ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

কবরের অর্ধগলিত লাশটিকে অনেক আপন মনে হয়েছিল

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৪১, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কবরের অর্ধগলিত লাশটিকে অনেক আপন মনে হয়েছিল

শাহেদ হোসেন :  দুলু গুণ্ডা। সত্তর দশকে আরেক গুণ্ডা  নাদেরকে নিয়ে পুরান ঢাকার মালিটোলা, মোগলটুলী, বংশাল, নবাবপুর এলাকা দাবড়ে বেড়াতেন তিনি।

 

সেই দুলু গুণ্ডাই পরে বনে যায় চিত্রনায়ক ফারুক। ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের সময় বন্ধু নাদেরের সঙ্গে এই দুলু গুণ্ডাও গুলি ছুঁড়েছিলেন পাকিস্তানি হানাদারদের ওপর। শুধু তাই নয়, ওই রাতেই ব্যারিকেড দিয়েছিলেন ঢাকার নবাবপুর রোডে।

 

স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প এখনও অজানা আমাদের। পাকবাহিনীর ওপর প্রথম হামলাকারীদের অন্যতম এই দুলু গুণ্ডা ওরফে ফারুকের যুদ্ধস্মৃতি দুঃখজনক হলেও সত্য আজো সামনে আসেনি। অনেকটা অভিমান করেই দূরে সরেছিলেন তিনি। পাকবাহিনীর ওপর প্রথম হামলাকারী গুণ্ডা নাদেরের গল্প খুঁজতে গিয়েই বেরিয়ে আসে ফারুকের নাম। তার উত্তরার বাসায় নাদেরের গল্প শুনতে গিয়ে অনুরোধ জানিয়েছিলাম নিজের যুদ্ধস্মৃতি কথা শোনাতে। বাংলা সিনেমার মিয়া ভাই খ্যাত এই অভিনেতার সেসব স্মৃতিকথাই তুলে ধরছি রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য।

 

২৫ মার্চ শ্যামলীর বাসাতেই ছিলাম আমি। সকালে একটা ওপেল গাড়ি নিয়ে বাসায় আসায় বন্ধু নাদের। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল বাগান, ঝোঁপঝাড়। সেই বাগানে নিয়ে গাড়ির বনেট খুলে ও যা দেখাল তাতে আমার চক্ষুচড়ক  গাছ। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, এতো অস্ত্র কই পাইলা? আমাকে এর জবাব না দিয়া ও কেবল হাসলো। আমাকে বললো, ‘আজকে রাতেই কিছু একটা ঘটবে। প্রস্তুত থাইকো।

 

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি খবর পাইলা কোত্থেকে?

আমার এই প্রশ্নেরও জবাব দেয়নি ও। শুধু বলল  জায়গামতো থাইকো।

 

রাতে নাদেরকে আমি পুরান ঢাকায় যাওয়ার কথা বললাম। এরপর ও চলে যায়।

 

রাত তখন প্রায় ১০টা। আমরা আড্ডা মারছিলাম নবাবপুর রোডের হোটেল প্যারামাউন্টে। এ সময় এক পুলিশ সার্জেন্ট এসে চিৎকার করে সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছিলেন- ‘আপনারা সবাই যার যার বাসায় চলে যান। পাক আর্মি রাস্তায় নেমে গেছে।’

 

হোটেলে বসা মুরুব্বিসহ অনেকেই বাসায় চলে গেলেন। আমি কয়েকজন বন্ধুসহ হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম নবাবপুর ব্রিজের ওপর।

 

নবাবপুর রোডের অপর পাশে ধোলাইখালের নতুন রাস্তায় তখন অনেকগুলো ট্রাকের বডি পড়েছিল। ট্রাকও ছিল কয়েকটা। ব্রিজের ওপর যেয়ে পুরান ঢাকার আরো কয়েকজন বাসিন্দাকে দেখতে পেলাম। আমার তখন নাদেরের কথাগুলো মনে পড়লে-‘আজকে রাতেই কিছু একটা হবে।’ মনের আবেগে তখন ছোটখাট একটা ভাষণ দিয়ে দিলাম।

 

জমায়েত হওয়া স্থানীয় লোকজনদের বললাম, ‘নেতা বলছে, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। আমি আপনাদের সহযোগিতা চাই।’ মুরুব্বিরা তখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করতে হবে কও।’

 

তাদেরকে বললাম, ‘এই ট্রাকের বডিগুলা নিয়া আসতে হবে। এগুলা দিয়ে আমি ব্যারিকেড দিমু।’প্রায় ১০০ লোক আমার সাহায্যে তখন এগিয়ে আসে।

 

রাত প্রায় সাড়ে ১১টা। এক মুরুব্বি বলে উঠলেন, ‘ওই মিয়া রাখ। হইলদা গাড়ি আইতাছে।’ (কুয়াশার কারণে আর্মির গাড়ির হেডলাইট হলুদ দেখাতো। এ কারণে পুরান  ঢাকায় এগুলোকে হইলদা গাড়ি বলে ডাকতো।)

 

আমাদের থেকে প্রায় দুইহাত দূরে এসে আর্মির কয়েকটি জিপ এসে থামে। গাড়িটি থামার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হাতে থাকা ট্রাকের একটি বডি নিচে নামিয়ে রাখলাম। খোলা জিপ গাড়িতে মেশিন গান ছিল। চাইলে আর্মি আমাদের ওপর ব্রাশ ফায়ার করতে পারতো। কিন্তু তারা কিছু না বলে শুধু আমাদের দেখেই চলে যায়। পরে সেখান থেকে আমি চলে যাই পরিচালক এইচ আকবরের বাসায়। তার বাড়িতে বসে যখন খাওয়া শুরু করলাম তখনই পাক আর্মির গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। মনে হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যতগুলি করা হয়েছে তার চেয়ে বেশি গুলি বের হচ্ছে পাক আর্মির মেশিন গান আর রাইফেল থেকে।

 

ওইদিন আমার প্রথম সিনেমা ‘জলছবি’ মুক্তি পেয়েছিল। রাত ১২ টার শো শেষে যারা সিনেমা হলগুলো থেকে বের হয়েছিল, পরে খবর পেয়েছি তারা কেউ বাঁচে নাই। এই গোলাগুলির মধ্য দিয়েই আমি নবাবপুর রোড দিয়ে মালিটোলা চলে গেলাম। সেখানে যেয়ে দেখি আমার বন্ধুবান্ধব সবাই অস্ত্র নিয়ে রেডি। নাদের আমাকে বলল, ‘দোস্ত এমনেও মরুম ওমনেও মরুম। এরচেয়ে নেতা যেইটা কইয়া গেছি ওই্টাই করি চল।’

 

আমরা তখন ইসা ব্রাদার্সের ছাদে পজিশন নেই। সেখান থেকে নাদেরই প্রথম পাক আর্মিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। এরপর আমরা পজিশন নেই ইংলিশ রোডের কোনায় থাকা কাঠের দোকানগুলির একপাশে। সেখান থেকেও গুলি ছুঁড়েছিলাম পাকবাহিনীর ওপর। আমাদের হামলায় বেশ কয়েকজন পাক আর্মি মারা যায়। এরপর আর সেখানে থাকিনি। আমরা সবাই সকালের আগেই যার যার জায়গায় চলে যাই। আমি থেকে যাই রায় সাহেবের বাজারে এইচ আকবর সাহেবের বাসায়। তবে সেখানে গিয়ে একফোটাও ঘুমাতে পারিনি। রাতে আমরা কী করিছি তা ঘুণাক্ষরেও কাউকে জানতে দেইনি।

 

২৬ মার্চ সকাল ৭টার দিকে এইচ আকবর সাহেবের বাসা থেকে বের হযে মালিটোলার দিকে গেলাম। নিশাত ফাঁড়িতে যেয়ে পাকবাহিনীর গুলিতে নিহত পুলিশদের লাশ দেখতে পেলাম। স্থানীয় মুরুব্বিরা আমাদের বললেন, ‘লাশগুলার একটা ব্যবস্থা কর।’ ফাঁড়ি থেকে একটু দূরেই দেখতে পেলাম একটি ট্রাক পড়ে আছে। রাতে আর্মির হামলায় আতঙ্কিত হয়ে চালক হয়তো ট্রাকটি ফেলে গিয়েছিল। ওই ওই গাড়িতে করে লাশগুলি নিয়ে আমরা গেলাম আজিমপুর কবরস্থানে।

 

ঢাকায় যে ইতিমধ্যে কার্ফু জারি হয়ে গেছে আমরা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি। সকাল ১০টার দিকে আজিমপুর কবরস্থানে লাশগুলি দেওয়ার পর এক বন্ধু বলল, ‘ব্যাপক খিদা লাগছেরে।’

 

কবরস্থানে বসেই আমরা ওকে খাবার আনতে পাঠিয়ে দিলাম। অনেক দূর ঘুরে একটা দোকানের সন্ধান পেল বন্ধুটি। তবে দোকানটি ছিল আধা খোলা। ওকে দেখেই দোকানদার বলল, এখানে কী করেন? জানেন না আর্মি কার্ফু দিছে? এই কথা শোনার পর খাবার ফেলেই ও আমাদের কাছে চলে আসে। প্রধান সড়ক ছেড়ে বহু চিপাচাপা গলি দিয়ে ঘুরে চলে এলাম নবাবপুরে এইচ আকবর সাহেবের বাসায়। বাসায় ফিরে হঠাৎ করেই আমার  মনে হলো বোন-ভাগ্নেদের কথা। আমাদের শ্যামলীর বাসার সামনে একটা হাউজ ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, পাক আর্মি বোধ হয় ওদেরকে মেরে সেই হাউজে ফেলে দিয়েছে।  এরপরই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম আমি।

 

২৬ মার্চ দুপুরের দিকে ছিলাম রায় সাহেব বাজারে ইউসুফ সর্দারের বাসায়। ওই বাসার বারান্দাটা ছিল বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। বেড়ার ফাঁক দিয়ে রাস্তার ওপর নজর রাখছিলাম আমরা। হঠাৎ করেই দেখলাম রাস্তা খালি হয়ে গেল। আর্মির ৩/৪টা জিপ ওই বাড়ির সামনের গলিটাতে এসে দাঁড়িয়েছে।

 

গাড়ি দেখামাত্র ইউসুফ সর্দার আমাকে বলল- দুলু চলেন পলায়া যাই। আমি বললাম- ক্যান?

ইউসুফ সর্দার বললেন, ওরা মনে হয় এইদিকে আইব।

আমি বললাম- খাড়ান, দেখি না কী হয়।

বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, একটি জিপ থেকে সাদা রুমাল দিয়ে মুখ বাধা এক লোক দুইজন আর্মিরে নিয়া ইউসুফের বাড়ির দিকে আঙ্গুল দিয়ে কি যেন দেখাইল। কিছুক্ষণ পর কয়েকজন আর্মি গাড়ি থেকে দড়ির রোল বের করলো।

 

ততক্ষণে আমরা ওপর তলা থেকে নিচে নেমে গেছি। নিচতলার দরজার ছিদ্র দিয়ে দেখলাম, দড়ির একটা মাথা দরজার সামনে পেট্রলের একটি কৌটার মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে ওরা। আরেকটি মাথা ওদের গাড়ির কাছে নিয়ে রাখার পর এতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন ৫/৬ হাত যাওয়ার পর ওরা গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যায়।  

 

আতঙ্কে নীল হয়ে যাওয়া ইউসুফ কাপা কাপা গলায় আমাকে বলল-‘আমাদের রায়সাহেব বাজার কিছুক্ষণের মধ্যে উইরা যাইব। দুলু আপনে এইটা ঘটাইছেন।’ 

 

ওই সময় বাড়ির ভেতরের মেয়েরা চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। এসব দেখে আমার মনটা অনুশোচনায় ভরে গেল, আমার জন্য বাড়ির লোকগুলা মারা যাবে!  

ইউসুফ হঠাৎ করে বলে উঠল- দুলু চলেন রশির মাথাটা ডিব্বার থাইক্কা বাইর কইরা ফালাই।

 

ওর এ কথা শোনার পর আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। ইতিমধ্যে ইউসুফ লুঙ্গিতে কাছা মেরে ফেলেছে। আমি ওকে বললাম চলেন। দুজনে মিলে দৌড় শুরু করলাম। মাত্র ১০ থেকে ১৫ হাত দূরত্ব। এতটুকু রাস্তা পাড়ি দিতে গিয়ে মনে হলো আমি যেন ১০ হাজার মাইল পথ পাড়ি দিচ্ছি! দ্রুত পেট্রোলের কৌটা থেকে দড়িটি বের করে ফেললাম দুজনে। এরপর ওইটা নিয়ে এসে মাটির চুলায় পুড়িয়ে ড্রেনে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম।

 

২৮ মার্চ আমি চলে গেলাম জিঞ্জিরা। সেখানে ইউসুফের ভাগ্নে মাহবুবের এক আত্মীয়ের বাসায় উঠলাম। তবে নদী পার হওয়াটা সহজ ছিল না। ওইসময় সদরঘাটে পাক আর্মির একটি ঘাটি ছিল। বাঙ্গালিদের নদী পার হতে দেখলেই ওরা গুলি করতো।

 

ঘুরপথে কৌশলে জিঞ্জিরা গিয়ে দেখলাম রাস্তায় মানুষের দীর্ঘ লাইন। সবাই হাটছে। গন্তব্য কারো সীমান্তে, কারো বা নিজেদের গ্রামে। চার ছেলেকে দেখলাম পালাক্রমে কাঁধে করে  ১০৭ বছরের বয়সের বাবাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ধানক্ষেতে মেয়েরা কাপড় দিয়ে ঘিরে রেখেছে। সেখানে কোনো প্রসূতি সন্তান প্রসব করছে। ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা মানুষগুলোকে যাওয়ার পথে স্থানীয়রা গুড়, মুড়ি, পানি খাওয়ার জন্য সাধছে। তাদেরকে বলছে, ‘কবে কোথায় যাবেন ভাইসাব, কিছু খায়া নেন।’ বাঙালির এই প্রেম আমি আর কখনো দেখিনি।

 

মাহবুবের আত্মীয়ের ওই বাড়িটি ছিল বিশাল বড়। ১ এপ্রিল বিকেলে এক বড়ভাই এসে বললেন, চল ফারুক ওই পাড়ে যাইগা। ভোর রাতের দিকে এদিকে আক্রমণ হইতে পারে।  তবে আমি তার কথা তেমন সাড়া দিলাম না। শেষ পর্যন্ত উনি একাই চলে গেলন।

 

ফজরের আজান তখনো হয়নি। এমন সময় ধাম ধাম করে তিনটা গোলার শব্দ পেলাম। তখন মনে হলো মস্ত ভুল করে ফেলেছি। বড় ভাইয়ের কথাই সত্যি হলো।

 

আমি দ্রুত বাড়ির অন্দরমহলে চলে এলাম। লুঙ্গি পরে এমনভাবে থাকলাম মনে হয় যেন আমি এই বাড়িরই মানুষ। জিঞ্জিরায় অনেকের বাড়িতেই বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিল। যেখানে ছবি পেয়েছে সেখানেই নির্বিচারে সবাইকে হত্যা করেছে পাকবাহিনী। আমি যে বাড়িটিতে ছিলাম সেখানে ঢাকার অনেক অভিজাত পরিবারের সদস্যরাও আশ্রয় নিয়েছিল। আমি দেখেছি, তারা বাথরুমের বদনা দিয়ে পানি খাচ্ছে আর দোয়া পড়ছে।

 

আমি ঘরের ভেতরে ঢুকে একটি পালংকের ওপরে বসলাম। হঠাৎ মনে হলো পালংকের পিছনে আমারই পরিচিত নাসির ও বদুসহ ৪/৫ জন বসে আছে। ওদের সামনে রাখা ছিল বিশাল বড় বড় হাড়ি। ভেবেছিল পাক আর্মি হয়তো হাড়ির আড়ালে ওদেরকে দেখতে পাবে না।

 

আমি ওদেরকে বললাম, আমারে একটু জায়গা দেও।

ওরা আমার এই কথা শুনে কেঁদে ফেলল। বলল, ‘ভাই আপনে মইরা আমাগো বাঁচান। এদিকে আইসেন না।’

এর মাঝখানে দরজায় পাক আর্মির দুটি টোকা পড়ে গেছে। রেডিওতে শুনেছিলাম, আর্মি যেখানে বাধা পাবে সেখানে গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেবে। আতঙ্কের মাত্রা তাই আরো বেড়ে গেল। তৃতীয় টোকা দেওয়ার সময় দরজা খুলে দেয়া হলো। চারজন সেনা ঢুকলো বাড়ির ভেতরে।  বাড়িতে চোখ বুলিয়ে ওরা চলে গেল। আমার মনটা খুশিতে নেচে উঠলো। মনে হলো অলৌকিক উপায়ে আমি বেঁচে গেলাম। কিন্তু বিধিবাম।

 

একটু পরেই দেখলাম আবার চারজন ঢুকলো। ওরা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তুই নিচে নাম।

আমাকে ওরা বাইরে নিয়ে গেল। মনে মনে তখন নিজেকে অনেক সাহসী মনে হলো। মনে হলো আমার কারণে বেঁচে গেল ৪/৫জন লোক।

 

আমার সামনে যে সেনাটি দাঁড়িয়েছিল সে ছিল আমার চেয়ে বেশ লম্বা। হঠাৎ মনে হলো, আমিতো গুলি করতে জানি। আমি এমনি এমনি মরবো কেন? ওর কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিব, লড়াই করে মরব। কী মনে হতেই হঠাৎ ডানদিকে তাকিয়ে দেখি, অন্তত ১০ জন সেনা আমার দিকে অস্ত্র তাক করে আছে। আমাকে ওরা ধাক্কা দিয়ে বাইরে নিয়ে গেল। সেখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল ১০/১২ জন লোককে। এর পাশেই ছিল মহিলাদের লাইন। হঠাৎ এক মহিলা আমাকে ইশারা করলো তাদের লাইনের ভেতরে ঢুকে পড়ার জন্য। সেখানে কৌশলে আমি ঢুকে পড়ি। একটু এগুতেই আমি দৌড় শুরু করলাম। হঠাৎ পা পিছলে ঢালু জায়গায় পড়ে গেলাম। এর মধ্যেই পেছন থেকে ভেসে আসছিল গুলি। আমি পড়ে গিয়ে ক্রল করা শুরু করলাম। পাশেই দেখলাম গুলিবিদ্ধ এক মহিলা তপড়াচ্ছে।

 

এরপর চলে গেলাম মসজিদের কাছেই এক ডোবায়। পানিতে নেমে বাঁচার চেষ্টা করলাম। কিন্তু হাটু পানি দেখে উঠে এলাম। শেষমেষ চলে এলাম মসজিদে। সেখানে কোনো মুসলমানকে পাইনি। মসজিদের ভেতরে ছিল তাঁতিবাজার  আর শাখারিবাজারের মহিলারা।

 

এক কোনায় বসতেই হঠাৎ একটা লোক লুঙ্গি বের করে বললো, ‘দুলু ভাই লুঙ্গিটা বদলান।’

 

তাকিয়ে দেখি শাখারি বাজারের এক পরিচিত ভদ্রলোক। আমি বললাম, ‘দূর থো লুঙ্গি। টেনশনে বাঁচি না!’

একপর্যায়ে নারীদের বললাম, সিঁদুর এখন মোছেন। আপনারা কী পরিস্থিতি বুঝতাছেন না?

তারা বললেন, ‘বাবা, মুইছাই আর কী অইবো। ডাকি ভগবানরে, আইছি আল্লাহর কাছে। মারলে মাইরা ফালাউক।’

 

একটুপর সেখান থেকে চলে গেলাম কাছের কবরস্থানে। মনে হলো এখানে আশ্রয় নিলে হয়তো বেঁচে যেতে পারি। একটা নতুন কবরের উপরের অংশ সরিয়ে ফেলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। কবরের ভেতরের লাশটি ততদিনে অর্ধেক পঁচেগলে গেছে। লাশের পঁচা গন্ধে বেশ কয়েকবার বমি করে ফেললাম। এরপরেও ওই লাশটারেই আমার অনেক আপন মনে হলো। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর যখন বুঝলাম পাক আার্মি সরে গেছে তখন কবরের বাঁশ সরিয়ে উপরে উঠতে শুরু করলাম। এ সময় দুজন লোক আমাকে দেখে ফেলে। তাদেরকে সাহায্যের জন্য ডাকলাম। ওরা ভয় পেয়ে দূরে সরে গেল। মনে করলো কী না কী। ওদেরকে চিৎকার দিয়ে বললাম, ‘ভাই আমি মানুষ।’

 

মসজিদের পানি দিয়া গায়ের ময়লা পরিষ্কার করলাম। ততক্ষণে চারদিক ফর্সা হয়ে গেছে। হঠাৎ ওপরে তাকিয়ে দেখলাম, মসজিদের মিনারা থেকে একজন লোক নিচের দোকনদারকে বলছে, ‘ওই আমার লাইগা দুইটা সিগারেট পাঠা।’ এই দৃশ্য দেখে বোঝার উপায় নাই, কিছুক্ষণ আগে এখানে কী তাণ্ডবইনা হয়ে গেছে।

 

আমি ওপরে তাকিয়ে ভাবলাম, এখানে আমাকে ঢুকতে হবে, বিশ্রামের প্রয়োজন। মিনারায় ওঠার পর ভেতর থেকে দরজা লাগানো ছোট্ট একটি খুপড়ি পেলাম। দরজায় টোকা দিতেই জিজ্ঞেস করল কে?

আমি বললাম, মাওলানা।

ভাবলাম মাওলানা না বললেতো দরজা খুলবে না। দরজা খুলতেই ওই লোক ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে বলল, আপনি তো মাওলানা না?

 

তাকে ঝাড়ি দিয়ে বললাম, দূর ব্যাটা সর, বহুত বড় মাওলানা আমি। দরজা লাগা।

ভেতরে ঢুকে দেখলাম ওই ছোট্ট খুপড়িতেই আশ্রয় নিয়েছে  সাত আটজন। এদের মধ্যে মোটাসোটা একজন দূরের গুলির শব্দ পেলেই মিনারার ছোট জানালা দিয়ে হাত বের করে দেয়। মনে হয় সে এখান দিয়েই বের হয়ে লাফ দিবে।

ওকে ঝাড়ি মেরে বললাম, মিয়া, আমার লগের সব লোক মইরা গেছে। আর আপনি ওদিকে দিয়ে বাইর অইবার চান? আহেন আমার লগে।

ওই লোক পাগলের মতো প্রলাপ বকছিল, মইরা যামু মইরা যামু। 

 

কিছুক্ষণ পর মনে হলো এবার একটা সিগারেট দরকার। জানালা খুলে নিচের দোকানদারকে বললাম এক প্যাকেট সিগারেট দিতে পারবেন?

আমার দিকে তাকিয়েই এক লোকরে দেখলাম ঝেড়ে দৌড় দিতে। একটু পরে ওই খুপড়ির বাইরে এক লোক এসে বলল, ভাই আমি বদু (খাটের নিচে লুকানো চারজনের একজন)। আমাগো মাফ কইরা দেন। আমরা আপনেরে পাক আর্মির হাতে তুইলা দিছিলাম।

 

আমি বদুকে বললাম, ভাই এদিকে থাকুম না, আমি ওই পাড়ে যামু।

নদী পার হওয়ার আগে বদু বলল, ভাই একটা আধা মরারে লয়া যাইতে অইবো। লোকটার মাথার হাড় গুলি খায়া উল্টায়া গেছে।

 

নৌকায় করে যখন মিটফোর্ডের দিকে যাচ্ছিলাম তখন পাক আর্মি দূর থেকে গুলি করলে একটা গুলি নৌকায় এসে লাগে। শেষ পর্যন্ত সাঁতার কেটে নৌকাটিতে ঠেলতে ঠেলতে জায়গামতো পৌঁছে দিলাম।

 

এরপর রায়সাহেব বাজারে এইচ আকবর সাহেবের বাসায় যেয়ে উঠলাম। আমি ওই বাসায় যাওয়ার এক ঘণ্টা আগে খবর আসে, আর্মির গুলিতে আমি মারা গেছি। আমাকে জীবিত দেখে বাসার সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। 

 

রায়সাহেব বাজার থেকে তিনমাস পরে আমি মগবাজার আসি। এখানে থেকেই ঢাকা শহর রেকি করছি। মুক্তিযোদ্ধা টুলু ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। ঢাকায় প্রবেশের পর যেসব গেরিলা সহযোগিতা চাইতো, ওদেরকে সহযোগিতা করতাম। যুদ্ধের শেষের দিকে চলে যাই সীমান্তের কাছে। তবে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার আগেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ ডিসেম্বর ২০১৬/শাহেদ/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়