন সাহেব রবীন্দ্রনাথের শিলং আসার কাহিনি জানাতে গিয়ে অনুষঙ্গ হিসেবে তাঁর পরিবারের শিলংয়ে আসার কাহিনিও সংক্ষেপে বিবৃত করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ খান বাহাদুর হাজি কাশিমউদ্দিন মোল্লা ১৮৬২ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার বেগমপুর থেকে শিলংয়ের চেরাপুঞ্জি এসেছিলেন। তিনি ও তাঁর ছেলে গোলাম হায়দার চেরাপুঞ্জিতে দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যবসায় উন্নতি হচ্ছিল। এই সময় গরুর গাড়ি গৌহাটি থেকে প্যাসেঞ্জার নিয়ে শিলং আসতো। ১৮৮৭ সালে কাশেম মোল্লা ব্রিটিশ প্রশাসনকে ঘোড়ার গাড়িতে প্যাসেঞ্জার আনা-নেওয়ার প্রস্তাব দিলে প্রশাসন দুটি শর্ত দেন। প্রথম শর্ত ৮০ টি ঘোড়া কিনতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত, ১০০ কিলোমিটার পথে মোট পনেরটি আস্তাবল রাখতে হবে। কাশেম মোল্লা সেই শর্তদ্বয় পূরণ করে ঘোড়ার গাড়িতে প্যাসেঞ্জার আনা-নেওয়া শুরু করেন। তিনি ১৯০৬ সালে এই পথে অ্যালবিওন (Albion) নামের মোটর গাড়ি চালু করেন।

অ্যালবিওন মোটর

আহমদ হোসেন সাহেবের বর্তমান বয়স ৮৩ বছর। স্মরণশক্তি অসাধারণ। তাঁর ধারণা, রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মপুত্র নদ বেয়ে স্টীমারে গৌহাটি আসতেন। স্টীমার ঘাট থেকে গরু বা ঘোড়ার গাড়ি করে গৌহাটিতে অ্যালবিওনের স্ট্যান্ডে আসতেন। তিনি শুনেছেন, কবি একবার কাদায় পড়ে গিয়েছিলেন তখন তাঁকে ‘থাপি’-তে (চা-বাগানের কর্মীরা পিঠে যা বহন করেন) করে গৌহাটিতে আনা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ব্রুকসাইডের বাড়িতে (বর্তমান রবীন্দ্র মিউজিয়াম) বেশি সময় কাটিয়েছেন। তাঁর সেবাযত্ন করতেন আহমদ হোসেন সাহেবের পরমাত্মীয়রা। ১৯৭১ সালে শ্রীসতীশ জীবন দাস শিলংয়ের কমিশনার ছিলেন। তিনি এই বাড়িতে থাকতেন। তিনি চলে যাওয়ার সময় এই বাড়িটিকে টেগোর মেমোরিয়েল করার ব্যবস্থা করে যান।


আহমদ হোসেন সাহেব ফাঁকে ফাঁকে আরো অনেক কথা বলে যাচ্ছিলেন। এক সময় বলেন যে, শিলং থেকে সিলেট পর্যন্ত রাস্তা বানিয়েছিলেন এক ইংরেজ প্রশাসক। কন্ট্রাক্টর রাস্তা ঠিকমতো বানিয়েছেন কি না দেখার জন্য তিনি ড্রাইভারকে গাড়ির পেছনে রাখার ঝাঁঝড়ায় পানি ভর্তি একটি গ্লাস বসাতে বলেন। শতাধিক কিলোমিটার রাস্তা পেরোতে কোথাও যদি এক ফোঁটা পানি পড়ে তাহলে বোঝা যাবে কন্ট্রাক্টর সেইখানটায় ঠিকমতো কাজ করেননি। তিনি হাসলেন। আমরাও। মনে হচ্ছিল তিনি যেনো উত্তর পূর্ব ভারতের জীবন্ত বিশ্বকোষ। আমাদের দুর্ভাগ্য, বেশিক্ষণ বসার জো ছিল না। শিলংয়ে রাত আটটার পর খাবারের দোকান বন্ধ হয়ে যায়। আমরা তাঁকে ও মহান পরোপকারী সুরজিৎ বাবুকে বাংলাদেশে আসার অনুরোধ জানিয়ে বিদায় নেই। সুরজিৎ বাবু বললেন, আপনাদের কাল সকালে ৭টায় বেরোনোর আগে আমি বাড়ি থেকে অঞ্জলি লাহিড়ির দুটো বই পাঠিয়ে দেবো। দিয়েছিলেনও। তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ পাইনি। এখানে এসে ই-মেইল করেছি। জবাব পাইনি।

ড্রাইভারের সঙ্গে কথা ছিল সকালে দ্রষ্টব্য স্থান দেখে ডাউকি চলে যাবো। কিন্তু দেখবো কী করে! দশটার আগে কেউ কি অফিস খোলে? সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল শিলং পিক বা শৃঙ্গ দেখা। এটি এয়ারফোর্সের ঘাঁটির ভিতরে। গেইটে পাসপোর্ট, ক্যামেরা, মোবাইল জমা রেখে, বডি সার্চ সেরে ঢোকানো হয়। আমরা গেইটের কাছে গিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেখে হা-হতোস্মি হলাম। ভারতীয় ছাড়া বিদেশীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাইরে জানলাম পাসপোর্টধারী বঙ্গ সন্তানদের কেউ নিষেধ না মেনে গোপনে ছবি তোলার অপরাধে নিরাপত্তার স্বার্থে দিল্লি থেকে এই আদেশ এসেছে। আমি তোরণ পেরিয়ে ভিতরে গিয়ে অফিসারের সঙ্গে কথা বলি। তিনি বিনীতভাবে তাঁর অপারগতার কথা ব্যক্ত করেন। শৃঙ্গে প্রবীণ এক ভদ্রমহিলার দোকানে লুচি ও আস্ত ছোলার তরকারি দিয়ে নাস্তা করলাম।

এরপর এলিফ্যান্ট ফলস। কী বৃষ্টি! ছাতা আছে কেবল আমার। বাবুরা বিশ টাকা ভাড়ায় ছাতা নিয়ে জলপ্রপাত দেখতে নেমে যায়। আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম ১৯৮ টা সিঁড়ি ভেঙ্গে নামতে হবে। প্রতি সিঁড়ি উচ্চতায় দুই থেকে আড়াই ফুট। ভেবে দেখলাম নামতে হয়তো পারবো। উঠতে ভবলীলা সাঙ্গ হতে পারে। তাতে আমার কোনো ক্ষতি নেই। বিদেশ বিভূঁইয়ে সাথীরা বিপদে পড়বে। তদুপরি, ফলসে নামার মুখে এর ইতিহাসে লেখা রয়েছে, ব্রিটিশরা এলিফ্যান্ট ফলস নাম রেখেছিলেন। কারণ ফলসের পাশের ভূভাগ হাতির মতো দেখাতো। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে সেই অঞ্চল ধ্বসে যায়। তাহলে এটিও অন্য পাঁচ-দশটি ফলসের মতো হবে কল্পনা করে নিলাম। এই বয়সে দুধের সাধ ঘোলে মেটানো ছাড়া আর কি উপায় আছে!

এলিফ্যান্ট ফলস

এরপর ডাউকির উদ্দেশ্যে রওনা। সিলেটে ফোন করে তামাবিলে একটার দিকে গাড়ি পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়। বেশ খানিকটা যাওয়ার পর মেঘের বাড়ি মেঘালয়ের আসল রূপ ধরা পড়লো। পাহাড়ের গায়ে গায়ে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ কোথাও হালকা কোথাও ঘন। মেঘ উপরে উঠে  যাচ্ছে, ছুটোছুটি করছে, বৃষ্টি হয়ে ভারমুক্ত হচ্ছে। আমাদের গাড়ি কোনো কোনো সময় মেঘের ভিতর দিয়ে চলছে। এই দৃশ্য দেখার, বোঝাবার নয়। মিজোরামে আমার এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমার সাথীরা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে অনবরত ছবি তুলেই চলেছিল। ডাউকি সেতুর কাছে আসার আগে থেকে সিলেটের জাফলং দেখা যাচ্ছিল। এরপর যথারীতি সীমান্তের আনুষ্ঠানিকতা সেরে ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে কর্দমাক্ত রাজপথে সিলেটের দিকে রওনা দেই। পাশ্চাত্যের স্কটল্যান্ড দেখার সুযোগ হলে লন্ডনে শেক্সপিয়রের বাসভবন হয়তো দেখতে পেতাম। শিলং গিয়ে প্রাচ্যের শেক্সপিয়র বিশ্বকবির অমর সৃষ্টিভূমি স্পর্শ ও চাক্ষুষ করার সৌভাগ্যও কম নয়! (শেষ)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়