ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আবার যদি ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের সুযোগ পাই

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৮, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আবার যদি ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের সুযোগ পাই

(ভিয়েতনামের পথে: ৪৩তম পর্ব)

ফেরদৌস জামান: পথের পাশ দিয়ে ঘরবাড়ি এবং তার সামনে দেবদারু ও কাঠগোলাপ বা কাঁঠালচাপা জাতীয় গাছের সারি। কোন কোন গাছে ফুটে আছে গোলাপি আর সাদা ফুল। রাস্তা এখন প্রবেশ করেছে উবুদ এলাকার বসতির মাঝে। বাজার বামে রেখে ডানে মোড় নিয়ে ধরেছি গোয়া গাজার পথ। এখানে আছে নবম শতকের একটি গুহা মন্দির। আরও আছে চৌবাচ্চা বা স্নান পুরুর এবং একটি উদ্যান।

সদর দরজা পেরিয়ে পাকা মেঝের খোলা চত্বর। চারপাশজুড়ে বিরাজ করছে তীর্থস্থানের আবহ। চত্বরের পেছন অংশে বেশ কিছু দোকান। তেমনই এক দোকান থেকে দুই টুকরো কাপড় হাতে উঠে এলেন এক মধ্যবয়সী নারী। নিজ থেকেই দেখিয়ে দিলেন স্কুটি রাখার সুবিধাজনক জায়গা। তারপর নিকটে এলেন কাপড় টুকরো দুটি আমাদেরকে পরিয়ে দিতে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একি সেবা-আত্তি শুরু হলো! কাপড় না পরে নাকি ভেতরে যাওয়ার নিয়ম নেই। প্রতি কাপড়ের জন্য নিজ থেকেই নির্ধারণ করে দিলেন পঞ্চাশ হাজার রুপাইয়া। এই অতি ভক্তির পেছনে যে কোন উদ্দেশ্য লুকিয়ে থাকতে পারে তা আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। কোন কৌশল অবলম্বন না করে তাকে পাশ কাটাতে হলো। চত্বরের শেষ প্রান্তের দরজা পেরিয়ে কয়েকটি সিঁড়ি নেমেই গাছের ছায়া তলে ছোট্ট একটি বাজার। ছনের চালে ছাওয়া দোকানের সুশৃঙ্খল সারি। স্থানীয় হস্তশিল্পজাত পণ্যের দারুণ পসরা! বাজার পেরিয়ে টিকিট কাউন্টার। ধীরে ধীরে পথ নেমে গেছে নিচের দিকে। বৃক্ষরাজির ফাঁক দিয়ে দৃশ্যমান হলো একটি উঠান। সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে উঠানে পা দেয়ার আগেই দায়িত্বরত একজন বেছে বেছে যাদের পরনে ফুলপ্যান্ট নেই তাদের এক টুকরে করে কাপড় এগিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের পরনে ফুলপ্যান্ট থাকায় তার আর প্রয়োজন পড়ল না।
 


বাম পাশে চার কোণাকৃতির জায়গায় সাজিয়ে রাখা অনেকগুলি প্রস্তর খণ্ড। কালো পাথরের খণ্ডগুলি প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য বহণ করে। খণ্ডগুলির মধ্যে রয়েছে বিশেষত মূর্তি বা অন্যান্য স্থাপনার ভগ্নাংশ। সম্মুখেই চৌবাচ্চা। চৌবাচ্চার দেয়ালে কয়েকটি নারী মূর্তি। প্রতিটির হাতে একটি করে কলস আকৃতির পাত্র। পাত্রের মুখ দিয়ে অনবরত বেরিয়ে আসছে পানির চিকন ধারা। চৌবাচ্চা পেরিয়ে পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে আছে কিম্ভূতকিমাকার এক থোকা দেব-দেবীর মূর্তি। ঠিক তার মাঝখানে একটি বড় মূর্তির মুখাবয়ব। দৈত্যাকৃতির মূর্তির মুখ গহ্বরটি গুহায় প্রবেশের পথ। এই গুহার আরেক নাম হাতি গুহা। অতীতে নাকি সম্মুখের মূর্তির স্থলে হাতির মূর্তি স্থাপিত ছিল। হাতি আজ না থাকলেও গুহার সেই নাম স্থানীয়দের মাঝে আজও প্রচলিত।  জানা যায় ১৯২৩ সালে কোন এক ডাচ প্রত্নতাত্ত্বিক গুহাটি আবিষ্কার করেন। সম্মুখের চৌবাচ্চা আবিষ্কৃত হয় ১৯৫৮ সালে। জায়গাটি বর্তমানে ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।

গুহার সামনে দাঁড়িয়ে একাকি একটি ছবি তুলব তা হয়ে উঠল না। দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশি নয়, তবে কেউ না কেউ জায়গাটিকে দখল করে আছেই। তার উপর দিয়ে ভেতরে যাতায়াতরত দর্শনার্থী। এখানে ইন্ডিয়ান দর্শনার্থীদের আনাগোনা চোখে পরার মত। বৃদ্ধরাও এসেছেন এবং তাদের আবেগের সম্পূর্ণটাজুড়ে সার্থক ধরণের অভিব্যক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। এ থেকে ধারণা করা যায় ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গোয়া গাজার গুরুত্ব যথেষ্ট। গুহার মুখ থেকেই অন্ধকার। অপ্রশস্ত গুহার কালো কুচকুচে দেয়ালে বাতির ব্যবস্থা আছে। ছোট্ট গুহা, শাখা প্রশাখা বেশি নয়। এক প্রান্তে রাখা একটি গণেশ মূর্তি। আবার অন্য আরেক প্রান্তের দেয়াল কেটে বসানো তিনটি শিব লিঙ্গ মূর্তি এবং পাশ দিয়ে সিঁদুর-চন্দন ও ফুল ছিটানো। গুহাটি সাধারণ পর্যটকদের জন্য তেমন চিত্তাকর্ষক নাও হতে পারে তবে ধর্মীয় এবং প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ গুরুত্ববাহী। চত্বরের মাঝে স্থাপিত আছে আরও কিছু মন্দির বা আশ্রম ধরনের ঘর। এক পাশ দিয়ে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। পাথরের চিপা দিয়ে ছরছর শব্দে নেমে এসেছে ছোট্ট একটি ঝরনাধারা। তারপর খালে রূপ নিয়ে নেমে গেছে আরও নিচের দিকে। এরপর সিঁড়ি বেয়ে সোজা উঠ গেলে পাহাড়ের ধার দিয়ে একটি পথ। উঠে গেছে আরও উপরের দিকে। এই জঙ্গলের মাঝে হঠাৎ দেখা মেলে হস্তশিল্পজাত জিনিস পত্রের একটি দোকান। কাঠে খোদাই কারা পণ্যের প্রতিটিই অসাধারণ শিল্প কর্ম। খাল পেরিয়ে সংক্ষিপ্ত পথ পরেই আর একটি মন্দির গৃহ। এদিকটায় কোন দর্শনার্থী নেই বললেই চলে। সমস্ত এলাকা প্রদক্ষিণ শেষে একই পথে উঠে এলাম উপরের সেই খোলা চত্তরে। এসে দেখি কাপড় বিক্রেতা নারী এখনও অপেক্ষায় বসে আছে। শেষ চেষ্টা হিসেবে নিজ থেকেই কাপড় দুটির মূল্য বিশ বিশ চল্লিশ হাজার বলে চুপ করে থাকলেন।
 


ফিরে এলাম উবুদ বাজার। ইয়োরোপিয়ান ধাঁচে কালো পাথর বসানো পথ। এক পাশে রেস্টুরেন্ট, অপর পাশে স্থায়ী এবং অস্থায়ী বহু দোকান। পথে কোন যান চলাচল নেই, শুধু স্কুটি সার করে রাখা। বালির দক্ষিণে অবস্থিত এই বাজারের অবস্থান মূলত কয়েকটি গ্রাম কেন্দ্র করে। বাজারে প্রদর্শিত সমস্ত পণ্যসামগ্রী এই গ্রামগুলিতে তৈরি হয়। হস্তশিল্পের এই বাজার শুরু হয় ভোর চারটায়, চলে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। উবুদ বাজার শুধু বালি নয় বরং সারা ইন্দোনেশিয়ার অন্যতম একটি বাজার। বাজারের প্রকৃত নাম উবুদ ঐতিহ্যবাহী শিল্প বাজার। দেশি-বিদেশি পর্যটকে সর্বক্ষণ জমজমাট থাকে। বাজার দেখার উপযুক্ত সময় হিসেবে দিনের যে কোন অংশ গণ্য হতে পারে। তবে কেনাকাটার উত্তম সময় সকাল নয়টার মধ্যে। কারণ এই সময়ের বিক্রি ভালো হলে তাদের বিশ্বাস সারা দিন ভালো যাবে। সুতরাং, এই সময়টিতে বিক্রেতাগণ পণ্য বিক্রির জন্য বেশি উন্মুখ থাকে। উবুদ বাজারে কোন কিছু কিনতে হলে দরদাম করার পারদর্শিতা থাকা চাই। কারণ এখানে খুবই দরদাম চলে। সুতরাং, সকালে কোনাকাটায় দরদামটা ভালোভাবে করা যায়। সেক্ষেত্রে আগের দিন এসে স্থানীয় হোটেল, গেস্টহাউজে থাকা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। এই সমস্ত বিষয় আমাদের সম্পূর্ণই অজানা ছিল। আগে জানা থাকলে ভ্রমণের পরিকল্পনা অন্যভাবে সাজানো যেতো।

দুপুরের খাবার এখনও খাওয়া হয়নি। পাশেই কয়েকটি ছোট ছোট খাবারের দোকান। অন্তরিক অভ্যর্থনার কারণে প্রথম দোকন পছন্দ হলো। থালিতে ভাতের উপর দুই টুকরো বেগুন ভাজা এবং অচেনা দুইটি পদ। পাশে রাখা ছোট ছোট পাত্রে মরিচ এবং টমেটোর আঁচার রাখা। যত্নআত্তির খাবার খেয়ে সবে বেরিয়েছি দেখি হাড়ের তৈরি শিল্পকর্ম বিক্রেতা এখনও দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। মহিষের হাড়ে খোদাই করা অসাধারণ শিল্পকর্মে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে স্থানীয় ধর্মীয় বিশ্বাসজাত চিত্র। প্রথম দেখায় একজোড়া চেয়েছিল চার লাখ। এক দাম বলেছিলাম সত্তুর হাজার। তখন রাজি না হলেও এখন এসে ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে। দশ হাজার বাড়িয়ে দিলে তবেই না  হাতছাড়া করলেন। পাখির পালকে তৈরি মাথায় পরার জিনিসটিকে অলঙ্কার না কি টুপি জাতীয় কিছু বললে উপযুক্ত হবে তা বুঝতে পারছি না। পালকের পর পালক গেঁথে চমৎকার করে বানানো। কৌতূহল হলে মাথায় পরে পরখ করলে দেখা গেল কোনটার ঝালোর নেমে গেল পিঠে তো কোনটা কোমর পর্যন্ত, যেন মাথায় গজানো পাখির পালকের দীঘল বাহার। বেশিরভাগ পণ্যে প্রকাশ ঘটেছে স্থানীয় ধর্ম বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। সমুদ্র থেকে আহরণ করা শঙ্খ, বড় ঝিনুক ইত্যাদি দিয়ে বানানো পণ্যগুলো বেশ আকর্ষণীয়। রুপার তৈরি গলার মালা, কানের দুল সব কিছুতেই ধর্মীয় নকশার প্রাধান্য। আরও রয়েছে ভাস্কর্য ও চিত্রকর্মের সম্ভার। বাজারজুড়ে এ ধরনের দোকানের সংখ্যাই বেশি। বিশেষ করে নারী-পুরুষের সেলাইবিহীন পরিধেয় কাপড়ই এসব দোকানের প্রধান পণ্য। প্রথমে প্রতিটির দাম হেঁকে বসল দেড় থেকে আড়াই-তিন লাখ পর্যন্ত। মহিষের হাড় কিনে আমার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে। অতএব, দরদাম করতে কোন সংকোচ নেই। একাধিক দোকন থেকে পাঁচ/ছয়টি কাপড় কেনা হলো, প্রতিটি বিশ থেকে পঞ্চাশ হাজারের মধ্যে। সিল্কের কাপড়ও পাওয়া যায়, যদিও বিক্রেতারা তাদের প্রায় সব পণ্যকেই সিল্ক বলে দাবি করে। ঝুরি, টুপি, বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি এখানে বেশ সহজলভ্য। কাপড়ের বুননে ফুটিয়ে তোলা দেব-দেবীর চিত্রকর্মও বেশ সস্তায় মেলে।
 


সন্ধ্যা নেমে এসেছে দোকানগুলি গুটিয়ে ফেলছে। অনেক দোকান ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। ভ্রমণের এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বাজার দেখার অভিজ্ঞতা অর্জিত হলো, প্রতিটি বাজারের রয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য। কিন্তু উবুদ ঐতিহ্যবাহী শিল্প বাজার সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং বিশেষ স্বাতন্ত্রের অধিকারী। এখানে দেখার আছে অনেক। শেখারও কম নয়। উৎপাদিত পণ্যের কোণায় কোণায় ফুটে উঠেছে তাদের বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। একটু মনোযোগী আর অনুসন্ধিৎসু মানসিকতার অধিকারী হলে যে কারও পক্ষে খুঁজে পাওয়া সম্ভব স্থানীয় সংস্কৃতির সবটুকু। ভবিষ্যতে আবার কখনও ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের সুযোগ মিললে সম্পূর্ণ একটি দিন বরাদ্দ রাখব শুধু এই বাজার দেখার জন্য। বাজার থেকে বেরিয়ে উবুদ শহর পার হতে গিয়ে পতিত হলাম  যানজটের মধ্যে। সামান্য ফাঁকটুকু নেই যে স্কুটি নিয়ে কোন মতে বেরিয়ে আসা যায়। কায়দা-কৌশলের সর্বশেষটা নিয়োগ করে নিস্তার মিললেও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ডেনপাসার এসে বাঁধল এক মহা জটিলতা। হারিয়ে ফেলেছি জালান বুয়ানাকুবু। এই রাস্তা সেই রাস্তা ঘুরছি আর লোকেদের জিজ্ঞেস করছি বুয়ানাকুবু কোন দিকে? কেউ কিছু বলতে পারে না। দু’একজন কথাবার্তার আগা মাথা না বুঝে আন্দাজের উপর হাত ইশারায় পথ দেখিয়ে দেয়। ঘুরতে ঘুরতে এক পর্যায়ে তো দুশ্চিন্তায় পরে গেলাম- সারা রাত রাস্তায় কাটাতে হয় কি না! (চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা  

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়