ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

প্রথম পর্ব || জাপান পরশ

শাকুর মজিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ২৩ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রথম পর্ব || জাপান পরশ

জাপান আমার অনেক বড় কৌতূহলের একটা দেশ। দেশটি সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না। ভাসা-ভাসা যে জ্ঞান তা কতোগুলো সিনেমা দেখে। আকিরা কুরোসাওয়ার অনেকগুলো সিনেমা আমার দেখা। দেখে মনে হয়েছিল, জাপান বুঝি সামুরাইদের দেশ, সেখানে গেলে সামুরাইদের দেখা মিলবে। আবার ‘দ্য লাস্ট সামুরাই’ দেখে এটাও মনে হয়েছিলো যে, জাপানে এখন আর সামুরাই পাওয়া যাবে না ।

তাহলে কী আছে?

জাপানে রোবট আছে। ইলেক্ট্রনিক্স কিছু পণ্যের কেনাকাটায় আমরা চোখ বন্ধ করে বেশি দাম দিয়ে হলেও জাপানি পণ্য কিনে ফেলি। আমাদের প্রথম রেডিও, টিভি সব জাপনি ছিল। জাপানের প্রতি আমাদের অগাধ আস্থা!

জাপান নিয়ে আমাকে কৌতূহলী করেছিলেন আরো দুইজন। একজন বক্সার-কাম-আর্কিটেক্ট তাদাও আন্দো, আরেকজন ম্যারাথন রানার-কাম-রাইটার হারুকি মুরাকামি। এঁদের বাইরে জাপান আমাকে চিনিয়েছিল একটা টেলিভিশন সিরিয়্যাল ‘ওশীন’। এক আদর্শ সংগ্রামী তরুণী ওশীনকে কেন্দ্র করে জাপানের মানুষের যেসকল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কাহিনী দেখেছিলাম প্রায় দুই যুগ আগে, এর বাইরে জাপান আমার ভালো জানা নেই। কিন্তু জাপান নিয়ে আমার আগ্রহ প্রচুর। এই জাতি যোদ্ধা ছিল। তাঁদের সামুরাই বাহিনী ছিল। আবার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মরণপণ লড়েছিল তারা। হিরোশিমা নাগাসাকিতে এটম বোমা ফেলেছিল আমেরিকা। কী বীভৎস সে কাহিনী!

এর বাইরে আর যা জানি তা হলো, এরা এমনই এক জাতি যারা কখনো কোনো বিদেশী দ্বারা শাসিত হয়নি। সুতরাং ঐতিহ্যের যা কিছু আছে সবই তাঁদের নিজের, কারো কাছ থেকে ধার করা নয়। আবার এখন যদি টোকিও শহরের ছবি দেখি, যেকোনো কসমোপলিটান শহরের মতো আভিজাত্য আর আড়ম্বর নিয়ে তার থাকা। এর রহস্যটা কী- এমন কিছু জানার জন্যেই মূলত মত দিলাম টোকিওতে অনুষ্ঠিতব্য এশীয় দেশগুলোর স্থপতিদের সম্মেলন (আর্ক-এশিয়া)-এ বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের ডেলিগেট হিসেবে ব্যায়বহুল এই ট্যুরে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে।

নারিতা বিমানবন্দরে আগমনী লাউঞ্জে


জাপান যেতে আমাদের ভিসা লাগে এবং এই ভিসা পাওয়া খুব সহজ নয়। এটা সহজ করার জন্য আমাদের সেমিনারের রেজিস্ট্রেশন ফি সাড়ে চারশো ডলার দিয়ে কাগজ আনিয়ে, হোটেল অগ্রীম বুকিং করে, জাপানি ভাষায় আসা কাগজপত্রসহ জমা দেয়ার এক সপ্তাহ পর ভিসা পাওয়া গেল। আমাদের প্রায় একশো জনের দলের দুই জনের ভিসা হলো না। কেন হলো না তার কারণ দেখানো নাই। তাদের বলে দেয়া হলো, ভিসা না দেয়ার কারণ জাপান কখনো জানায় না। এ থেকেই বুঝে নিলাম, এরা খানিক অহঙ্কারিও। আবার যাদের যথাযথ কাগজপত্র জমা হয়েছিল তাদের ভিসা হয়ে গেল, তারা সবাই চুপচাপ ভিসা পেল, তাদের কোনো প্রশ্নও জিজ্ঞাসা করে নাই। এর আগে যারা জাপান গিয়েছে বা জাপানের বা জাপানিদের সঙ্গে যাদের ওঠা-বসা বা যোগাযোগ তাঁদের মুখেও শুনেছি, এরা খুবই নিয়ম মানা জাতি। নিয়মের মধ্যে পড়ে গেলে হয়ে যাবে, না পড়লে হবে না। না, মানে- না। অনুরোধ, বিবেচনা, এসব তাঁদের ডিকশনারিতে নাই।

জাপান যাওয়াটা বেশ জঞ্জালের। ঢাকা থেকে ব্যাংকক/ কুয়ালালামপুর বা সিংগাপুর, সেখান থেকে টোকিও। সেমিনার শরু হবে ১০ সেপ্টেম্বর  ২০১৮ থেকে। আমরা তার দুদিন আগে নানাভাবে রওয়ানা দিয়েছি। ৭/৮জন, যাদের ব্যাংকক-মালয়েশিয়া কোনো কাজ আছে, তারা ছাড়া বাকী সবাই সিঙ্গাপুর এয়ার লাইন্সের দুই-তিন ফ্লাইটে। মাঝ রাতে যে ফ্লাইটে আমি যাবো, সে ফ্লাইটে আরো ৩৪ জন বাংলাদেশি স্থপতি। ইনস্টিটিউটের বড় নেতারা আমাদের দলে, সুতরাং সবচেয়ে বড় আর গুরুত্বপূর্ণ বহরেই আমার জায়গা হয়ে গেলো।

গত ১৮ বছর ধরে নানা দেশ ঘুরে ঘুরে আমি এখন অনেক ক্লান্ত। আমার শরীরে মধ্য তিরিশের সে জেল্লা আর এখন নাই যে, দুই ক্যামেরা ট্রাইপড আর হ্যাভারসেক পিঠে ঝুলিয়ে দিনমান তাফালিং করে করে ছবি তুলে বেড়াতে পারব। এই তেজ হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে দল ছাড়া আর বিদেশের পথে বের হই না। কিন্তু দল যতো বড়ই হোক না কেন, বেড়াতে গিয়ে মনে হয় ট্র্যাভেলার হিসাবে আমরা সবাই বড় একা। অনেকের সাথে বেড়ালেও প্রত্যেকেই আসলে একা একা বেড়াই, একা একা দেখি।

এর মধ্যে আমার শরীর আছে বিগড়ে। গত বছর এক সড়ক দুর্ঘটনায় মরতে মরতে কোনো মতে বেঁচে যদিও গিয়েছি, আমার ভাঙ্গা বাম হাত এখনো পুরোপুরি জোড়া লাগেনি। কোনো ভারী জিনিস, এমনকি দুই কেজি ওজনের আমার ডিএসএলআর ক্যামেরাটাও বইতে পারি না। মেরুদণ্ডের পুরনো সমস্যা- সব মিলিয়ে আমি যে মনের মতো ঘুরে বেড়াবো, সেই অবস্থা নেই। মনে জোর আছে এই নিয়ে যে, আমার পুরনো ট্র্যাভেল টিম পঞ্চ-পর্যটকের তিনজন স্থপতিই এখানে, এই দলে আছেন। বড় ভাইদের মধ্যে যারা আছেন, খোদ দলনেতা নাসির ভাই বা দীলু ভাই, তারাও প্রাণ দিয়ে আমাকে দেখে রাখছেন। কনভেয়ার বেল্ট থেকে আমার ব্যাগ উঠিয়ে রাখছেন হয়তো দিলু ভাই, নাসির ভাই কেড়ে নিয়েছেন আমার হাত ব্যাগ তাঁর নিজের হাতে। এর বাইরে রেগুলার অত্যাচার সহ্য করার মতো আরিফ ভাই আর লাভলু ভাই আছেন আমার পাহারায়। এটা ছাড়াও জুনিয়ার ভাইদের তো তুলনাই নাই। এই সব বিবেচনায়, আমার সফরের শুরুটা খুবই ভালো শুরু হয়ে যায়।

আমরা সাড়ে চার ঘণ্টা উড়ে সিঙ্গাপুর নেমে সাড়ে তিন ঘণ্টা আরাম করি প্রায়োরিটি লাউঞ্জে। সেখান থেকে আবার তৈরি হই আরো সাত ঘণ্টা ফ্লাইটের জন্য। এবং এক সময় প্রায় ১৬ ঘণ্টা জার্নির পর বিকাল পাঁচটায় আমাদের বয়ে নেয়া সিঙ্গাপুরি বিমান এসে নামে জাপানের রাজধানী টোকিও থেকে ৮৬ মাইল দূরের নারিতা বিমান বন্দরে।

জাপান স্পর্শ করেই মনে পড়লো বহু আগে পড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জাপান যাত্রী’র কাহিনী। একশো বছর আগে কলকাতার খিদিরপুর থেকে এই টোকিও বন্দরে রবীন্দ্রনাথকে ঘাটে ঘাটে সময় ব্যয় করতে করতে দুই দুইটা সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল ২৪ দিন। কলকাতা থেকে মুম্বাই, সেখান থেকে বার্মার রেক্সগুন, মালয়েশিয়ার পেনাং, সিঙ্গাপুর, চীনের সাংহাই, হংকং হয়ে তাঁর আসা হয়েছিলো এই জাপানের টোকিওতে। অথচ কলকাতা থেকে আমাদের দিলীপদার দল এলো আমাদেরই মতো প্রায় ১৬ ঘণ্টার জার্নিতে।

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের টোকিও। রবীন্দ্রনাথ যে সময়ে টোকিও সফর করেছিলেন


রবিবাবুদের আমলে এসব ভ্রমণের যাত্রাপথে যতো ঘটনা ঘটতো তার কিছুই এখন আমাদের হয় না। জাহাজে বসে রবীন্দ্রনাথ নয় অধ্যায় ভ্রমণকাহিনী লিখেছিলেন কলকাতার খিদিরপুর থেকে জাপানের ‘কোবে’ বন্দরে পৌঁছাতেই। আমাদের সৈয়দ মুজতবা আলীও কতো রসের কাহিনী আমাদের শুনিয়েছিলেন জাহাজের ডেকে পাওয়া মানুষদের নিয়ে। আর আমরা এখন প্লেনে পাই কমার্শিয়াল হাসি ছড়ানো আসমানী বুয়া। আর পথঘাট যেহেতু সবই ডিজিটাল সাইনেজে চেনানো, বাড়তি কথা বলেও যে ভিন জাতির একজনের সাথে ভাব বিনিময় করবো, আমাদের সেই সুযোগও কম। আবার নিজেরাই আছি বড় দলে। নিজের দেশের যে মানুষগুলোর সাথে বছরের পর বছর দেখা সাক্ষাত হয় না, তাদের সাথে আড্ডাতেই আমাদের অর্ধেক সময় চলে যায়, সেখানে বিদেশের গন্ধ একান্তে ভোগ করবো সে ফুরসত কোথায় আমাদের!

টোকিওর নারিতা বিমান বন্দরের ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ রানওয়ে মাড়াতে মাড়াতে যেটুকু দেখেছিলাম, ইমিগ্রেশনে-কাস্টমের দরজা পেরুতে পেরুতেও প্রায় একই জিনিস চোখে পড়লো। এমন বাণিজ্য লক্ষ্মীর বসত যার ঘরে, সে এতো আড়ম্বরহীন হয় কী করে!

ডানে-বামে-উপর-নিচে যেদিকেই তাকাই- নেই কোনো বাড়তি অলঙ্করণ। না-আছে কোনো চটকদার বিজ্ঞাপনের আবাহন। বিমান থেকে নেমে ইমিগ্রেশনে যেতে যেতে শেষ মাথায়, কতোগুলো ফালির উপর একপাশে একটা কোম্পানির নাম ছোট করে, আর মাঝখানে ইংরেজি ও জাপানি ভাষায় লেখা:

- Future meets the past

- Art meets function

- Science meets fiction

- Perfection meets imperfection

- Revolution meets revolution

- Technology meets empathy

- The bold meets the minimal

- Nature meets innovation

ডানে-বামে তাকিয়ে দেখি, যাত্রীদের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ছাড়া আর কিছুই কোনো দেয়ালে লেখা নেই। উপরে যেটুকু লেখা আছে, কেনো যেন মনে হলো, জাপান মানেই তাই। এমনটিই এইদেশ সম্পর্কে শুনে এসেছি। এখন দেখার পালা।

ইমিগ্রেশন, নিরাপত্তা তল্লাশি, কাস্টম, এসব জায়গায় যে ক’জন জাপানির সাথে কথা বলেছি, মনে হলো সবগুলো কথাই তাদের প্রোগ্রাম করা। এর বেশি একটা বর্ণও তারা উচ্চারণ করবে না। আর ইমিগ্রেশন কর্তা বা পুলিশকে দেখে মনে হলো, তাঁদের শরীর আর চোখের ভাষা থেকে আমাদের শিষ্টতার অনেক কিছু শেখার আছে। কথা বলে নিচু স্বরে, সরাসরি চোখের দিকে না তাকিয়ে একটু নিচু করে, হাসি মুখে প্রশ্ন করে, মনোপুত হওয়া উত্তরটি পেয়ে খুব খুশি হয়ে যখন বলে ‘সরি টু কিপ ইউ ওয়েটিং, ওয়েলকাম টু জাপান’ তখন জাপানের প্রতি ভালো লাগাটা বেড়ে যায়।

নারিতা বিমানবন্দরে জাপানী আপ্যায়কের জন্য অপেক্ষা


খানিক পরেই মনে হলো, ঢাকার ইমিগ্রেশন কাউন্টারের সামনে দাঁড়াতে আমরা যে শৃংঙ্খলাটুকু দেখাই, যে অভিব্যক্তি করি, সেটাও বদলে গেছে। আমরা সোজা লাইনে দাঁড়িয়েছি কোনো বিরক্তি ছাড়াই। কেউ কারো লাইন ডিঙ্গানোর জন্য তাড়াও বোধ করছি না। কথায় কথায় ‘থ্যাঙ্কইউ’ ‘এক্সকিউজ মি’ও বলছি। সামান্য এই পরশ আমাদের বদলে দিলো এই নারিতা বিমান বন্দরের কয়েকজন জাপানি। কিন্তু এই আনন্দ আহ্লাদ আমাদের বেশিক্ষণ থাকলো না। ইমিগ্রেশিন, কাস্টম পার হওয়ার পর আমাদের হোটেলে যাবার কথা। দেশে যখন এ রকম আন্তর্জাতিক সম্মেলন আমরা আয়োজন করি, বিদেশী ডেলিগেটদের এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে নেয়ার যে ব্যবস্থা রাখি, কিংবা নিকট অতীতে ভারতের জয়পুর, নেপালের কাঠমান্ডু বা মালোয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে নেয়ার যে ব্যবস্থা থাকে, তা পাবো বলেই তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে আসি।

বাহির গেটে এসেও যখন কাউকে পাওয়া গেল না, মনে হলো- তারা কাছাকাছি কোথাও আছে, পাওয়া যাবে, এ সময়ে লাভলু ভাইয়ের ইচ্ছা হলো- তিনি কিছু ডলার এখান থেকে ভাঙ্গিয়ে নেবেন।

আমার বেরিয়ে যেতেই মন চাইলো। তখনো টোকিও আকাশে বেশ আলো। বিকাল ৫টায় বিমান নেমেছে। এখন ছ’টাও বাজেনি। একটু বাইরের আকাশ দেখার জন্য, যেই না বেরুতে গেলাম, আমাকে ঠেকালেন আরিফ ভাই। তাঁর কথা- কনফারেন্সের সব ডেলিগেট একসঙ্গে হবে এখানে, জেআইএ (জাপান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস) এর লোকজন থাকবে, তারা নিয়ে যাবে।

আমি বলি, এখানে বিক ক্যামেরার দোকান আছে, আমি ডাটা সিম নেব।

তিনি একশো আশি ডিগ্রিতে মাথা ঘুরিয়ে বলেন, এখানে কোনো ক্যামেরার দোকান নাই।

আমি বলি, বিক ক্যামেরা আসলে খুচরা ইলেক্ট্রনিক মার্কেট। এর খবর দিয়েছে আমাকে প্রসেঞ্জিত। জাপান তার শ্বশুরবাড়ি। তার প্রেসক্রিপশন হলো- বিক ক্যামেরার দোকান থেকে সস্তায় দুই-তিন হাজার টাকায় ডাটা সিম নেয়া। অন্য জায়গায় গলাকাটা দাম।

ওয়েট। ওরা সিমও দিতে পারে।

আমি ঠান্ডা হয়ে ওয়েট করতে থাকি। এর আগে শ্রীলঙ্কার সেমিনারে কলম্বোর বিমান বন্দরেই শ্রীলঙ্কান ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট সবার হাতে সিম কার্ডের প্যাকেট দিয়ে দিয়েছিলেন। অন্য জায়গায় সহজে কেনার জন্য এজেন্ট ঠিক করে দিয়েছেন আয়োজকেরা। এখানেও হবে নিশ্চয়।

স্কাই ট্রি থেকে টোকিও দেখা

 

এসব ট্যুরে আমি এ- ইউজারের মতো আচরণ করি। কেনাকাটায় যিনি ভালো থাকেন, তাকে বলি, যা কিনবেন আরেক কপি এক্সট্রা রাইখেন আমার জন্য।

আরিফ ভাই মুখ শুকনা করে খুঁজতে থাকেন আকা (Asian Council of Architects ACA-১৮) অফিশিয়ালদের। বাকিরা ব্যস্ত হয়ে আছে সীম কেনার জন্য।

আমি নিশ্চিন্তে আপন মনে বসে থাকি। বসে থাকার জন্য কেউ আমার জন্য সোফা পেতে রাখেনি সেখানে। আমারই ঠেলে  নেয়া ট্রলির এক কোণায় বসে পড়ি। জাপান নিয়ে তেমন পড়াশুনা করে আসিনি। কিছু বুঝতেও পারছি না। আমার সামনে অনেকক্ষণ ধরে এক কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছেন লাভলু ভাই। তিনি অনেকক্ষণ ধরে টাকা বদল করছেন। কিন্তু টাকা বদল করতে এতো সমস্যা কেন? আমি কাছে গিয়ে দেখার চেষ্টা করতেই আমাকে থামানো হলো। পেছনে একটা হলুদ দাগ দেখিয়ে বলা হলো, এই দাগের বাইরে যেন আমি দাঁড়াই, তিনি গেলে আমি আসতে পারবো।

আমি বোঝাতে চাইলাম, আমরা এক দলের।

কাজ হলো না।

আমি দাঁড়িয়ে থাকি আরো ১০ মিনিট। এক সময় লাভলু ভাই এলেন। এবং দীর্ঘ সময় নিয়ে টাকা ভাঙ্গানোর কাহিনী শোনালেন। তিনি বলেন, লম্বা এক্সচেঞ্জের সামনে জানালা ঘেঁষে চারটা কাউন্টারে চারজন বসার ব্যবস্থা। সামনের জন চিরাচরিত অমায়িক জাপানি হাসি দিয়ে ডলারগুলি নিলেন। তারপর দুবার করে ধীরে ধীরে বেশ সময় নিয়ে গুনলেন। এরপর একটা স্লিপে পেন্সিলে এক, পাঁচ, দশ, বিশ, পঞ্চাশ ইত্যাদি কোনটা কত সংখ্যায় আছে, লিখলেন। এরপর যা করলেন, সেটা আমার এই কুড়ি বছরের বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতায় একেবারেই অনুপস্থিত। পিছনের তাক থেকে একটা মোটা ক্যাটালগের মত নিলেন। তাতে বিভিন্ন দেশের নোট আঠা দিয়ে সাঁটানো। তার ভিতর থেকে ডলারের চ্যাপ্টার বের করে প্রতিটা নোট একটা একটা করে তার সঙ্গে মিলিয়ে ইয়েন গুনে দিলেন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ব্যাংকে যে রেইট দেবে, যেটা পত্রিকায় ছাপা হবে জাপানের প্রত্যেক জায়গায়- সেটা এয়ারপোর্ট হোক বা হোটেল হোক বা পাড়ার দোকান, সবখানেই সমান। বাহ! এই না হলে জাপান!

আমি কাউন্টারের দিকে আরেকবার তাকালাম। দেখি ষাট থেকে সত্তর বছর বয়েসী ৪ জন বৃদ্ধ বসে আছেন। ডানে বামে তাকিয়ে দেখি এই বিমানবন্দরের যতগুলো দোকানপাট তার সব বিক্রেতা, সব স্টাফ ষাট-সত্তর ঊর্ধ্ব। বিষয় কী! তরুণদের চাকরি কি এখানে নাই? নাকি সবাই ডিজিটাল মার্কেটে জব করে, আর এজন্যই এসব বুড়োদের দিয়ে ম্যানুয়েল কাজ কারবার করাচ্ছে এখানে! (চলবে)





রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ জুন ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়