ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

হিমালয়ে তুষার ঝড়ের কবলে

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৭, ২৯ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হিমালয়ে তুষার ঝড়ের কবলে

ইকরামুল হাসান শাকিল : আবহাওয়ার সাথে আমাদের শরীর মানিয়ে নিতে বেসক্যাম্পে আমাদের তিন-চার দিন থাকতে হবে। এই কয়দিন আমরা ডুকরানি বামক গ্লেসিয়ারে ক্লাইম্বিং অনুশীলন করেছি। পর্বতারোহণের উচ্চতর প্রশিক্ষণের মূল অংশ হলো অভিযান। বেসক্যাম্পের চতুর্থ দিন থেকে শুরু হলো মূল অভিযান। ৮ মে আমাদের বেসক্যাম্প থেকে অ্যাডভান্স বেসক্যাম্পে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রেখে আসার কথা। কিন্তু আবহাওয়া সকাল থেকেই খারাপ হওয়ায় আর যাওয়া হলো না। সারাদিন তাবুর ভেতরেই কাটাতে হলো। গত কয়েকদিন টানা তুষারপাত হওয়ায় হাঁটু পর্যন্ত বরফ জমেছে। বরফের কঠিন পথ পারি দিয়ে আমরা ৬ ঘণ্টা পর অ্যাডভান্স বেসক্যাম্পে এসে পৌঁছাই।



পৌঁছেই হাঁটু পর্যন্ত বরফ পা দিয়ে লাথি দিয়ে দিয়ে তাঁবু লাগানোর জায়গা করে নিলাম। দুইদিন আমাদের এখানেই থাকতে হবে। গ্লেসিয়ারে গিয়ে আইসে খাড়া দেয়ালে কীভাবে দড়ি লাগিয়ে, কীভাবে রাস্তা তৈরি করতে হয়, ক্রেভাস ক্রস করতে হয়, ক্রেভাস রেসকিউ করতে হয়, ডিসেন্ডিং শেষে কীভাবে পিটন খুলে আনতে হয় ইত্যাদি শেখানো হলো। প্রতিদিন সকালে আবহাওয়া কিছুটা ভালো থাকে। দুপুর হওয়ার সাথে সাথেই আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করে। আবার রাত বাড়ার সাথে সাথেই আবহাওয়া ভালো হতে শুরু করে। পর্বতের চরিত্রই যেন এরকম খামখেয়ালীপনা করা।

এখানে আমরা প্রতি তাবুতে সাতজন করে থাকি। পাশের উঁচু পাহাড় থেকে একটু পরপর তুষার ধ্বস হচ্ছে চারপাশ কাঁপিয়ে। একটি বড় তুষার ধ্বস আমাদের ক্যাম্পের পাশ দিয়েই চলে গেল। রাতে তাবুর ভেতরে থাকায় দেখা হয়নি তবে শব্দ পেয়েছি। এত বিকট শব্দ যে পিলে চমকে ওঠে। সকালে সেই তুষার ধ্বস দেখে সবার চোখ কপালে উঠে গেল! কারণ আমরা অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছি। তবে যেখান থেকে আমাদের খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয় তার উপর দিয়েই ধ্বসটি চলে গেছে।


আজ ভোরেই জনলির কাঁধ ঘেঁষে সূর্য অস্তিত্ব জানান দিলো। আমরা আজ ক্যাম্প-১ পর্যন্ত রোড ওপেন করতে ও মালামাল রেখে আসতে ট্রেকিং শুরু করলাম। পুরো পথ একটি গ্লেশিয়ারের উপর দিয়ে। হাঁটু পর্যন্ত তুষার। এগিয়ে চলতে খুবই বেগ পেতে হচ্ছে। পুরোটা পথে অসংখ্য ওপেন ক্রেভার্স ও হিডেন ক্রেভার্স। তাই খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। কঠিন কঠিন চড়াই পার হয়ে আমরা ক্যাম্প-১ এ পৌঁছাই। এখানে একটি তাবু করে তার ভেতরে মালামাল রেখে আবার অ্যাডভান্স বেসক্যাম্পে ফিরে আসি। বিকেল থেকে আবার মেঘে চারপাশ হোয়াইট আউট হয়ে গেলো। এক তাঁবু থেকে আরেক তাঁবু দেখা যাচ্ছে না। সন্ধ্যার দিকে শুরু হলো প্রচণ্ড তুষার ঝড়। ঝড়ের তেজ কমছেই না। সময় যতো বাড়ছে, তুষার ঝড়ও বাড়ছে। আমরা তাবুতে সাতজন। তাবুর চারপাশে শক্ত করে ধরে আছি। আমরা ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করছি। সে এক ভয়াবহ অবস্থা। তিন-চার ঘণ্টা এমন চলল। কোনো ভাবেই ঝড়ের তেজ থেকে তাবু রক্ষা করতে পারছি না। যদি তাবু ভেঙ্গে যায় তাহলে আমাদের স্লিপিং ব্যাগসহ সকল পোশাক ও জিনিসপত্র তুষারে ভিজে যাবে। আর ভিজে গেলেই- অভিযান শেষ।



শুধু অভিযানই শেষ না, ফ্রস্টবাইট এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তাপমাত্র হিমাঙ্কের নিচে ২০ ডিগ্রি। প্রচণ্ড ঠান্ডা বাতাসের সাথে তুষারও তাবুর ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। তাই স্লিপিং ব্যাগসহ সকল পোশাক ও জিনিসপত্র বড় পলিপ্যাকে ঢুকিয়ে ফেললাম। ভয়ংকর একটি সময় পাড় করছি। রাত বারোটার দিকে ঝড় থেমে গেল। ভাবলাম বেঁচে গেলাম এ যাত্রা। কিন্তু তুষারপাত চলছেই। আমরা তাবু থেকে বাইরে এসে দেখি আমাদের বেশির ভাগ তাবুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তাবু তুষারের ভেতরে অর্ধেক ডুবে আছে।



সারারাত তুষারপাতে ক্যাম্প-১ এর পথ আগের মতোই বরফে মিলিয়ে গেছে। তাই নতুন করে আবার রোড ওপেন করে ক্যাম্প-১ আসতে হয়েছে। এখানে যে তাবুতে মালামাল রেখেছিলাম সেই তাবু রাতের ঝড়ে ভেঙে বরফের নিচে চাপা পড়ে আছে। মুহূর্তের মধ্যেই আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি তাবু লাগিয়ে তাবুর ভেতরেই দুপুরের খাবার তৈরি করে নিলাম। এখানে নিজেদের খাবার নিজেদেরই তৈরি করতে হচ্ছে। বিকেলে সামিটের রোড ওপেন করতে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় আর যাওয়া হলো না। রাত তিনটায় ক্যাম্প-১ থেকে সামিটের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। হাঁটুর উপর পর্যন্ত বরফ ঠেলে কঠিন খাড়া চড়াইয়ে দড়ি ফিক্সড করতে করতে  আর রোড ওপেন করে এগিয়ে চলছি। ১৪ মে ভারতীয় সময় সকাল ৯ টা ২২ মিনিটে ১৮ হাজার ৭১১ ফুট উঁচু ভারতের উত্তরাখাণ্ড অঞ্চলের গারওয়াল হিমালয়ের দ্রোপদী কা ডান্ডা-২ এর চূড়ায় পৌঁছে গেলাম। তুলে ধরলাম গর্বের অহঙ্কারের লাল-সবুজের পতাকা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে পাঁচটি দেশের ৪২ জন অভিযাত্রীর মধ্যে ৩৯ জন্য সফলভাবে সেবার আরোহণ শেষ করেছিলাম।  

 





রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ নভেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়