ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

একশ ডলার ভাঙিয়ে পেলাম তের লাখ সাতচল্লিশ হাজার...

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একশ ডলার ভাঙিয়ে পেলাম তের লাখ সাতচল্লিশ হাজার...

(ভিয়েতনামের পথে: ৪০তম পর্ব)

ফেরদৌস জামান: বিমান সময় মতো ছেড়ে দিলো এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই গোলযোগপূর্ণ আবহাওয়ায় পড়লাম। এক পেয়ালা কফির কথা বলে মাত্র প্রস্রাবখানায় গিয়েছি অমনি কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তা ঝাকুনিতে রূপ নিলো। দরজা খুলে বেরুতেই ক্রুগণ বললেন, সামনের আসন শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকুন। ওদিকে শব্দ যন্ত্রে বারবার ভেসে আসছে আসন বন্ধনি বেঁধে নেয়ার পরামর্শ। পয়ত্রিশ/চল্লিশ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে বিমান নেমে এসেছে বিশ/পঁচিশ হাজারে। কিছুক্ষণ পর আসন ধরে ধরে ফিরে এলাম নিজ আসনে। ডানার ঠিক পেছনের আসন হওয়ায় গোলযোগের রূপটা একটু হলেও আন্দাজ করা যাচ্ছে। কিন্তু কোন অদ্ভুত কারণে মনের ভেতর ভীতি অনুভূত হচ্ছে না। এই অস্বাভাবিকতাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা উচিৎ জানা নেই। ঝাকুনি প্রশমিত হওয়ার পর একজন ক্রুকে কফির কথা মনে করিয়ে দিলে জানালেন, আসন বন্ধনি থাকা অবস্থায় কোনো তরল খাবার পরিবেশনের নিয়ম নেই। খানিক বিরতির পর আবার শুরু হলো ঝাকুনি। এভাবে সমস্ত পথ আসন বন্ধনিতে আবদ্ধ থাকতে হলো।

বালি দ্বীপের বুকে ফুটে আছে অজস্র মিটিমিটি আলোক বিন্দু। আকাশ থেকে দেখা আর সব শহর-বন্দরের আলোকগুচ্ছের সাথে এখানে জ্বলে থাকা আলোগুলির বাস্তবিক অর্থে তেমন কোনো প্রভেদ না থাকলেও এই অবস্থায় তাকে ভিন্ন রকমের দেখার প্রস্তুতি কম বেশি সবার মনেই ক্রিয়াশীল। আর সেই বিষয়টি বর্তমানে আমার মধ্যেও চলমান। রাতের আকাশ থেকে এটি সাধারণ একটি চিত্র। এরূপ পরিস্থিতিতে এই সাধারণ বিষয়টিকেও অনবদ্য মনে হচ্ছে, যেন প্রতিটি আলোক বিন্দুর মধ্যে লুকিয়ে আছে একেকজনের প্রাণের নিশ্চয়তা। অবতরণ হলো ডেনপাসার আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে। একটু আগে ভেদ করে এলাম এক ভয়ঙ্কর গোলযোগপূর্ণ আবহাওয়া। অথচ বালির বুকে তার কোন চিহ্ন নেই। আশপাশে কত দেশের কত বিমান তার ঠিক নেই। কোনটা উড়াল দেয়ার প্রস্তুতিরত, কোনটা একটু আগেই নেমেছে, আবার কোনটা অলস বসে আছে। এর পাশ দিয়ে, ওর পেছন দিয়ে এমনি করে ধিরে ধিরে হেঁটে যাচ্ছে আমাদের বহণকারী বিমানটি। কেটে গেল প্রায় আধা ঘণ্টা। বিমানজুড়ে এই মুহূর্তে প্রধান আলোচ্য বিষয় বিমানজট। এখানকার আনুষ্ঠানিকতা খুবই সহজ। কয়েক মিনিটের মধ্যে কাজ সমাপ্ত করার পর ব্যাগ বুঝে পেতে বোধহয় পনের মিনিটও অপেক্ষা করতে হলো না। ইন্দোনেশিয়া ঢুকতে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের জন্য কি চমৎকার সুযোগ, ভিসার প্রয়োজন হয় না! এরূপ সুযোগ প্রাপ্তির কারণে অনেক সম্মানিত বোধ করলাম।
 


এখন প্রথম কাজ ডলার ভাঙানো। এখানকার মূদ্রার নাম ‘রুপাইয়া’। ডলারের বিপরীতে তার মান কত? এসব বিষয়ে কোন পূর্ব ধারণা নেই। মানি এক্সচেঞ্জের স্বয়ংক্রিয় পর্দায় যা উঠে আছে তা গুণ করে দেখা যাচ্ছে একশ ডলারের বিপরীতে তের লাখ সাতচল্লিশ হাজার রুপাইয়া! ভুল দেখছি না তো? পরিষ্কার করে জানতে চাইলে একজন কর্মী নিশ্চিত করলেন ঠিকই আছে- তের লাখ সাতচল্লিশ হাজার! এমন পরিস্থিতিতে মনের মধ্যে স্বভাবিকভাবেই যে প্রশ্ন ভেসে ওঠে তা হলো- এত অর্থ বহণের জন্য আবার আলাদ কোনো ব্যাগ টানতে হবে নাকি? তার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ ইন্দোনেশিয়ার সর্বোচ্চ নোট এক লাখ রুপাইয়ার। অতএব, যা পাওয়া গেল তা রাখার জন্য পেছনের পকেটে রাখা মানিব্যাগের এক কোণাই যথেষ্ট। মুহূর্তেই এতগুলি অর্থের মালিক বনে গেলাম, খরচা করব কোথায়? এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে উচ্ছ্বসিত কথাবার্তা যে হচ্ছে না তা নয়। আমাদের ঠিকানা জালান বুয়ানাকুবু নামক জায়গা। সেখানেই থাকার জায়গা ঠিক করা আছে। টার্মিনাল থেকে বের হওয়ার পর আমাদের দেশের মত শতশত বা হাজার হাজার মানুষের ভীড় নেই। অল্পসংখ্যক মানুষ, যাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ট্যাক্সি চালক। জালান বুয়ানাকুবুর ভাড়া কেউ দাবি করছে পাঁচ লাখ তো কেউ চার। বলে কি, এই অঙ্ক দিয়ে তো আস্ত একটা ট্যাক্সিই খরিদ করা সম্ভব! ট্যাক্সি ছাড়া অন্য কোন পরিবহণের ব্যবস্থা নেই। সুতরাং, পাঁচ লাখ কেন দশ চাইলেও উপায় নেই। এবার টের পেলাম খরচা কোথায় এবং কীভাবে হবে। সাথে এ-ও বোঝা গেল এই সাড়ে তের লাখ রুপাইয়ার হায়াত কতক্ষণ। শেষমেশ দুই কি আড়াই লাখে ট্যাক্সি সই হলো। রাত দশটার মত বাজে। শহরের রাস্তায় গাড়িঘোড়ার সংখ্যা নিতান্তই কম। দোকানপাটও বন্ধ, হাতে গোন কিছু খোলা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম জালান বুয়ানাকুবুর হোটেল ভিনাকা বালিতে। ট্যাক্সি চালকের ব্যবহার ভালো লাগায় ভাবলাম তার ফোন নাম্বার রেখে দেই। নাম্বার চাওয়ায় তিনি কিসের ইঙ্গিত আন্দাজ করে নিলেন জানি না। নাম্বার দেয়া-নেয়ায় অতো আগ্রহ নেই, তার চেয়ে বরং সুখবর দেয়ার মতো করে বললেন, বিশেষ কোন খায়েশের ইচ্ছা থাকলে রাতেই ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। এর অধিক আর একটি কথাও বাড়ালেন না।

হোটেলের অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে দৌড়ে এসেছে একটি বালক। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখানে থাকার জায়গা আগেই ঠিক করা আছে জানার পর ভক্তির সহিত ব্যাগগুলি টানাটানি শুরু করে দিল। তার যে কোন প্রয়োজন নেই জানানোর পরও স্বয়ং ব্যবস্থাপকের নির্দেশে দায়িত্বে মনোনিবেশ জারি রাখলো। ছোট চত্বরকে সামনে নিয়ে একটি দুই তলা দালান। হোটেল নয় যেন একটি সুন্দর বাড়ি। রাত অনেক হয়েছে, আশপাশে খাওয়া-দাওয়ার ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। ব্যবস্থাপক জানালেন রাস্তা ধরে বাম দিকে কয়েক মিনিট হেঁটে গেলে একটি খাবার দোকান পাওয়া যেতে পারে। হাঁটতে ভালোই লাগছে। মনে হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া নয় হালকা আলোয় ঢাকার কোন গলিতে হাঁটছি। পাঁচ মিনিটও হাঁটতে হলো না, রাস্তার পাশে উন্মুক্ত রেস্টুরেন্ট, সাইনবোর্ডে মাত্র দুই কি তিনটি খাবারের ছবি- মাছ ভাজা, মুরগির মাংস ভাজা এবং সাদা ভাত। কে বলে ভালো ব্যবস্থা নেই, এই মধ্য রাতে এর চেয়ে উন্নত ব্যবস্থা আর কি হতে পারে? একটি মাত্র টেবিল এবং তাকে কেন্দ্র করে চারটি চেয়ার। এগিয়ে এলেন রেস্টুরেন্টের মালিক স্বয়ং। বসত বাড়ির সম্মুখের খোলা জয়গায় মুদির দোকান এবং এই ব্যবসা। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে চালান। আপাতত দোকানে আমরা ছাড়া অন্য কোন খদ্দের নেই। ইংরেজি বোঝেন না তবে ইশারা ইঙ্গিত ধরার ক্ষেত্রে বেশ পাকা। এক ইশারাতেই বুঝে নিলেন মুরগির মাংস ভাজা দিয়ে ভাত খেতে চাই।
 


মাংসে আগে থেকেই মশলা মাখিয়ে রাখা আছে। বলামাত্র কড়াইয়ের গরম তেলে দুই টুকরো ছেড়ে দিলেন। খুশবুর টানে টেবিল থেকে উঠে গেছি তার রান্না দেখতে। রান্না চলছে, একই সাথে কথাবার্তা। বিদেশি খদ্দের পেয়ে খুশি। সদা হাস্যজ্জ্বল, চোখে মুখে হাসি লেগেই আছে। যা খেতে যাচ্ছি তার স্থানীয় সম্বোধন না জানলে কেমন হয়। ইশারা এবং ইঙ্গিত মূলক ভাষা বা শব্দ যুক্ত করে কৌতূহলের কথা জানাতেই দ্রুত বুঝে নিয়ে উত্তর দিলেন ‘গুরেং’। অর্থাৎ এটি মুরগির স্থানীয় নাম। পনের মিনিটের মধ্যে পরিবেশিত হলো সাদা ভাতের সাথে মচমচে ভাজা গুরেং। অল্প সময়েই মহব্বত যে অনেকটা এগিয়েছে তার প্রমাণস্বরূপ বারবার হাতে করে কিছু না কিছু নিয়ে আসছেন, এই সালাদ তো এই আঁচার। গরম ভাতে মরিচের আঁচার মেখে ভাজা মাংসের সাথে কি যে স্বাদ তা বলার নয়! সুজিত তো স্বীকৃতিস্বরূপ বলেই ফেললো, এত চমৎকার মুরগির মাংসের  পদ সে আগে কখনও খায়নি। কথা দিয়ে এলাম আগামীকাল আবারও খেতে আসছি। মজার ব্যাপার হলো দুই জনের খেতে পকেট থেকে বেরিয়ে গেল মাত্র ষাট হাজার রুপাইয়া! সুজিত যেমন জীবনে প্রথম এত দারুণ খাবার খেল, আমিও তেমনি জীবনে প্রথম এত দামি খাবার খেলাম। ইচ্ছা হলো একবার হিসেব কষে দেখি আমাদের মূদ্রার হিসেবে কত টাকার খাবার খেলাম। ফলাফল যা দাঁড়াল তাতে ঢাকা শহরের মোটামুটি ভালো মানের রেস্টুরেন্টে এক বেলা খেতে এর চেয়ে বেশিই টাকা লাগে।(চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়