ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

টাঙ্গুয়ার হাওড়ে হাছন বিলাস || শাকুর মজিদ

শাকুর মজিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২১, ১৫ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
টাঙ্গুয়ার হাওড়ে হাছন বিলাস || শাকুর মজিদ

শাহ আব্দুল করিমের সঙ্গে নৌকায় বসে গান শোনা

ভাটি এলাকা আমার খুব প্রিয়। বিশেষ করে পানি। আমার ছোটবেলা যে গ্রামে কেটেছিল সেটি ভাটি এলাকার মধ্যে পরে, উজানের লোকেরা আমাদের এলাকাকে বলতো ‘ভাটা ভাগ'। আসামে জোর বৃষ্টি হলে পরদিন আমাদের গ্রাম ভাসিয়ে দিতো। এখন আর সেই পানি দেখি না, নৌকা বাইতেও পারি না, কিন্তু সুযোগ পেলেই হাওড় বিলাস করতে খুব মন চায়।

আমাদের বাড়ি সিলেটের উত্তর পূর্ব কোণে। এটা নামেই ভাটা ভাগ, আসল ভাটি এলাকা সিলেটের পশ্চিম দিকে, সুনামগঞ্জ এলাকায়। এখানে দিরাই-শাল্লার এলাকাজুড়ে কয়েকবারই নৌকা করে গিয়েছিলাম শাহ আব্দুল করিমের বাড়ি। বাড়িতে যাওয়া আসার পথেই হাওড় দেখা যায়। বর্ষায় হাওড় তো না- রীতিমতো সাগর! দিরাই পড়েছে সুনামগঞ্জে। সুনামগঞ্জের আসল হাওড় টাঙ্গুয়ার হাওড়, আমার খুব শখ একদিন টাঙ্গুয়ার হাওড়ে যাব।
 

হাছনজানের রাজার কুশীলবেরা যখন যাত্রাপথে


শাহ আব্দুল করিমের পর ইচ্ছা হলো হাছন রাজাকে নিয়ে নাটক লিখবো। কিন্তু হাছন রাজার উপর কয়েকটা বই পড়াই শেষ হচ্ছিল না। মনে হলো হাছনের ঘরবাড়ি আর তার সেই দেখার হাওড় যদি না দেখতে পারি তাইলে আর কিভাবে নাটক লেখা হবে?

আমি সুনামগঞ্জ যাই। একা একা ঘুরি। বেশিক্ষণ একা ঘুরতে হয় না, আমার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লোকজন খবর পেয়ে যায়, আমি এসেছি। আমার ভালোবাসার মানুষেরা চলে আসে। কেউ মোটর সাইকেল দিয়ে নদীর পাড় বরাবর আমাকে নিয়ে ঘোরে, কেউ হয়তো নৌকাও জোগাড় করে ফেলে। আমি গান বাজনা পছন্দ করি, এমন খবর লোকজন জানে। আমাদের নৌকায় মাঝি-মাল্লা যারা থাকেন তাদের মধ্যেই গায়কদল তৈরি হয়ে যায়। সুনামগঞ্জ শহরকেন্দ্র থেকে পূর্ব পাড়ে বিশাল হাওড়। একে বলে দেখার হাওড়। হাছন রাজাকে নিয়ে এই হাওড়ের অনেক গল্প আছে। সবচেয়ে দুর্বল গল্পটি হচ্ছে যে, হাছন রাজা নাকি তার স্বভাবসুলভ নব বিবাহিতা বধূদের তুলে নিতেন এই হাওড় থেকে। একবার এ খবর তার মার কাছে যাওয়ার পর এক নাইওরী নৌকায় তার মা বধূ বেশে ঘোমটা দিয়ে বসে থাকেন। শিকার ভেবে হাছন রাজা নাকি এই বধূ অপহরণ করতে গিয়ে মাকে দেখেন, এবং পরে আউলিয়া হয়ে যান। এই গল্পের কোনো সত্যতা নাই, তবে এমন গল্প চালু আছে। খবর নিয়ে জানি, হাছন রাজার জন্মের আগে থেকেই এই হাওড়ের নাম তাই ছিলো। শীতকালে অনেক ‘ডেখা' (বলদ শাবক) এই হাওড়ের মাটিতে চড়তো বলে নাম ছিলো ‘ডেখার হাওড়’, সেখান থেকে এসেছিল শব্দটি। হাছন রাজা, কুড়া শিকার, দুই তিন নৌকা ও গোটাআস্টেক তরুণী নিয়ে হাওড় বিহার যে করতেনই তা মুজতবা আলীর স্মৃতিচারণে পড়েছি। নারী বিলাসী হাছন রাজা এক মহিলাকে একটা গ্রাম পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছিলেন। সেই মহিলা ভালোবেসে তাকে এক গ্লাস পানি খাইয়েছিল- এই ছিল তার কারণ। সেই গ্রামটি এখনও আছে। গ্রামের নাম ‘বেটির গাও’। হাছন রাজার বাড়ি থেকে নৌকায় ২০-২৫ মিনিটে সেই গ্রামে যাওয়া যায়।

আমি একবার বেটির গাও দেখতে গিয়েছিলাম। সুনামগঞ্জ শহর থেকে নৌকা চড়ে হাওড় দেখার নানা ব্যবস্থা আছে। সাহেব বাড়ির ঘাট (মানে হাছন রাজার বাড়ির ঘাট) বা নতুন বানানো রিভার ভিউ পয়েন্টে প্রচুর নৌকা ভেড়ানো থাকে। ছইওয়ালা নৌকা, ছই ছাড়া নৌকা। পাঁচশ বা হাজার টাকায় ভাড়া করে ফেলা যায় এক বিকেলের জন্য। বিকেলবেলার লিলুয়া হাওয়ায় হাওড়ে ভাসতে ভাসতে শোনা যায় নানা রকমের গান।
 

বাউল সূর্যলালের সঙ্গে হাওড় ভ্রমণ

আমাদের ভাটি এলাকা সুরের এলাকা। এখানে নৌকার উপর বসলেই মনে গান আসে। আর কেউ যদি আব্দুল করিমের মতো ভাব আনতে পারে, মানে ঝিল মিল ঝিল মিল করা বাইচের নৌকা দেখে যদি কেউ মানুষের দেহের সাথে মিলিয়ে নেবার ক্ষমতা রাখে, তাহলে তো কথাই নাই। সে কারণেই কী না জানি না, আমাদের দেশে যতো বাউলের জন্ম হয়েছে তার ৭০ শতাংশই এই ভাটি এলাকায়। এখানে ঢেউয়ের হালকা দোলনের সঙ্গে সুরের যোগসূত্র তৈরি হয়ে যায়। সুর আর সংগীত ঢেউয়ের তালে তালে নাচে। আর মানুষের গলার স্বরও পানিতে প্রতিফলিত হতে হতে অনেক দূর চলে যায়। খোলা আকাশের নিচে একা একা নৌকা বাইতে বাইতে মাঝি মাল্লারা গান গায়, ভাটির গান, আমাদের ভাটিয়ালি। এমন উদাস করা গান আমি সুনামগঞ্জ গেলেই বেশি শুনি। সবচেয়ে মজা পেয়েছিলাম দিরাইতে ।

আব্দুল করিমের বাড়ি গিয়ে যখন উপস্থিত হলাম চারপাশে থইথই পানি। আমার ইচ্ছা হয়েছিল নাওয়ের গলুইতে তাকে বসিয়ে গান শুনতে। এর আগে, যখন আমার শৈশবে, বর্ষাকালে বড়োদের দেখতাম নৌকার মধ্যে ক্যাসেটপ্লেয়ার নিয়ে সারা বিকাল-সন্ধ্যা করিম-আমির-দুরবীন-মুজিব, আলী সরকার-হামিদ এদের গান শুনতেন। আমি যখন এদের একজনের দেখা পেয়েই গেলাম, সঙ্গে আমার ক্যামেরা, আমি ঠিক করলাম, তার গান রেকর্ড করেই ছাড়বো। তাকে নিয়ে আমি নৌকা ভাসালাম। পুরো দুই ঘণ্টা শুটিং এর অজুহাতে আমি আসলে তখন শাহ আব্দুল করিমের গানই শুনেছিলাম। দিরাইতে এর পরেও অনেক গান শুনেছি, শাহ করিমের শিষ্যরা আমাকে দেখলেই বুঝে ফেলেন- এবার গান গাইতে হবে। তারাও তৈরি হয়ে যান।
 

পানির সঙ্গে

করিমের পর হাছন রাজা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। কাজ মানে তাকে জানার জন্য তার উপর লেখা বই পড়া, আর তার চারণ ভূমি চিরে বেড়ানো। আমি একবার একা গেলাম সুনামগঞ্জ এবং এক বিকেলে এক মাঝির নৌকায় উঠে গেলাম। মাঝি চিন্তায় পড়ে যায়। এই লোক যাবে কোথায়? আমি বলি- আপনার সঙ্গে, আপনার নৌকায় রাতে থাকবো। মাঝি হাসে। মাঝ রাতে সে আমাকে তীরে এনে নামিয়ে দেয় আর সেই রাতেই আমি পেয়ে যাই হাছন রাজাকে। শুনি মাঝে মাঝে হাছন রাজাও আসেন এই হাওড়ে।

আর যায় কোথায়! ঢাকা ফিরে লিখে ফেলি নাটক- ‘হাছনজানের রাজা’। এই নাটক মঞ্চস্থ করতে রাজি হয় প্রাঙ্গণে মোর। এর দলনেতা, পরিচালক অনন্ত হীরার ইচ্ছা- স্ক্রিপ্টটা ফ্লোরে ফেলার আগে তিনি একবার হাছন রাজার বাড়ি জিয়ারত করতে চান। এবং আমাকে সঙ্গে নিয়ে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ আমার চেনা হয়ে যায়। লঞ্চঘাট, সাহেব বাড়ির ঘাট, রিভার ভিউ আমার চেনা জনপদ। আমরা সুনামগঞ্জের বাউলদের নিয়ে সুরমা গাঙে নাও ভাসাই। একসময় আমাদের মাথার উপর মেঘলা আকাশের ছাউনি ছাড়া আর কিছু থাকে না। উত্তরে মিটিমিটি করে জ্বলে ওঠে মেঘালয়ের পাহাড়তলার বাজার। সেখান থেকে আলো আর আমরা ভাসতে থাকি সুরের ভেলায়।

সুনামগঞ্জের জলরাশি আমাকে ছাড়ে না এরপরও। ‘হাছনজানের রাজা’ নাটকটি মঞ্চস্থ হবে খোদ সুনামগঞ্জে, হাছন রাজা মিলনায়তনে। দল যাবে সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ। কিন্তু তারা শর্ত দিয়েছে আমাকে, তাদেরকে ‘দেখার হাওড়’- যেখানে হাছন রাজা সখীদের নিয়ে বজরাবাস করতেন সেটা দেখাতে হবে।
 

যেন হাছন রাজার পিয়ারীদের নিয়ে হাওড় ভ্রমণ

এমন সুযোগও পাওয়া গেলো একবার। প্রাঙ্গণে মোর নাট্যদল সিলেট যাবে নাটক করতে, আমি কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে ফেললাম, নাটকটা হাছন রাজার জন্মভূমিতে হাছন রাজা মিলনায়তনেই যেন মঞ্চস্থ হয়। ঠিক হয়ে গেলো। এবার যাত্রার পালা। আমাকে ধরলো, তাদেরকে হাওড় দেখাতে হবে। দেখার হাওড়ে এখন পানি নাই, যেতে হবে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে। সেখানে আমি এর আগে একবার মাত্র গিয়েছি, তাও বেশ কয়েক বছর আগে। তখন মোটামুটি বর্ষাকাল, সুনামগঞ্জ থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা ইঞ্জিন নৌকায় চলার পর দেখা মিললো আসল হাওড়ের। এই হাওড়ের রূপ যিনি দেখেন নি তাকে লিখে বোঝানো যাবে না। কিছু ছবি দেখিয়ে চেনানো যায় বটে। পানির রং আর রূপ দেখে অবাক লেগেছে। শুকনো মৌসুমে যেখানে সড়ক পথ থাকে তা ডুবে গেছে ‘আফাইর’ জলে। কিন্তু এই পথের কোথাও গাছপালা নাই। হাওড়ের পানির স্রোত এখানে কোনো-না-কোনোভাবে বাধা পেয়েছে। তাই এই জায়গাটিতে পানির উপরি অংশের তিরতির করে নাচনটাও আলাদা প্যাটার্নের। হাওড়ের মূল জলাশয়ের মতো নয়। আবার কোথাও কোথাও বুক পর্যন্ত ডুবে থেকে শুধু গলাটুকু তুলে দাঁড়িয়ে থাকা গাছেদের সারিও দেখেছিলাম যে পথে, প্রায় একই রকমের পথের সন্ধান পেলাম শীতকালে সড়কপথে তাহিরপুর গিয়ে নৌকায় নদীপথ ধরে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে যেতে। আমাদের ইঞ্জিন নৌকা ছুটে চলে তাহিরপুর থেকে উত্তর-পশ্চিম বরাবর যাদুকাটা নদী দিয়ে। নৌকার মধ্যে আছে দুপুরের বাজার। মাঝির সঙ্গে সেই চুক্তি আগেই করা আছে। তার সহকারীকে নিয়ে যেতে যেতে রান্নাবাড়ার কাজটুকু সে করবে, আর দুপুরে খাবার সময় হলে মোটা চালের সাথে মাছ ভাজি আর নানা জাতের সবজির তরকারি খাওয়াবে। পথে যেতে যেতে জেলেদের পেলে তাদের কাছ থেকেও মাছ কিনবো আমরা। খাওয়া দাওয়া বড়ো কথা না, পানিতে ভাসতে ভাসতে খেতে পারা বড়ো কথা। আজ আমরা হাছন হবো। আমাদের সঙ্গে আছেন অসংখ্য ‘পিয়ারী’। তারা গাইতে জানেন, নাচতেও পারেন। গান গাওয়ার জন্য আলাদা লোক নেয়ার দরকার হয় নাই। দলের অনেকেই গান পারে, কেউ কেউ স্টেজেও গায়। শুধু তাই না, গানের গলা আশেপাশের মানুষজনদের জানানোর জন্য পাঁচশ টাকা ভাড়ায় একটা ব্যাটারিচালিত স্পিকারও আনা হয়েছে নৌকায়। আমাদের নৌকা একসময় ঘাট ছাড়ে। সেলফোনের সংযোগ থেকে বেজে ওঠে রেকর্ডেড গান- ছাড়িলাম হাছনের নাও রে।
 

হাওড়ের রূপ দেখে দর্শনার্থীর উচ্ছ্বাস


আমাদের হাছনজানের রাজা নাটকটি যারাই দেখেছেন, তারা জানেন, এমন একটা দৃশ্য দিয়ে শুরু হয় নাটক- যেখানে শহর থেকে যাওয়া এক দল তরুণ তরুণী এক মহাপূর্ণিমা রাতে হাওড় বিহার করতে গিয়ে হাছন রাজার দেখা পেয়ে যায়।

আজ, আমাদের মাঝে হাছন আসার কোনো সম্ভাবনা নাই। আসার কথাও নয়। তারপরও আমরা হাছন বিলাসে মত্ত হই। মঞ্চে যে কায়দায় কোরিওগ্রাফি হয়ে থাকে, অনেকটা সেই ধাঁচের নাচানাচি শুরু হয়ে যায় নৌকার ছাঁদে। বাদ যাই না আমরা কেউ-ই।

একসময় একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করলো- ঐ সামনের পাহাড়গুলো কিসের?

আমি বলি, মেঘালয়ের।

আর, ওইগুলো?

ওটা জৈন্তাপাহাড়।

আর পশ্চিমে?

নেত্রকোনার হাওড়।

ব্যাস- এই ডায়লোগটা স্টেজে সে-ই দেয়। মঞ্চে যে ভঙ্গিতে বলে, সে-ই ভঙ্গিতেই বলা শুরু করে দিলো- ‘মেঘালয়ের ছায়া পড়ে উত্তর আকাশে আর/ পূবের আকাশজুড়ে জৈন্তিয়া পাহাড়/ দক্ষিণ-পশ্চিম মিলে হাওড় ভাটার/ আজ রাত এই নায়ে মহাপূর্ণিমার।’

এই শুরু হয়ে যায় আমাদের হাছনযাপন। একে একে বাজতে থাকে হাছনজানের রাজার ট্র্যাক। এই গানের সাথে নাচের মুদ্রাগুলো তাদের তোলা। সুতরাং টাঙ্গুয়াগামী বজরার ছাদটি হঠাৎ করেই শিল্পকলার মঞ্চে যেনো পরিণত হয়ে যায় এবং এই করতে করতে, এক সময় বড়ো নদী, ছোট নদী পার হয়ে হয়ে এক জায়গায় আমাদের নৌকা থেমে যায়। আমাদের বলা হয়- এই মৌসুমে নৌকা হাওড়ে যায় না। আপনারা নেমে যান। ওখানে ছোট ছোট নৌকা আছে, সেগুলো দিয়ে হাওড় ঘুরতে পারেন।

আমরা গাছ-গাছালি ঘেরা একটা জায়গায় নেমে পড়ি। সারি সারি গাছ। গাছে বুক পর্যন্ত কালো দাগ। বুঝতে পারি- বর্ষার মৌসুমে এ পর্যন্ত পানি ধারণ করেছিল এসব বৃক্ষরাজি। এখন তার তলায় বসে পিকনিক পার্টির আড্ডা। আমাদের দলের ছেলেমেয়েরা প্রায় অস্থির হয়ে পড়ে। কে যে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। সবাই ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত। সামনে অবারিত জলাশয়। আর দল বাঁধা নানা জাতের পাখির ওড়াউড়ি। আমাদের হাছন রামিজ রাজু জিজ্ঞাসা করে, ভাই কুড়া পাখি কোনটা?

আমি বলি, ওইসকল পাখির মধ্যে মুরুব্বি কিছিমের কোনো একটা হবে। বকের চেয়ে বড়ো, চিলের চেয়ে ছোট। আমি ছোটবেলা দু’য়েকটা দেখেছি আমাদের হাওড়ে, সুনামগঞ্জে দেখা হয় নি। এখানে একটা ৩০/৪০ ফুট উঁচু টাওয়ার আছে। উপরে উঠে পুরোটা দেখা যায়। ওঠার সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলাবে না বিবেচনায় আমি দল থেকে প্রায় আলাদা হয়ে যাই। কতোগুলো পিচ্চি আমার কাছে আসে, ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে। বলে, গান শুনবেন? আমরা গান গাইতে পারি।

কী গান?

এক পিচ্চি শুরু করে অতীতের কথাগুলো, পুরনো স্মৃতিগুলো, মনে মনে রাইখো, আমি তো ভালা না, ভালা লইয়া থাইকো।

৭/৮ বছর বয়েসি ছেলেটা গায়। আমি সেল ফোনে তার চিত্র ভিডিও মোডে ধারণ করি। তাকে দেখে আরো কতগুলো পিচ্চি এসে ক্যামেরার সামনে বসে। একজন বলে আমার নায়ে যাবেন, নায়ে বসে বসে গান গাইবো।

 

আমি দুই পিচ্চিকে নিয়ে ছোট একটা ডিঙ্গি নৌকায় উঠে পড়ি। তারা উঠেই গান গাইতে শুরু করে। মনে পড়ে মাস কয়েক আগে একবার অনন্ত হীরা আর রামিজ রাজুকে নিয়ে সুনামগঞ্জের হাওড়ে এক অচেনা মাঝিকে অনুরোধ করতেই আমরা কয়েকটা রাধারমণ শুনে ফেলি।

রাজু বলেছিল- ভাইয়া, এই অঞ্চলের সবাই কি এমন?

আমি বলি, পানিতে যারা থাকে তাদের ১০ জনের ৭ জনই গান গাইতে পারে। তাদের গলাও শোনার মতো।

আসলে এসকল হাওড়ের পানির বোধ হয় এমন গুণ এটা সবাইকেই শিল্পী করে ফেলে। বদ্ধ ছোট ঘরে প্রকৃতির রূপে একাত্ম হয়ে আপন মনে বাথরুম সিঙ্গাররা যেমন উদ্বেল হয়, এই সব হাওড়ের নির্জনতা আর প্রকৃতিও হয়তো সেভাবেই তাদের উদ্বেল করে, একজন বিলাসী জমিদারও হাছন হয়ে যান।

আমাদের গানের আসরে সওয়ার হতে আঁকুপাঁকু করে হাছনজানের দুই পিয়ারী- আশা আর প্রীতি। তাদেরকে উঠাতেই হবে।

আমি পিচ্চিদের বলি, ওদের উঠাও।

প্রীতি আর আশা হাছন রাজার গান করে নাটকে, নাচেও।

অকস্মাৎ আমার ভেতর হাছন রাজা এসে ভর করেন। আমি বলি, আশা ওই গানটা ধরো তো।

কোনটা ?

কেয়া রং দেখায়া মুঝে পিয়া পিয়া।

বাহ্। খুশি হয়ে যায় আমার দুই পিয়ারী। প্রীতি আশাকে বলে, তুই গা, পেছন থেকে আমি বসে বসে নাচি। আশা গান ধরে- ‘কেয়া রং দেখায়া মুঝে পিয়া পিয়া/ দেখকার ফিরিপ্তা হুয়া/ দেখকার চান্দসা মুখ, কিয়া কারকে গিয়া/ চেহেরে কি বাহার নে দিল ছিনলিয়া/ হামেশা তাড়াপ্তা দিল কিয়া কিয়া কারকে গিয়া/ উস্কো লিয়ে মাতোয়ারা হাছন রাজা মিয়া’। 

নাটকে যেমন বাইজী নাচে, এখানেও তাই। আমার চোখ তাদের দিকে না, আমার সেল ফোনের ডিসপ্লেতে আটকানো।

গান শেষ হতেই প্রীতি বলে, আহ্ কী ভাগ্য আমাদের, ভাবি এসে জয়েন করেছেন আমাদের সঙ্গে।

দেখি আরেকটি নৌকায় আশার সদ্য বিয়ে করা স্বামী আসল হাছন রাজা রামিজ রাজু আর আমার স্ত্রী জলী ভিডিও করতে করতে আমাদের নৌকার দিকে ধেয়ে আসছে।

ছবি: লেখক

 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়