ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

পর্বতের দেশে পর্বতের জাদুঘরে

গাজী মুনছুর আজিজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০২, ১৬ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পর্বতের দেশে পর্বতের জাদুঘরে

গাজী মুনছুর আজিজ: পর্বতের জাদুঘরে ঢুকেই একটু অন্যরকম অনূভূতি হলো। মনে হচ্ছে জাদুঘরের দেয়ালে ঝুলে থাকা বরফমাখা পর্বতের ছবিগুলো থেকে শীতল ঠান্ডা এসে গায়ে লাগছে। অবশ্য পর্বতের দেশে পর্বতের শীতলতা গায়ে লাগাটাই স্বাভাবিক; তা ঘরের ভেতরে হোক বা বাইরেই হোক। পোখারায় অবস্থিত পর্বতের এই জাদুঘরের পোশাকি নাম ইন্টারন্যাশনাল মাউন্টেইন মিউজিয়াম। সাইক্লিস্ট আবুল হোসেন আসাদসহ জাদুঘরে যখন ঢুকি তখন দুপুর ছুঁইছুঁই। প্রবেশ ফি জনপ্রতি নেপালি ২০০ রুপি।

ঢুকতেই হাতের বাঁ পাশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রার্থনা কক্ষ। এখানে বুদ্ধমূর্তিসহ বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন স্মারক আছে। কক্ষটির পাটাতন কাঠের। এছাড়া কক্ষটির সামনের দেয়াল ও জানালাগুলো কাঠের।  দেয়ালে শোভা পাচ্ছে কাঠের ক্যানভাসে ননা রঙে আঁকা বিভিন্ন চিত্রকর্ম। পাশের কক্ষটি লাইব্রেরি। লাইব্রেরিতে আছে পর্বতের তথ্য সমৃদ্ধ নানা বইপত্র। টিনের ছাদের জাদুঘর ভবনটি ডুপ্লেক্স এবং খোলামেলা। দেখতে কিছুটা লাম্বাটে। এর প্রথম গ্যালারি সাজানো পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ নিয়ে। এখানে পাহাড়ি আদিবাসীসহ পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের কৃষি, পোশাক, খাদ্য, বাসস্থান, রান্নাবান্না, কাঁসা-পিতলের বিভিন্ন পাত্র, সংস্কৃতিসহ জীবন-যাপনের নানা নমুনা আছে। কাঁসা-পিতলের পাত্রগুলোর অধিকাংশই নান্দনিক কারুকাজে খচিত। এসব কারুকাজ দেখে বোঝা যায় এ অঞ্চলের মানুষের শিল্পমনা ভাব।


দ্বিতীয় গ্যালারি সাজানো হয়েছে নেপাল ও অন্যান্য দেশের বিভিন্ন পর্বতের তথ্য ও ছবি দিয়ে। এর মধ্যে এভারেস্টসহ ৮ হাজার মিটার উচ্চতার ১৪ টি পর্বতের ছবি ও তথ্যও আছে। পর্বতের তথ্য ও ছবি ছাড়াও গ্যালারিতে আছে পর্বতসংশ্লিষ্ট জীববৈচিত্রসহ নানা নমুনা। তৃতীয় গ্যালারি সাজানো পর্বতবিষয়ক কার্যক্রম নিয়ে। এখানে আছে নেপালসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্বতারোহীদের বিভিন্ন পর্বত অভিযানের জানা-অজানা ইতিহাস, পর্বতারোহীদের পোশাক, পর্বতারোহণের সরঞ্জামের অসংখ্য নমুনা ও ছবি। মূলত এ গ্যালারিগুলোই জাদুঘরের প্রধান গ্যালারি। এছাড়া নিচের গ্যালারিগুলোর বিষয়ের সঙ্গে উপরের গ্যালারিগুলোর বিষয়ের সামঞ্জস্য রাখা হয়েছে। নিচ থেকে ওপরের গ্যালারিতে ওঠা-নামার সিঁড়ি আছে। এছাড়া উপরের গ্যালারিতে একপাশ থেকে আরেক পাশে যাওয়ার জন্য আছে সেতু।


মূল গ্যালারি ছাড়াও জাদুঘরের চারপাশজুড়ে পর্বতবিষয়ক আলাদা আলাদা আরও কিছু কর্নার বা প্রদর্শনী স্থান আছে। অবশ্য এগুলোও মূল গ্যালারির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এসব প্রদর্শনী কর্নারের মধ্যে নিচ তলার একটি কর্নার বা স্থান হলো পাহাড়ি জন্তু ইয়েতি ও ইয়াক নিয়ে। ইয়েতি ও ইয়াকের নমুনা রাখা আছে এখানে। ইয়াক অনেকটা আমাদের গরু বা মহিষের মতো। পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ এ জন্তুকে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে মালামাল আনা-নেয়ার কাজে ব্যবহার করেন। পর্বতারোহীরা পর্বতে ওঠার অভিযানের সময় তাদের মালামাল বহনের জন্যও ইয়াক ব্যবহার করেন। আর ইয়েতি দেখতে অনেকটা গরিলার মতো। ইয়েতি নিয়ে অনেক লোককাহিনি আছে। পায়ের ছাপসহ নানা তথ্য যাচাই করে গবেষকরা ধারণা করেন একসময় নেপালের পাহাড়ি অঞ্চলে ইয়েতির বিচরণ ছিল।


নেপালের শেরপা পর্বতারোহী তেনজিং নোরগে ও নিউজিল্যান্ডের পর্বতারোহী স্যার এডমন্ড পার্সিভাল হিলারি ১৯৫৩ সালের ২৯ শে মে যৌথভাবে বিশ্বে প্রথম পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন। তাদের ছবি ও তাদের অভিযানের ইতিহাসও সংরক্ষিত আছে জাদঘুরে। এছাড়া এভারেস্টসহ বিভিন্ন পর্বত অভিযানে সফল বা ব্যর্থ হয়েছেন, এমন অনেক পর্বতারোহীর কথা, ছবি ও তাদের পর্বত অভিযানের অসংখ্য সরঞ্জামও সংরক্ষিত আছে। মাউন্ট এভারেস্টের একটি মডেলও আছে জাদুঘরে। এছাড়া আছে এভারেস্টসহ বিভিন্ন পর্বতের বড় আকৃতির ছবি। ৫০ বা ৬০ বা তারও আগে পোখারাসহ নেপালের জন-জীবন কেমন ছিল তারও নমুনা ছবির দেখা মিলেছে এখানে। বেশ সময় নিয়ে এসব দেখে বের হই জাদুঘর থেকে।

জাদুঘরের দেয়া স্যুভেনিরের তথ্য অনুযায়ী ১ নভেম্বর ১ ৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত নেপাল মাউন্টেইনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে জাদঘুরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে  জাদুঘরের দ্বার উন্মোচিত হয়। জাদুঘরের ঠিক সামনেই আছে পিতলের তৈরি একটি ইয়াকের ভাস্কর্য। তার একটু পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মনাসলু পর্বতের মডেল। মূল মনাসলুর উচ্চতা ৮১৬৩ মিটার। তবে এর উচ্চতা মাত্র কয়েক মিটার। আমরা এর চূড়ায় উঠি। ছবি তুলি। তারপর আসি লিভিং মিউজিয়ামে। এ জাদুঘর মূলত স্থানীয় জনগোষ্ঠী বা উপজাতিদের জীবন-যাপন ও সংস্কৃতি প্রত্যক্ষ করার স্থান বা কক্ষ। এখান থেকে আসি ক্লাম্বিং ওয়ালের কাছে।
 


জাদুঘরের আঙ্গিনাটি বেশ বড়। মূল জাদুঘর, মনাসলুর মডেল, লিভিং জাদুঘর, ক্লাম্বিং ওয়াল ছাড়াও আঙ্গিনাজুড়ে আছে ফুলসহ নানা প্রজাতির গাছগাছালি। এক কোণে আছে জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছেন এমন তিন ব্যক্তির আবক্ষ মূর্তি। মজার বিষয় হলো আঙ্গিনার এক কোণ থেকে জাদুঘরের ছাদের দিকে তাকালে মনে হবে ঢেউ খেলানো পড়তের চূড়া। অর্থাৎ ছাদটি পর্বতের চূড়ার আকৃতিতে করা। এছাড়া এ জাদুঘরের আঙ্গিনা থেকে অন্নপূর্ণা, মনাসুল, ধুলাগিরিসহ কয়েকটি পর্বতের চূড়াও দেখা যায়। আমরাও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এ চূড়ায় চোখ রাখি।

ছবি : লেখক

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ জুলাই ২০১৮/তারা  

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়