ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বিশ্বের বিপজ্জনক এয়ারপোর্টে অবতরণ

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ৭ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিশ্বের বিপজ্জনক এয়ারপোর্টে অবতরণ

(কাঞ্চনজঙ্ঘার সোনালী আলোয়: ৩য় পর্ব)

ইকরামুল হাসান শাকিল: ভোর ৫টা। ঘুম ভরা চোখে উঠে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম। ছ’টার সময় দাকিপা গাড়ি নিয়ে চলে এলেন। আমরা আমাদের ডাফল ব্যাগ ও ব্যাকপ্যাক উঠিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। ১৫ মিনিটের মধ্যেই এয়ারপোর্ট চলে এলাম। সুমনও চলে এসেছেন। তিনি আমাদের বিদায় জানাতে এসেছেন। সকাল ৮টার সময় আমরা তারা এয়ারলায়েন্স -এ উঠে বসলাম। ছোট বিমান। ১৮-২০ জন যাত্রী বহন করতে পারে। ৪৮ মিনিটের আকাশ পথ পাড়ি দিয়ে লুকলা এয়ারপোর্টে অবতরণ করলাম। ছোট্ট একটি এয়ারপোর্ট। ছোট রানওয়ে। বিমান নেমেই দৌড়ে ইউটার্ন নেয় ছোট্ট এই জায়গার মধ্যেই।

এই এয়ারপোর্টটি বিশ্বের বিপজ্জনক এয়ারপোর্টের মধ্যে অন্যতম। ৯ হাজার ৩০০ ফুট উচ্চতার লুকলা বিমানবন্দরটি ‘তেনজিং-হিলারী বিমানবন্দর’ নামেও পরিচিত। নেপালের পূর্বাঞ্চলে সাগরমাতা অঞ্চলের লুকলা শহরের একটি বিমানবন্দর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘হিস্ট্রি টিভি চ্যানেলের ২০১০ সালে প্রচারিত পৃথিবীর ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দ’ নামের এক অনুষ্ঠানে এই বিমানবন্দরকে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দর হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম মাউন্ট এভারেস্ট বিজয়ী এবং এই বিমানবন্দরের নির্মাণকাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ, ২০০৮ সালে স্যার এডমন্ড হিলারি এরং শেরপা তেনজিং নোরগের নামানুসারে এর নতুন নাম রাখা হয় তেনজিং-হিলারী বিমানবন্দর। দিনের বেলা ভালো আবহাওয়াতে লুকলা থেকে কাঠমান্ডুতে প্রতিদিন বিমান চলাচল করে। কাঁটাতার বেষ্টনী ঘেরা এই বিমানবন্দরটির  রানওয়ে লাম্বায় ৫২৭ মি  বা ১ হাজার ৭২৯ ফুট, ৩০ মিটার বা ৯৮ ফুট চওড়া এবং ১১.৭ শতাংশ ঢালু।

বিমান ওড়ার সময় উপর থেকে নেপালের পাহাড়ি এলাকা খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। একসময় বিমানটি মেঘের ভেতরে ঢুকে গেলো। চারপাশে কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু  মেঘ আর মেঘ। এ যেন সাদা মেঘের অন্ধকার। কিছুটা ভয়ও পেলাম। মনে হচ্ছিলো সামনের দৈত্যকার বিশাল পাহাড়ে গিয়ে বিমানটি মুখ থুবরে পড়বে। বিমান থেকে নেমেই টের পেলাম যে আমরা কঠিন শীতের দেশে চলে এসেছি। শীতে কাঁপতে শুরু করলাম। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আমরা নম্বুর হোটেলে ঢুকলাম। ডাইনিং রুম হিটারের তাপে গরম হয়ে আছে। কাচের জানালা দিয়ে বিমানের ওঠা-নামা দেখা যাচ্ছে।
 


গরম গরম মাসালা চা খেয়ে শরীর চাঙ্গা হয়ে গেলো। ডাইনিং রুমটি বেশ বড়।  দেয়ালে ও উপরে পর্বতারোহীদের স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। অটোগ্রাফসহ বিভিন্ন দেশের পতাকা, টি-শার্ট, শার্ট, রুমাল, ফুল প্যান্ট, শর্ট প্যান্ট, স্যান্ডো গেঞ্জি, হেলমেট, আইস এক্স, ক্লাব লোগো- স্টিকার রুমটিকে রঙিন করে তুলেছে। সেখানে বাংলাদেশের পতাকা ও বিএমটিসির লোগোও আছে। দেখে মনটা ভরে গেলো। সাড়ে দশটার সময় লুকলা থেকে আমরা আমাদের মূল ট্রেকিং শুরু করলাম। আমাদের ডাফল ব্যাগগুলো আগেই ইয়াকে করে চলে গেছে। লুকলা বাজারের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলছি। ছোট্ট বাজার। এই বাজার শেষে পাহাড়ের গা বেয়ে আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম।

যেহেতু এই রাস্তা দিয়েই নামচে বাজার ও এভারেস্টসহ খুম্বু রিজনের সকল পর্বতারোহণে যেতে হয় তাই এই রাস্তাটি কেন্দ্র করেই গ্রাম, বাজার, গেস্টহাউজ ও হোটেল গড়ে উঠেছে। এই রাস্তাতেই প্রতিদিন হাজারো দেশী-বিদেশী ট্রেকার পদচিহ্ন ফেলে হেঁটে যায়। আর মেঘেরাও ট্রেকারদের সাথে আলিঙ্গন করে প্রতিমুহূর্তে। ট্রেইলের দু’পাশে পাহাড়ের গায়ে নানান রঙের ফুল পাতা দেখতে দেখতে দুপুর বারোটা বেজে গেলো। চাউরিখারকা-৩ নামের একটি জায়গায় আমরা চা পানের বিরতি নিলাম। শেরপা গেস্ট হাউজ অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে বসে আমরা চা-পান করছি। আমাদের একটু পরেই এলেন পাসাং লামু শেরপা। তিনি নেপালের একজন নামকরা নারী পর্বতারোহী। এভারেস্ট আরোহণ করেছেন। ২০১৪ সালে পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম পর্বত কে-২ সামিট করেছেন। তার সাথে ফেসবুকে সেই সময় থেকেই ফ্রেন্ড হয়ে আছি। তার সকল পোস্ট ফলো করেছি, লাইক দিয়েছি। আজ তাকে সামনে থেকে দেখছি। ভালো লাগা আরও এক ধাপ যুক্ত হলো। মুহিত ভাইয়ের সাথে তার কথা হলো। তিনি আমাদের আগেই চলে গেলেন।

২০ মিনিটের বিরতি শেষে আবার ব্যাগপ্যাগ কাঁধে নিয়ে হাঁটা শুরু। কিছু সময় হাঁটার পর নেমে এলাম দুধকুশি নদীর পাড়ে। এই সেই দুধকুশি। যার নাম অনেক শুনেছি। হিমালয়ের বরফ গলা শীতল পানি কঠিন পাথরের গায়ে আঘাত করে করে কলকল ধ্বনিতে বয়ে চলেছে। নদীর পাশ ধরে আমরা হেঁটে চলছি। কখনো চড়াই আবার কখনো নামা। আঁকাবাঁকা পথে ছোট বড় পাথরের পাশ ঘেঁষে বার্জ, পাইন গাছ পেছনে ফেলে এগিয়ে চলছি। চলার ফাঁকে ফাঁকে মুহিত ভাই আমাদের গ্রুপ ছবি তুলছেন। নূর ভাই ভিডিও ক্যামেরায় আমাদের ভিডিও করছেন। আর শামীম ভাই মোবাইল ফোনে সেলফি তুলছেন।
 


৮৬৩৫ ফুট উচ্চতায় চাউরিখারকা-৫, ফাকদিন, সলোখুম্বু নেমে এলাম। এখন সময় দুপুর ২.১৭ মিনিট। এখানেই আজকের দুপুরের খাবারের বিরতি। নমস্তে গেস্ট হাউস এন্ড রেস্টুরেন্টে খাবারের অপেক্ষায় বসে আছি। খাবার তৈরি হচ্ছে। খাবার অর্ডার করার পরেই খাবার তৈরি করা হয় এসব রেস্টুরেন্টে। তাই অপেক্ষা করতে হয়। পৌনে চারটার সময় খাবার শেষে আবার হাঁটা শুরু। কখনো দুধকোশির পাড় ঘেঁষে কখনো পাহাড়ের চূড়া পার হয়ে দম ফাটা পরিশ্রমে কচ্ছপের মতো আস্তে আস্তে এগিয়ে চলছি। নানান দেশের ট্রেকাররাও হেঁটে চলছে একই তালে। আবার কেউ উপর থেকে নেমে আসছেন। ইয়াকে করে মালামাল আনানেয়া করছে ইয়াক চালক। ইয়াকের গলার ঘণ্টার টুং টাং শব্দ শুনতে বেশ ভালোই লাগে চলার পথে।

সন্ধ্যা ছ’টার সময় আমরা ৯২৮০ ফুট উচ্চতায় একটি গ্রামে এসে পৌঁছালাম। এখানে মনজো গেস্ট হাউজ নামের একটি তিব্বতি রেস্টুরেন্টে উঠলাম। ডাইনিং রুমে বসে গরম গরম জিঞ্জার চা সারা দিনের ক্লান্তি দূর করতে বেশি সময় নিলো না। সন্ধ্যা থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। তাই শীতটাও একটু বেশিই। আজ আমার রুমমেট শামীম ভাই। মুহিত ভাই এক রুমে, নূর ভাই ও বিপ্লব ভাই এক রুমে এবং রিনি আপু ও ছায়াবিথী আপু এক রুমে। আজ থেকে আমাদের গোসল খতম। তাই হাত মুখ ধুয়েই রাতের খাবার খেতে ডাইনিং রুমে চলে এলাম সবাই। গিজারের পাশে বসে গা একটু গরম করে নিলাম। টেবিলে খাবার চলে এলো। খাবার শেষে করে আবার সবাই রুমে চলে এলাম। আজ থেকে আমার মাথাটি একটু একটু ব্যথা করছে। রাতে ঘুম হলে হয়তো ব্যথাটা সেরে যেতে পারে তাই আর মুহিত ভাইকে কিছু জানালাম না। শরীরটাও ব্যথায় টনটন করছে। ব্যথায় হাত বুলাতে বুলাতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
 


সকাল সাতটার মধ্যেই সবাই রেডি হয়ে ডাইনিং এ চলে এলাম। প্রথমেই জিঞ্জার চা তারপর সকালের নাস্তা। রাতে বৃষ্টি ছিলো। তাই অনেকটা ভয়ে ছিলাম। সকালের আবহাওয়া খারাপ হতে পারে ভেবে। তবে ভয়ের কপালে লাথি মেরে সূর্য হেসে উঠেছে।

সন্ধ্যায় এসেছিলাম বলে চারপাশের কিছুই দেখা হয়নি। তাই এখন দেখছি পাহাড় পর্বত ঘেরা অপরূপ সৌন্দর্য। ছ’হাজারি পর্বত কুসুমকাংরু ও খুমডিলা দাঁড়িয়ে আছে মাথা তুলে। সূর্যের আলোতে চিকচিক করছে। খুমডিলা পর্বতটি একটি পবিত্র পর্বত স্থানীয়দের কাছে। তাই এটিতে আরোহণ নিষিদ্ধ। সেই কারণে এখনো এটি আনসামিট রয়েছে। আটটার সময় আমরা এখান থেকে নামচের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম। এখনো আমার মাথা ব্যথাটা রয়ে গেছে। মুহিত ভাইকে জানালাম মাথা ব্যথার কথা। রাতে শুনেছি শামীম ভাইয়েরও মাথা ব্যথা। মুহিত ভাই বললেন, ভালো হয়ে যাবে। উচ্চতাজনিত কারণে মাথা ব্যথা করছে।

পাহাড়ের গা বেয়ে আস্তে আস্তে নেমে এলাম দুধকোশির পাড়ে। দুধকোশির কলকল শীতল শব্দ আর মেঘের খেলা চলছেই যুগ যুগ ধরে। সেই খেলার দর্শক হয়ে দেখছি আর পাহাড়ি উঁচু নিচু পথে হেঁটে চলছি। দুধকোশি নদীর উপরে ঝুলন্ত ব্রিজ দিয়ে পাড় হচ্ছি। ব্রিজের উপর দিয়ে হাঁটার সময় ব্রিজটি একটি তালে ঝুলে। ব্রিজে নানান রঙের প্রার্থনা পতাকা আর কাঁথা বাতাসে পত্পত্ করে উড়ছে। নূর ভাই ব্রিজের নিচ থেকে আমাদের ভিডিও করলেন।

ব্রিজ থেকে নেমে এসে দুধকোশির পাড়ে পানি পানের বিরতি। বড় একটি পাথরের উপরে দাঁড়িয়ে আমরা ছবি তুললাম। পাশে একটি একটু উঁচু পাথরের উপরে উঠে বিপ্লব ভাই ছবি তোলার জন্য দাঁড়ালেন। পাথরটি শেওলাযুক্ত ছিলো। স্টাইল করে পোজ দিতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যান। কপাল জোড়ে পেছনের দিকে না পড়ে সামনের দিকেই পড়লেন। পেছনের দিকে পড়লে একদম সোজা কমপক্ষে একশ ফুট নিচে দুধকোশি নদীতে পড়তেন। এ যাত্রায় কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই বেঁচে গেলেন! (চলবে)

আলোকচিত্র: এম এ মুহিত


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ আগস্ট ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়