ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

চুনিয়ার পূর্ণিমার রাত অন্তরে পশেছে

মাহমুদ নোমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৩, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চুনিয়ার পূর্ণিমার রাত অন্তরে পশেছে

মাহমুদ নোমান: পূর্ণিমা, আমার আত্মাধীন বন্ধু। ঠিকভাবে বলতে পারছি না, কখন সে ফেইসবুকে বন্ধুত্বের বলয়ে সংযুক্ত হয়েছে। তবে ছয়মাস আগে থেকে অনেক সময় আমার স্ট্যাটাস দেয়ার মিনিট না পেরোতেই ঠুস্ করে সে লাইক দিতো। এরকম চলতে থাকে মাসখানেক। প্রতি পোস্টে, সবার আগে লাইক। কারো সাথে বাজি না তো! হা হা হা। অথচ আমার ভেতরে খুব জানাজানি হলো এতে। কৌতূহল বাড়ছিল ধীরে ধীরে।  একদিন তার একটা ছবিতে দেখলাম, সে গলা উঁচিয়ে কি যেন পান করছে। হাতে বাদামি রঙের পাত্র। ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা। অনেক মহিলা তার পাশে এবং কয়েকজন হাতে ধরে তাকে পান করতে সাহায্য করছে। বা পান করাতে বাধ্য করছে।

মায়ামাখা ছবি। আহা! আমার কৌতূহল এবার বেড়ে গেল। কমেন্ট করলাম- এটা কী খাচ্ছেন?

রিপ্লে এলো- চু।

- কি!

- হুম

- বুঝলাম না

হঠাৎ ইনবক্সে এলো সে। সেই প্রথম তার ইনবক্সে আসা।

- এটা হলো আমাদের মান্দিদের বিশেষ পানীয়। যেটাকে আপনারা মদ বলেন।

অতি কৌতূহলে বললাম- আমাকে খাওয়াতে পারবেন? অজানাকে জানার কৌতূহল থেকেই বললাম।

- আপনি তো অনেক দূরে।

- দেখি একদিন...

কয়েকদিন পর আরেকটা ছবিতে ওর পেছনে থাকা ঘন শালবন দেখে আমি বিস্মিত হলাম। মুগ্ধ চোখে আমি লিখলাম- আমি কী আপনার ক্যামেরাম্যান হতে পারি?

সে রিপ্লে না দিয়ে রিয়্যাক্ট দিলো- হা হা হা। তারপর লিখলো- একবার চুনিয়ায় আসুন।

চুনিয়া শব্দটি শুনে কী আপনাদের মনে আকুলিবিকুলি করছে? হঠাৎ কারো কারো কী মনে পড়লো- রফিক আজাদের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’?

হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। সেই চুনিয়া গিয়েই রফিক আজাদ লিখেছিলেন বিখ্যাত কবিতাটি। পূর্ণিমার মুখে চুনিয়ার নাম শুনতেই কৌতূহল আরো বেড়ে গেল। ইনবক্সে আমাদের কথা চলছেই। মান্দিদের সম্পর্কে আরো আরো কথা। মন আর মানছে না। অস্থির হয়ে উঠি।

ইনবক্সে জানাজানি হলো ঠিকানা। আশ্চর্য যে, আমাদের বাঙালি পুরুষ যেখানে কখনো মেয়েবন্ধু ঘরে আনবে স্বপ্নেও ভাবে না! সেখানে একজন মেয়ে হয়ে ছেলেবন্ধুকে কীভাবে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাল সে। এখানেই মান্দিদের বড় মনের পরিচয়...।

কথা হলো, সেপ্টেম্বরের শুরুতে ঢাকায় বইয়ের ব্যাপারে কাজ শেষে সোজা চুনিয়া যাবো। কথা অনুযায়ী ঢাকায় কাজ শেষে গত ৮ সেপ্টেম্বর দুপুরবেলা মহাখালী বাস স্টেশনে এসে দাঁড়ালাম। সেখান থেকে ‘বিনিময়’ বাসে উঠে বসলাম। ভাড়া মাত্র ২০০ টাকা। ইনবক্সে কীভাবে যাবো সব বিবরণ পেলেও, আমি নড়বড়ে। কেননা আত্নীয়ের বাড়ির বাইরে কোথাও একা বেড়ানো হয়নি এই বয়সেও। তাই মধুপুর শহরে এসে পূর্ণিমা দাঁড়াবে এমন কথা হলো। গাড়িটাও থামবে মধুপুর বাস স্টেশনে। মধুপুর গিয়ে যখন নামলাম, তখন মাগরিবের আজান দিচ্ছে। গাড়ি থেকে নামতেই চত্বরে তিনটা আনারসের নান্দনিক ভাস্কর্য। ভাস্কর্যের দিকে একপলক তাকিয়ে ভাবলাম, সেজন্য বুঝি মানুষে বলাবলি করে- মধুপুরের আনারস!

চত্বরের পশ্চিমে জামালপুর রোড আর উত্তরে ময়মনসিংহ রোড। চত্বরের সাথে লাগানো মসজিদের আজান শুনে মনটা কুঁকড়ে গেলো- জীবনে প্রথম কোথাও একা এলাম। পূর্ণিমা রাস্তার পূর্বপাশ থেকে হাত উঁচু করল। আমিও হাত উঠিয়ে সাড়া দিলাম। দৌড়ে রাস্তার পশ্চিমে চলে এলো সে। তারপর অটোতে চড়লাম দুজন। ময়মনসিংহ রোড দিয়ে ধীরগতির অটো যতো এগুচ্ছে আঁধারের সঙ্গে মাটির একটা শীতল গন্ধ নাকে আসছে। পবিত্র বাতাসে অনেক গহীনে যেন হারিয়ে যাচ্ছি। অটোতে পূর্ণিমা আমার মুখোমুখি বসল। দুজন ঢুলছিলাম। কেউ তেমন কথা বলিনি। ২০ মিনিটেই আমরা ২৫ মাইল পৌঁছেছি। ভাড়া ১০ টাকা চুকিয়ে নামতেই বিভিন্ন দোকানের সাইনবোর্ডে ২৫ মাইল, জলছত্র দেখে আশ্বস্ত হলাম। ঠিক তো, ইনবক্সে দেয়া ঠিকানা মতোই তো এলাম?



পূর্ণিমা অটো থেকে নেমেই আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে সামান্য বাজার করে আনলো। তারপর ২৫ মাইলের পশ্চিমের রাস্তা দিয়ে চুনিয়া যাওয়ার রাস্তাটি। সে সিএনজি ভাড়া করলো। বুঝলাম সন্ধেবেলা ওদের জন্য রাত। ভাড়া বাড়িয়ে ২০০ বলল টাকা। হয়তো অটোতে গেলে ২০ টাকা। সেখানে এমনকি দ্রুত যেতে বা একা হলে মোটর বাইকেও যাওয়া যায়। ভাড়া ৪০ টাকা। মটর ভ্যানও আছে। ভাড়া ১৫-২০ টাকা। আমরা সিএনজিতে চড়তেই অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। ঘোর অমাবস্যার আগের রাত। শীত আসবে আসবে এমন পরিবেশ। একটু ঠাণ্ডার আনাগোনা। আঁধারে তেমন কিছু আশপাশে দেখছি না। পূর্ণিমা আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল, যেন বনের দিকে রাতে না যাই... বনের দিকে রাতে বানরের জন্য আমার অবস্থা কাহিল হতেও পারে। সিএনজি বনের ভেতর দিয়ে গেল না। পীরগাছার দিকে ব্রিকসলিন রাস্তা ধরে এগুচ্ছে। খানাখন্দে লাফিয়ে উঠছি। রোমাঞ্চে বেশ অন্যরকম ভালো লাগছে।

সিএনজি থেকে নেমে কলা, জাম্বুরা গাছের নিচ দিয়ে যেতে নাকে ঝাঁঝালো মাটি ঘেমে যাওয়া গন্ধ এলো। যেন নাকের পশম পুড়ে গেছে। ঘরের সামনে অন্ধকারে আমার মোবাইলের টর্চ লাইট হঠাৎ একটা মহিলার চোখ সেঁধিয়ে দিলো। অথচ মহিলাটি খটখটে হাসছে...!

পূর্ণিমা মহিলাটিকে আম্মু, আম্মু বলে কী যেন বলছে। তাদের ভাষাটা বুঝলাম না। তবে আমার টর্চলাইটের আলো ঐ মহিলার চোখে লাগার  জন্য অপমানিত বোধ করছে। মনে হলো, মহিলাটি কি যেন বলছে! এবং আমাকে উদ্দেশ্য করেই।

আমরা ঘরে ঢোকার আগেই বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। মোবাইলের আলোয় পূর্ণিমা ঘরে ঢুকলো। আমিও টর্চ জ্বালিয়ে রাখলাম। ও ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলাম- মা, কি বলছে?

- কিছু না, বললো ছেলেটি চোখে আলোটা ধরেই আছে।

পূর্ণিমা বলছে আর হাসছে। আমিও হেসে উঠলাম। বিরক্তি না এনে মহিলাটির হাসি অদ্ভূত। এই হলো মান্দি। মান্দি শব্দটার অর্থ মানুষ। নিজেদের পরিচয়ে এরকম বলতে পারা যে- আমি মানুষ। সত্যি, ওরা মানুষ। ওদের ভাষাটা আমি বুঝতে পারছি না। সেই ভাষার নাম ‘আচিক’। বর্ণমালা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি।

আমার জন্য গেস্ট রুমের বিছানা ঠিক রাখা হলো। টেবিলে রাখা হলো প্রথমে এক গ্লাস হালকা হলদে পানীয়। একে বিচ্চি বলে। বিচ্চির অর্থ রস। ভাত আর মেডিসিনে দিক্কাতে পঁচিয়ে কয়েকদিন রেখে দিলে আবছাআবছি রস বেরোয়। একেই বিচ্চি বলে। আর দিক্কা মানে চু তৈরি করার মাটির কলসির মতো পাত্রবিশেষ। রস খাওয়ার পরে পানি ঢেলে, ছেঁকে যা তৈরি হয় সেটাই চু। মানে মদ। টেবিলে রাখা গ্লাসটাতে আমাকে চু দেয়নি, রস দিয়েছে। রস মানে একেবারে কড়া ও আসলটা। অদ্ভুত যে, বিচ্চির সাথে ছিল এক গ্লাস গরুর দুধও!



আমার যে কী হচ্ছিলো বুঝতেই পারছি না। খেয়ে একটু মাতাল হতে চাচ্ছি; তবে শেষ পর্যন্ত এক ঢোক দুধ পান করতে হলো। তারপর রাতের খাবার! সন্ধ্যা সাতটায়!

হুম, সন্ধ্যা সাতটায় চারপাশ নিঝুম। চুনিয়ার প্রায় সবাই রাতের খাবার খেয়ে বিছানায়। আমার রুমের পশ্চিমের ঘরটার মধ্যবয়স্ক লোকটির নাক ডাকছে। আর রাতভর মদের ঘোরে নিজের সঙ্গে অনবরত কথা বলে যাওয়া। সুনসান নীরবতায় এভাবে ডুবে যায় চুনিয়ার মান্দিদের জাগতিক কোলাহল। রাতে আমার ঘুম হয় নি। জেগে ছিলাম রাতের আকাশের ঝলসে যাওয়া পূর্ণিমার চাঁদ দেখে দেখে। রুমের বাইরে বসার একটা চৌকিতে জবুথুবু হয়ে বসে ছিলাম। অন্যরুমের সামনেও আরেকটা চৌকি। এটা সোফার মতো। চুনিয়ার সবার ঘরের সামনে প্রায় দুই তিনটা থাকে। একেকটাতে ৪-৫ জন একসাথে বসা যায়। এইসব চৌকি দেখেই বুঝা যায়, মান্দিরা কতটা আড্ডাবাজ। চু খাওয়ার তালে তালে এখানে বসে গল্প করা তাদের ঐতিহ্য।

সেই চৌকিতে বসে আছি। রাত সন্ধ্যা থেকে গভীর। গভীর থেকে  গভীরতর...। রাতের সৌন্দর্য কতটা মোহনীয় সে চৌকিতে বসে টের পাওয়া যায়। চুনিয়ার সব ঘরের উঠোনে নানান জাতের ফুলের গাছ থাকে। পূর্ণিমাদের বাগানে তখন গোলাপ ফুটেছে। ফুলের পাঁপড়ি ছড়িয়ে রয়েছে যেন আমার বিছানার চারপাশে। রাতের জোনাকি, ঝিঁ ঝিঁ ডাক, হঠাৎ কয়েকটা পাখির ডেকে ওঠা অনেক মনোহর, হে জীবন...

অর্ধেক রাতে অতিথিদের ঘুম ভেঙে যাবে নিশ্চিত। হতে পারে একটা পাতা পড়ার শব্দেও! অথবা পর্যাপ্ত ঘুম হওয়ার জন্যও। ফজরের আযানের পরপরই ঘুম থেকে উঠে এখানে, মোরগের ডাকের সাথেই... সকালে আশপাশের কয়েকজনক পরিচয় দিলো চাচ্চি বলে। চাচ্চি অর্থ অতিথি। পরিচয় দিতে আরো বললো পূর্ণিমার বাজু, লেখালেখি করে, চট্টগ্রাম বাড়ি। বাজু মানে বন্ধু। সত্যিই তো, বন্ধু বিনে জীবন চেনা যায় না রে...। (চলবে)





রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়