ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘আশ্বিনে রান্দি কার্তিকে খাই’

গাজী মুনছুর আজিজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫০, ১৭ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘আশ্বিনে রান্দি কার্তিকে খাই’

গাজী মুনছুর আজিজ: কোথাও বলে ‘গারু সংক্রান্তি’ বা ‘গারু হারকাইন’। কোথাও ‘গারু গোসল’ নামে পরিচিত। এ উপলক্ষে আশ্বিনের শেষ দিন রাতে নানা পদের সবজি, ভাত ও খাবার তৈরি করে রাখা হয়। খাওয়া হয় কার্তিকের প্রথম দিন সকালে। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী এই খাবারে গৃহস্থের বা তার পরিবারের কল্যাণ হয়। মুন্সীগঞ্জ অঞ্চলের সনাতনধর্মীদের কাছে এই সংক্রান্তি ‘গাড়ই’ বলে পরিচিত। মুসলমানদের কাছে এটি ‘গারু গোসল’ নামে বেশি পরিচিত। কার্তিকের গারু গোসল উপভোগ করতে গত আশ্বিনের শেষ দিন শেষ বিকেলে হাজির হই মুন্সীগঞ্জ সদরের উত্তর চরমশুরা গ্রামের আজিজুল হকের বাড়ি। বাড়ির নাম- সুখ নিবাস। সঙ্গে ছিলেন ইমরান উজ-জামান ও শিল্পী জাহিদ হোসেন। মূলত ইমরান উজ-জামানের বোন মণি আপার বাড়ি এটি।

সন্ধ্যার আগে হাঁটি বাড়ির পাশের ফসলি জমিনের আইল ধরে। আশ্বিনের বিদায়বেলা বলে শীতের আমেজ চলে এসেছে। আশপাশের কিছু জমিনে আছে শীতের সবজি টমেটো, শসা, করলা, বেগুন ইত্যাদি। কিছু জমিনে চাষ করা লক্ষ্মীধান কাটারও সময় হয়েছে। অন্য জাতের ধান যেমন লাইন ধরে জালা বা চারা বুনতে হয়, কিন্তু লক্ষীধান বোনা হয়েছে ধানের বীজ ছিটিয়ে। ধান আর সবজির পাশাপাশি কিছু ফাঁকা জমিনে শীতের অন্য ফসল বোনার প্রস্তুতিও চলছে। ঘরে ফিরি সন্ধ্যার পর।

গারু গোসলের জন্য মণি আপা সব আয়োজন করেছেন। যদিও অতীতে আশ্বিনের শেষ দিন এ আয়োজন নিয়ে এ অঞ্চলের প্রতিটি বাড়িতে উৎসবের আমেজ তৈরি হতো। কিন্তু সেই সোনালি অতীত এখন আর নেই। সেই অতীতকে নতুন করে খোঁজার জন্যই মণি আপার বাসায় নতুন করে এই আয়োজন। তিনি বসেছেন পাটা-পুতা নিয়ে। আর আমরা তার সামনে বসেছি অনেকটা গোল হয়ে। তিনি এক এক করে একটা ডালায় বেটে রাখছেন কাঁচা হলুদ, গিলা, মেথি, নিমপাতা, পেয়ারা ও বড়ইয়ের কুঁড়ি। তার পাশে আরেকটা ডালায় রাখা হয়েছে বেত্তুনের ডগা, কাঁচা তেঁতুল, দূর্বাঘাস, লক্ষ্মীধানের ছরা (শীষ), লোহা, করলা, মুড়ির মালা, চিড়ার মোয়া, মুড়ির মোয়া আর আলু শুকনো ভাজা। অন্যদিকে আখ ছোট ছোট টকুরো করে কেটে মালা বানানো হয়েছে। সেই মালাও রাখা হয়েছে ডালায়।

 



বাটা শেষ করে মণি আপা বলেন, ছোটবেলায় আমরাও গারু গোসল করতাম। গ্রামের অনেক বাড়িতেই হতো।গারু গোসল নিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি আশ্বিনের শেষ দিন রীতিমতো উৎসবের আমেজ বইতো। আমরা বলতাম ‘আশ্বিনে রান্দি, কার্তিকে খাই’। আমরা গাইতাম ‘আশ্বিনে রান্দে, কার্তিকে খায়, যেই বর মাগে, সেই বর পায়।’ কিন্তু সেসব বলতে গেলে এখন পুরোপুরি হারিয়ে গেছে।

সব কিছু বাটা শেষে গারুর অংশ হিসেবে রান্না করা হয়েছে ভাত, মুরগির মাংস, লাউশাক, খুদরাশাক ও ডাল দিয়ে নিরামিষ। এছাড়া একটি মাটির ঘটিতে সরিষার তেল ঢেলে তাতে আমের পাঁচ পাতার কুঁড়ি উল্টে রাখা হয়েছে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে দেখলাম গিলা-মেথি যেসব বাটা হয়েছে সেসব রাখা হয়েছে রান্না ঘরের চালে। দেখেশুনে আমরাও খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। উঠলাম সেই ভোরে। অবশ্য আমাদের আগেই বাড়ির ছোটরা উঠেছে। বাড়ির উঠানে বসে ছোটরা গায়ে মাখছে আগের রাতে বাটা গিলা, মেথি, হলুদ, নিমপাতাসহ অন্যসব বাটা। এরপর ছোটরা বাড়ির পাশের খালে গোসল করল। কার্তিকের আগমন হওয়াতে খালের পানিতেও শীতের ভাব এসেছে। তবুও এ শীতের ভেতরই ছোটরা গোসল সেরে এলো। গায়ে মাখল ঘটিতে রাখা সরিষার তেল। গলায় পরল আখের আর মুড়ির মালা। এরপর ডালায় রাখা লোহা আর করলায় কামড় দিয়ে একে একে খাওয়া শুরু করল শুকনো আলু ভাজার মোয়া, চিড়ার মোয়া ও গলায় থাকা আখের মালার আখ। এসব খাওয়া হলে বাড়ির উঠানে বসে খাওয়া হলো রাতে রান্না করে রাখা ভাত ও সবজি।

গারু গোসল নিয়ে মুন্সীরহাটের নমকান্দির কালাই মিস্ত্রি বলেন, এক সময় কার্তিক অভাবের মাস হিসেবে পরিচিত ছিল। সেজন্য অভাবের ছোঁয়া যাতে সন্তানের গায়ে বা গৃহস্থের ঘরে না লাগে সে কারণে কার্তিকের প্রথম দিন বাড়ির মায়েরা তাদের সন্তানদের ভালোমন্দ খাইয়ে বর চাইতেন যাতে কার্তিকটা ভালো যায়, সন্তান যেনো সারা বছর ভালোমন্দ খেতে পারে ও ভালো থাকে। এছাড়া গারুর একেকটা উপকরণের একেকটা অর্থ বুঝানো হয়েছে। যেমন লোহায় কামড় দেওয়া হয় যাতে সে এখন থেকে যেকোনো বিপদ-আপদ শক্ত হাতে মোকাবেলা করতে পারে বা সে যেনো ভেঙ্গে না পড়ে। করলায় কামড় দেওয়া হয় যাতে সে এখন থেকে তিতা বা তিক্ত যেকোনো বিষয়ও গ্রহণ করতে পারে। আখ খাওয়া হয় এটা ভেবে-এখন থেকে তার সব যেনো মিষ্টিময় হয়। এছাড়া বেত রাখা হয় যেনো ভঙ্গুর না হয় সে। হলুদ ত্বকের সৌন্দর্যে। এমনিভাবে প্রতিটি উপকরণেরই রয়েছে আলাদা প্রতিকী অর্থ।

 



গারু শেষে নাশতা সেরে বিদায় নেই সুখ নিবাস থেকে। অটো রিকশায় আসি মুন্সীরহাট বাজার। আজ হাটবার। হাটে উঠেছে বাঁশ-বেতের নানা পণ্য, সবজি, বিভিন্ন খাবার, লুঙ্গি, গামছাসহ হরেক রকম দেশীয় পণ্য। হাটে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করি। দেখি নানা পণ্য। সত্যিই গ্রামীণ এসব হাটে গ্রামীণ পণ্য দেখতে এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করে।

ছবি : লেখক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়