ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

থাইল্যান্ড ভ্রমণে প্যাকেজ বিড়ম্বনা

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪০, ৯ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
থাইল্যান্ড ভ্রমণে প্যাকেজ বিড়ম্বনা

(ভিয়েতনামের পথে : ২৭তম পর্ব)

ফেরদৌস জামান: সকাল সাতটা বাজতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। দেখতে দেখতে পথের কয়েক মোচড়েই পাহাড়ের আড়ালে চলে গেল প্রিয় পাই। ষাট বাথের লোকাল পরিবহণের পেছনে লম্বালম্বি বেঞ্চ। যাত্রী মাত্র ছয় জন, আমরাসহ স্থানীয় এক মা ও তার শিশু সন্তান এবং ইংলিশপ্রেমী যুগল। পাহাড়ের গহীনে প্রবেশ করতে সামান্য কিছু সময় লাগল। শীতে গা শিনশিন করছে। উঠে এসেছি সমতল থেকে অনেক উঁচুতে। কিছু দূর পরপরই মোচড়, দুর্দান্ত গতির গাড়ি যেন এখনি ঝাপ দেবে খাঁদের গহীন জঙ্গলে। শীত বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে এলো রীতিমত কাঁপুনি ধরে বসল। মেঘ এসে প্রবেশ করছে গাড়ির ভেতর। হাফপ্যান্টে আর ভরসা রাখা সম্ভব হলো না। ব্যাগ থেকে অতিরিক্ত কাপড় বের করে শরীরে না জড়ালে আর চলছে না!

যাত্রাকালে যৎসামান্য কথাবার্তা না হলে কেমন হয়! ভিন্ন প্রজাতির মানুষের মধ্যে তিনি এবং তার শিশু সন্তান খুব একটা স্বস্তিতে নেই। দু’চার কথা বলে পরিবেশটা যে একটু সহজ করে নেয়ার ব্যবস্থা করব সে ইচ্ছা আশাতীত। কারণ ভাষা এখানে প্রধান প্রতিবন্ধকতা। তবে বাচ্চার নাক, গাল টিপে আদর করতে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। ইংলিশ সহযাত্রীর সাথে সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা চলমান। শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রেমিকাকে সামনে বসিয়ে দিয়েছে। থাইল্যান্ড সুন্দর দেশ। তার চেয়েও বড় কথা এখানে ঘুরতে বেশি অর্থের প্রয়োজন পরে না। তাই সুদূর ইয়োরোপ থেকে উড়ে এসেছে। স্নাতকসম্পন্ন করে চাকরিতে ঢুকেছে। শিক্ষকতার চাকরি। বাচ্চাদের পড়ানো এবং আনন্দ বিনোদন দেয়ার কাজ। তাদের নিয়ে সাধারণত কি কি করে থাকে তার উপর কিছু ভিডিও চিত্র দেখাতে চাইলে হ্যাঁ-সূচক সম্মতিতে অনেক খুশি হলো। তার গানের গলা বেশ। এবার চলন্ত গাড়িতেই  ধরে বসলাম, একটা গান তাহলে শোনাতে হবে! একটু সংকোচ করলেও বোঝা গেল মনে মনে আগে থেকেই প্রস্তুতি ছিল।
 


পর্বতের শীর্ষদেশ থেকে অনেকটাই নিচে নেমে এসেছি। এখানেই একটা বিরতি। মধ্য বিরতির রেস্টুরেন্ট, উঠানে পাতা চেয়ারে বসেছি, হাতে দুই দিন আগের পাকা কলার চিপস। আপাতত কটমট শব্দে তারই স্বাদ আস্বাদন করছি। ওদিকে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে হাতে পলিথিন ব্যাগ দোলাতে দোলাতে এগিয়ে আসছে সুজিত। ব্যাগের মধ্যে আমাদের সঙ্গের সাথী পাউরুটি আর মাখনের ডিব্বা। দুই চাকা করে খেয়ে নিতে পারলে বাকি পথ ভালোভাবেই পাড়ি দেয়া যাবে। দশ মিনিটও হয়নি, কথা নেই বার্তা নেই গাড়ি যেন হুড়মুড় করে নড়ে উঠল। ভোৎ ভোৎ শব্দে সাইলেন্সার পাইপ দিয়ে বেড়িয়ে আসছে সাদা ধোঁয়া। ছেড়ে দেবে নাকি? হ্যাঁ, ঠিক তাই। যাত্রীরা দ্রুত উঠে বসে পরল। চালককে সকালে দেখেই কেমন যেন ঠেকেছিল। ওর পক্ষে দু’এক জনকে ফেলে যাওয়া কোন ব্যাপার নয়। সত্যিই যদি তেমনটি ঘটে তো এই পাহাড়ে ব্যাগ বোচকা ও কাপড়হীন পরে থাকতে হবে। তরিঘরি আমরাও গিয়ে উঠে পরলাম। আধাঘণ্টা পর অনুভূত হলো হাতে কি যেন ছিল কিন্তু এখন তা নেই। ভেবেই পাচ্ছি না কি হতে পারে! আদৌ কি কিছু ছিল? সুজিত খানিকটা অসুস্থ বোধ করছে। দু দু’বার বমিও করেছে। একটু পর মনে হলো চলন্ত গাড়িতেই সকলে মিলে পাউরুটি-মাখন খাওয়া যেতে পারে। অমনি মনে পড়ে গেল হাতে যে জিনিস থাকার কথা তা ফেলে এসেছি মধ্য বিরতির টেবিলে। গতকাল বাস কাউন্টারে ওই বস্তু ফেলে এসেছিলাম। পরে ফিরে পেয়েছি কিন্তু এবার আর সে সম্ভাবনা নেই। একবার হারিয়ে যাওয়ার পরও ফিরে পাওয়া এবং পুনরায় ফেলে আসা পাউরুটি-মাখন যেন শুধুই একটি ঘটনা হয়ে থাকল, পেট আর দেখল না।

ক্রমেই প্রবেশ করছি জনবসতিপূর্ণ এলাকায়। পাহাড়ের সারি অনেক দূর দূরান্তে সরে গেল।  শুরু হলো শহুরে রাস্তা। চওড়া সড়কের পাশ দিয়ে দালানকোঠা, দোকান ইত্যাদি। বিশাল উপত্যকার মাঝে গড়ে উঠেছে চিয়াং মাই শহর। আধুনিক শহরের আভাস পাবার পর থেকে মনের মধ্যে অস্বস্তি শুরু হলো। গন্তব্যে পৌঁছার আগেই তা বিরক্তিতে রূপ নিল। এই শহর-বন্দর আর ভালো লাগে না! চিয়াং মাই কোন ঘিঞ্জি শহর নয়, বেশ নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার অধীন। তবুও মন থেকে এই সমস্ত দালানকোঠা বরণ করতে পারছি না। অবধি মনে হচ্ছে, কোথায় ছিলাম আর কোথায় এলাম! মে হং সন এবং পাই দেখার পর মনের মধ্যে চিয়াং মাই-এর ব্যাপারে একটি কল্পনার চিত্র দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কল্পিত চিত্রের সাথে বাস্তাবের মিল খুঁজে না পেলেও আগামী তিন দিন এখানেই থাকতে হবে! টার্মিনালে পৌঁছে সর্বপ্রথম যে কাজটি করলাম তা হলো, এখান থেকে ব্যাংকক যাওয়ার বাসের টিকিট সংগ্রহ। পাশেই তথ্যকেন্দ্র। আগে দরকার মানচিত্র। ওই বস্তুটি হাতে থাকলে ঘোরাঘুরিতে বহু উপকার। তাদের নিকট মানচিত্রের পর্যাপ্ত পরিমাণ না থাকায় প্রথমে অপারগতা জানানো হলো। পরে আরও কিছু তথ্য অর্থাৎ ঠিক করে রাখা হোস্টেল পর্যন্ত কীভাবে যেতে হবে তা জনতে চাইলে সাদা পোশাক পরা কর্মকর্তা আন্তরিকতার সাথে বুঝিয়ে দিলেন। কাঁচের ওপার থেকে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি বোধহয় তৃপ্ত হতে পারলেন না। বেরিয়ে এসে আঙ্গুলের নির্দেশনায় দেখিয়ে দিলেন কোন বাসে থাপায়া গেট যেতে হবে। এই প্রথম কোন একটি সেবা নিতে গিয়ে ইংরেজি জানা একজন মানুষ পেয়ে অনেক ভালো লাগল। এতেও তার তৃপ্তি বা সন্তুষ্টি অপূর্ণ থেকে গেল। তা না হলে ঘরের ভেতর গিয়ে আবারও কেন মানচিত্রের একটি সংখ্যা হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসবেন?
 


সকাল থেকে না খাওয়া। অতএব, সর্বপ্রথম খেয়ে নেয়া দরকার। টার্মিনালের আশপাশেই কিছু দোকান, তার মধ্যে একটিকে সুবিধাজনক মনে করায় সেখানেই খেয়ে নিলাম। বাস ছেড়ে দেবে। বাসের চালক এবং কন্ডাক্টর উভয়েই নারী। চিয়াংমাই এসে এত চমৎকার একটি বিষয়ের সাক্ষী হব ভাবতেই পারিনি। জায়গা মতো নামিয়ে দিতে বললে আশ্বস্ত করলেন কোন চিন্তা নেই। দশ বাথে আমাদের ঠিকানা থাপায়া গেট। ভাড়ার সাথে মিলিয়ে অনুমান করে নিলাম দূরত্ব খুব বেশি হবে না। হালকা যানজটের পর কয়েক মিনিটেই থাপায়া গেট। বাস থেকে নেমেই দেখি মানি এক্সচেঞ্জের দোকান। ভদ্রতাসুলভ কাপন খাপ বলে হাসি মুখে সামনে দাঁড়ালেন দুইজন। স্বয়ংক্রীয় যন্ত্রে মূদ্রার মান উঠে আছে। তারপরও দুজনের একজন কম্পিউটারর কিবোর্ড চেপে আরও সহজ করে দেখিয়ে দিলেন। মূদ্রা পরিবর্তন করে হোস্টেলের ঠিকানা খুঁজতে উদ্যত হলাম। ঠিকানা এতটা সহজে মিলে যাবে তা ধারণার অতীত। মানি এক্সেচেঞ্জ দোকানের একেবারে পাশ দিয়ে গলি। দুই মিনিট এগিয়ে গেলেই জ্যামস হোস্টেল। থাইল্যান্ডের মাটিতে পা রাখার পর এই প্রথম আগে থেকেই ঠিক করে রাখা কোন থাকার জায়গা খুঁজে পেলাম। এত বড় বিজয়ের পর স্বার্থকতা খুঁজতে নিজেদেরকে কমপক্ষে কলম্বাস বা ভাস্কো ডা গামা ভাবতে ইচ্ছা হলো।

যত্রতত্র পথর বিছানো ছোট এক চত্বরের পর অভ্যর্থনা কক্ষ। বসে আছে ব্যবস্থাপক নুন। সে জানাল ঝেড়ে-পুঁছে ঘর প্রস্তুত করতে এক ঘণ্টা লাগবে। এই লম্বা সময় ধরে তার সামনে শুধু শুধু বসে তাকতে ভালো লাগছে না। সে ইতিমধ্যেই আমাদের ভ্রমণের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে দু’চার কথা জেনে নিয়ে নানান ধরণের ভ্রমণ প্যাকেজ মেলে ধরল। দামি দামি প্যাকেজ, বন্য হাতি দেখা, হাতির সাথে খেলা করা এবং হাতির পিঠে চড়ে বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের অভিযানসুলভ ক্রিয়াকলাপ, পাহাড় ট্রেকিং করে থাইল্যান্ডের সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ ইত্যাদি। পাকেজের বিস্তারিত সংবলিত ভাঁজপত্র এবং স্থানীয় মানচিত্র পাশাপাশি মেলে ধরে প্রায় বিশ মিনিট ধরে বুঝিয়ে দিল। উল্লেখিত সমস্ত কিছুই আকর্ষণীয় কিন্তু প্যাকেজ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা আছে কি না? এমন পশ্নে এই প্রথম নুনের মুখে বিষাদের চিত্র ফুটে উঠল। নিজেকে সংবরণ করে পেশাদারিত্বের সাথে আবারও ফিরে গেল প্যাকেজ বর্ণনায়। খানিক পর তার কাছে আমার অতি সরল জিজ্ঞাসা-  দেখ, পাই থেকে পাঁচ কি ছয় দিনে এখানে আসার এক ট্রেইল আছে, আমাদের পরিকল্পনাতে সেটাও ছিল কিন্তু সময় স্বল্পতা ও অন্যান্য সমস্যার কাছে নতি স্বীকার করতে হয়েছে। এখন তুমি আমাদের একটা উপকার করতে পার, প্যাকেজ না কিনে নিজেদের উদ্যোগে ঐ চূড়ায় আরোহণের বিকল্প কোন ব্যবস্থা আছে কি? এমন অনুচিত জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে তার চেহারা দ্বিতীয়বারের মতো বিষাদে বিষময় হয়ে উঠল। ভ্যাবাচেকায় পরে গেলম! কি করি, ওর মুখোমণ্ডলে মিষ্টি ভাব ফিরে আনতে ঠুমরি, টপ্পা কিছু একটা ধরব নাকি ভরতনাট্যম। তার চেহারায় বিষাদ এবং স্বাভাবিকতা দুই চিত্রের লড়াই প্রত্যক্ষ করে মনে হলো এর অতিরিক্ত আর একটি জিজ্ঞাসাও যদি করা হয় নির্ঘাত সে চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে আমাদের উপর বজ্রপাত ছুড়ে মারবে।
 


যেই হোক, নুনের দেয়া তথ্যের মাঝ থেকে আমরা আপাতত একটি মাত্র গন্তব্য তুলে নিলাম- গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। এ পর্যায়ে আর কথা না বাড়িয়ে ঘর প্রস্তুত হওয়ার আপেক্ষায় আছি। সেও বুঝে গেছে আমরা সহজে প্যাকেজ কেনার পর্যটক নই। দুই তলায় ডরমেটরিতে থাকার ব্যবস্থা। বেশ বড় ঘর, দুই কোণায় দুইটি আলাদা দুইতলা বিছানা। ছাদ গরম হয়ে তার সমস্ত তাপ নিচে নেমে এসেছে। সামনে একটি মাত্র দেয়ালে ফ্যান লটকানো। তাতেই চার বিছানায় ঠান্ডা বাতাস পৌঁছানোর ব্যবস্থা।   (চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ জুন ২০১৮/তারা   

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়