ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নেহেরু ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০১, ৮ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নেহেরু ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং

ইকরামুল হাসান শাকিল : ক্ষুধায় পেটের ভিতর আন্দোলন চলছে। পেট শান্ত করতে সোজা ঢুকে পরলাম হোটেল। এখানেও আমিষের বালাই নেই। যেখানে আমাদের ভাতের সঙ্গে মাছ-মাংস না হলে খাবারে তৃপ্তি আসে না, সেখানে ক’দিন ধরে শুধু সবজি দিয়েই খাবার চলছে। যেহেতু পেটে রাক্ষুসে ক্ষুধা সেখানে আমিষ-নিরামিষে কিছু আসে যায় না। হোটেলের কর্মচারী এসে জিজ্ঞেস করলো আমরা কি থালা খাবো না কি অন্য কিছু? আমরা থালা খাবো জানিয়ে দিলাম। থালা হলো বড় একটি প্লেটে ভাত, আলুসহ পাঁচমিশালী সবজি, চনার ডাল, পাপড়, করল্লা ভাজি একসাথে থাকবে। একাধিক বার ভাত, ডাল, সবজি নেয়া যায় তবে খাবারের দাম একই থাকবে। এখানে প্রতি থালার দাম ষাট রুপি।

খাবার শেষ করে আমরা বাজারের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলছি। চারপাশে পাহাড় দিয়ে ঘেরা ভাগীরথী নদীর পাড়ে সমতল ভ্যালিতে এই ছোট্ট শহর। এখানে স্থানীয় ও বিদেশীদের মিলন মেলা ঘটে। এখান থেকেই গঙ্গোত্রী অঞ্চলের ট্রেকিং ও পর্বত অভিযান শুরু হয়। মানুষের ভিড় ঠেলে শহর থেকে বের হয়ে আমরা ভাগীরথী নদীর উপরের ঝুলন্ত সাস্পেনশন ব্রীজের উপরে এসে দাঁড়িয়েছি। এই ব্রীজটিই নদীর দুই পাশ একত্র করেছে তবে এখন আরো একটি ব্রীজ হয়েছে যানবাহন চলাচলের জন্য। এই রাস্তাটি আমার ভীষণ পরিচিত। তাই সানভি ভাইকে বিভিন্ন কিছু দেখাতে দেখাতে হেঁটে চলছি। সাপের মতো আঁকাবাঁকা কালো পিচঢলা পথে পাহাড়ের গাঁ বেয়ে উপরের দিকে উঠছি। এই পাহাড়ের উপরেই উঠতে হবে আমাদের এখন। উঠতে উঠতে হাঁপিয়ে উঠলাম। হৃদস্পন্দনও অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। থেমে থেমে পাইন বনের ভিতর দিয়েই এগিয়ে চলছি। সুউচ্চ পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ঝরা পাইন পাতা ও কালো পিচ ঢালা পথে তৈরি করেছে দারুণ এক শিল্পকর্ম।
 


রিপোর্টিং-এর একদিন আগেই পৌঁছেছি। ক্যাম্পাসের প্রতিটি অলিগলি আমার পরিচিত। চারপাশটা নিজের উঠান মনে হচ্ছে যদিও প্রায় চার বছর পর আবার এসেছি। এর আগে এখান থেকেই পর্বতারোহণের মৌলিক প্রশিক্ষণ নিয়েছি। বলছি বিশ্বের ফাইনেস্ট পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ‘নেহরু ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং’ এর কথা। সংক্ষিপ্ত বলে ‘এনআইএম বা নিম’। এটি ভারতের পর্বতারোহণ ইনস্টিটিউটগুলোর মধ্যে প্রধান হিসেবে বিবেচিত এবং এশিয়ার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পর্বতারোহণ ইনস্টিটিউট। ১৯৬৪ সালে ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং উত্তর প্রদেশের রাজ্য সরকার দ্বারা এই পর্বতারোহণ ইনস্টিটিউটের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল। উত্তরকাশি বিশেষ করে গাঙ্গোত্রি অঞ্চলের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে এনআইএম-এর জন্য জায়গাটি বিশেষভাবে নির্বাচন করা হয়েছিল। ভাগীরথী নদীর পূর্ব তীরে উত্তরাকাশির পবিত্র নগরের গাঁ ঘেঁষে থাকা পাহাড়ের উপরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এই ইনস্টিটিউট। লক্ষ্য বিভিন্ন পর্বতযাত্রা এবং সাহসিক অ্যাডভেঞ্চার কোর্সগুলোর মাধ্যমে তরুণ নারী পুরুষ এবং স্কুল শিশুদের পর্বত ও প্রকৃতিতে পরিচয় করানো, সাহসিকতার উদ্ভাবন, পরিবেশগত সচেতনতা এবং সংরক্ষণ নিশ্চিত করার জন্য প্রচলিত পরিবেশগত নির্দেশিকা অনুসরণের উপর প্রশিক্ষণ প্রদান। ১৪ নভেম্বর, ১৯৬৫ সালে এনআইএম প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু, যিনি একজন পাহাড় ও প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন। তার নামেই এর নামকরণ। ইনস্টিটিউটটের প্রথম প্রিন্সিপাল ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জ্ঞান সিং।
 


উত্তরকাশি শহর থেকে বেরিয়ে ভাগীরথী নদী থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ক্যাম্পাস। এটি সমুদ্রসমতল থেকে ৪ হাজার ৩০০ ফুট উপরে লাদারি রিজার্ভ বনের মধ্যে ঘন পাইন বনের চাদরে মোড়ানো। এটি একটি বিশাল ক্যাম্পাস, প্রায় সাত হেক্টর বনভূমিতে বিস্তৃত। সুন্দর এই ক্যাম্পাসটি চমৎকারভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় এবং এর প্রশিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণার্থীদের আদর্শ সুস্থ শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বিস্তৃত পরিসেবা সরবরাহ করা হয়। ইনস্টিটিউটের প্রধান  একজন সেনাবাহিনী অফিসার।
 


নিম-এর দৃষ্টিনন্দন তোরণ আমাদের স্বাগত জানালো। সুন্দর সাজানো গোছানো ক্যাম্পাস। রাস্তার দুই পাশে ফুলগাছে ফুল ফুটে আছে। এই ক্যাম্পাসের প্রায় প্রতিটা স্থাপনার আলাদা আলাদা নামকরণ করা হয়েছে। কোনটা পর্বতের নামে, কোনটা বিখ্যাত ব্যক্তির নামে। রাস্তার বামপাশে নিচের চৌখাম্বা নামের বিল্ডিংয়ের নিচ তলায়  স্টোর রুম যেখানে পর্বতারোহণের সকল পোশাক ও টেকনিক্যাল জিনিসপত্র রাখা। এসব জিনিসপত্র প্রশিক্ষণার্থীদের ব্যবহার করতে দেয়া হয় এবং প্রশিক্ষণ শেষে ফেরত নেয়া হয়। গঙ্গোত্রী অঞ্চলে যখন পর্বতারোহীরা অভিযানে আসেন তখন তদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভাড়া নিতে পারেন নির্দিষ্ট মূল্যে। এই একই বিল্ডিংয়ের ওপর তলায় মেডিকেল অফিসারের অফিস। এখান থেকেই প্রশিক্ষণার্থীদের মেডিকেল চেকআপ করা হয়। রাস্তার ডানপাশে একটু উঁচুতে এনআইএম-এর হিমালায়ান জাদুঘর। এই জাদুঘরের নাম কৈলাশ। আগে এটি ছোট আকারের ছিলো। এখন নতুন করে বড় পরিসরে তৈরি করা হচ্ছে। এখানে পর্বতারোহণের বিভিন্ন জিনিসপত্রসহ বিভিন্ন সারক সংরক্ষণ করা আছে। জাদুঘরের সাথেই একটি স্যুভিনিয়র শপ আছে যার নাম কুটেশ্বৌর। এখানে মাইকটুলী নামে একটি ক্যান্টিনও আছে। একটু এগিয়ে রাস্তার বামপাশে একটি বড় লাইব্রেরি চোখে পড়ল। এখানে পৃথিবীর বিখ্যাত লেখকদের পর্বতারোহণ, বিভিন্ন দুঃসাহসিক অভিযানসহ বিভিন্ন বিষয়ের বই সংরক্ষিত আছে। এই লাইব্রেরিতে বিভিন্ন ভাষার বাইয়ের সাথে বাংলায় লেখা আমার ‘মাউন্ট কেয়াজো-রি শিখরে বাংলাদেশ’ ও ‘পদচিহ্ন এঁকে যাই’ বই দু’টিও সংরক্ষিত আছে। লাইব্রেরির পাশেই জয় হার্শ বাহুগুনা অডিটরিয়াম। এর নামকরণ করা হয় বিখ্যাত পর্বতারোহী দুই ভাই জয় বাহুগুনা ও হর্শ বাহুগুনার নামে। এখানে ২৫০ জন প্রশিক্ষণার্থী বসার ব্যবস্থা রয়েছে। এর সাথেই এনআইএম-এর হোস্টেল যেখানে প্রশিক্ষণার্থীদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এই হোস্টেলের নাম তপোবন।
 


তপোবনের সামনে পাইন বনের ভিতরে বাস্কেট বল, ভলিবল খেলার মাঠ। আর একটু সামনে এগিয়ে গেলেই অফিস ব্লক। নাম থালাই সাগর। খোলা মাঠেই রয়েছে পাইন বল নামে আর্টিফিশিয়াল ক্লাইম্বিং ওয়াল। এই ওয়ালের উচ্চতা সাড়ে পনেরো মিটার। এটা হিমালয়ান ইন্টারন্যাশনাল আর্টিফিশিয়াল ক্লাইম্বিং ওয়াল। এখানেই ২০০৪ সালে এশিয়া কাপ ইন্টারন্যাশনাল আর্টিফিশিয়াল ক্লাইম্বিং অনুষ্ঠিত হয়। এখানে একটি জ্ঞান মাল্টিপারপোস হল রয়েছে। এর ভিতরে ১০ মিটার উচ্চতার ইনডোর আর্টিফিশিয়াল ক্লাম্বিং ওয়াল, ব্যাডমিন্টন কোর্ট, টেবিল টেনিস ও জিমনেশিয়াম রয়েছে। ক্যাম্পাসে দুনাগিরি নামে একটি সেমিনার হলও রয়েছে। যেখানে গোল টেবিলে প্রায় ৬০ জন বসার ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের মতো আরো প্রায় সাত আট জন চলে এসেছে। আমাদের সবাইকে হোস্টেলের একটি রুম দেয়া হয়েছে। যেহেতু কাল রিপোর্টিং তাই সবাই কাল আসবে। আর তখনই সবাইকে রুম ভাগ করে দেয়া হবে। তখন এখানেই থাকতে হবে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ নভেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়