ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অধরা স্বপ্ন

ইমরান মাহফুজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৬, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অধরা স্বপ্ন

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

|| ইমরান মাহফুজ ||

নীরবে কাঁদতে লাগলো মেয়েটি। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অবিরম চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকলো। যেন আকাশ ভেঙ্গে অঝোর ঝরছিল বৃষ্টি। অশ্রু; সে একটি কাঁচা রঙের রুমাল দিয়ে চোখ-মুখ মুছে নিল।

কাজের ব্যস্ততা সত্ত্বেও একজন নার্স নীরব দর্শক হয়ে, মন-নিরাময় বিশষজ্ঞের মতো দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটির সামনে। যেন তার কাজ ধৈর্য্য সহকারে দাঁড়িয়ে থাকা!
কিছুক্ষণ পর সুমি নামের মেয়েটি কান্না থামিয়ে পরিস্কার চোখে দণ্ডায়মান নার্সের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ম্যাম কিছু মনে করবেন না।’
নার্স তার কথা শুনে একটু বিচলিত হলো সম্ভবত মেয়েটির মুখে ‘ম্যাম’ শব্দটি শুনে, যা ম্যাডাম শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ।
নার্স খুব মৃদু ভাষায় বলল, ‘আমি কিছু মনে করিনি। কেন? কী হয়েছে?’
‘না,মনে হচ্ছিলো আপনি হয়তো কিছু বলবেন। সে জন্যে বললাম,অন্য কিছু না।’

কথোপকথনের এই পর্যায়ে জরুরী বিভাগ থেকে ডাক আসে। ‘আমি এখন যাই, কাজ আছে। সময় পেলে আসবো।’ বলেই নার্স জরুরি বিভাগের দিকে দ্রুত হাঁটতে থাকে। এরপর সুমি একা হয়ে যায়,পাশের বেডগুলোতে রোগী থাকা সত্ত্বেও। একা হলে নাকি চতুর্দিকের চিন্তা ঘিরে ধরে- সে অনেককে বলতে শুনেছে এ কথা। সুমিরও এখন এমন পরিস্থিতি। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ গতরাতের প্রায় শেষ প্রহরের কথা মনে পড়ে। ওই সময় সে এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রায় আধামরা অবস্থায় আবিষ্কার করেছিল।

সুমির ভাবনার ছন্দপতন হয় এক চিকিৎসকের আবির্ভাবে। সে এগিয়ে এসে চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। তারপর রিপোর্ট কার্ড হাতে নিয়ে জানতে চায়- এখানে আমার কোনো স্বজন আছেন কিনা?
সুমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে একবার দেখে নেয়। না,কেউ নেই। তাকে দেখতে কেউ আসেনি। এবার সেই চিকিৎসক কপালে ভাঁজ ফেলে মৃদু স্বরে জানায়- আপনি মা হতে চলেছেন!

শুনে সুমি ডুকরে কেঁদে ওঠে। অব্যক্ত যন্ত্রণা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। সে আর কোনো কিছুই ভাবতে পারে না। সব অসম্ভব মনে হয় তার কাছে। সে যথেষ্ট সতর্ক ছিল। সে ভেবেছিল, সেইফ পিরিয়ডে শুক্রানু ডিম্বানুকে নিষিক্ত করতে পারে না। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল!

সুমির মনে পড়ে গতকাল রাত প্রায় এগারোটা পর্যন্ত খুব আনন্দেই ছিল সে। কিন্তু এরপর থেকেই রাতের নিকশ কালো যত বাড়তে থাকে সুমির অবস্থাও খারাপ হতে থাকে। মধ্য রাতের পর থেকেই শুরু হয় বমি, মাথা ব্যথা, সঙ্গে তলপেটে অসহ্য যন্ত্রণা। বান্ধবী দীপা এবং তার বড় ভাই আজাদ তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। রাত তখন ৩টা। সুমিকে ডাক্তার দেখানো, ভর্তি করানো, ওষুধ কিনে দিয়ে তারা চলে যায়। যদিও দীপা সুমিকে এভাবে রেখে যেতে চাইছিলো না, তবু তাকেও যেতে হয়।

দুই
কামাল মিয়া কয়েক বছর আগে দুবাই যায়। একটা ভালো চাকরিও মেলে। মাসে ৪০-৫০ হাজার টাকার মতো পায়। এ টাকায় কামাল মিয়ার পরিবার খুব ভালভাবে চলতে পারে। এই পরিবারের একমাত্র সন্তান সুমি। তার আদর আর আবদারের কমতি হয় না। বিন্দুমাত্র সমস্যায় মা-বাবা উভয়ই ব্যকুল হয়ে ওঠে। অভাব রাখে না।

দীপার কাছে মুঠোফোনে খবর পেয়ে সুমির মা ছুটে আসেন হাসপাতালে। সুমিকে দেখে সে অধিক শোকে পাথড় হয়ে যায়। নীরব ভাবনায় পরিস্থিতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো তো দূরের কথা মেয়েকে হাসপাতালের বেডে ঠিক করে বসিয়ে রাখতেও পারে না। ছোপ ছোপ রক্তে ভিজে ওঠে হাসপাতালের বিছানার চাদর। সুমির তলপেটে তীব্র ব্যথা জানান দেয়, অবস্থা গুরুতর। ডাক্তারও সামান্য কিছু পরীক্ষার পর খসখস করে কাগজে কতগুলো ওষুধ লিখে দেয়। তারা জানিয়ে দিতে ভোলে না, সাবধান! ওষুধগুলো নিয়মিত খাবেন। না হলে কিন্তু  মাশুল দিতে হবে।

ডাক্তারের কথায় সুমি আরো বিচলিত হয়। কিছু বুঝে উঠতে পারে না। কী ঘটছে এসব? সুমির মা-ও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন মনে মনে। এক পর্যায়ে আর থাকতে না পেরে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেই ফেলেন, ‘একি করলিরে মা! তর বাপেরে আমি অহন কী জবাব দিমু?’

তিন
পাড়ার উচ্চশিক্ষিত বলতে হাতে গোনা কয়েকজন। জহিরকে যে কারণে সবাই ভালোবাসে। সুমির মা-ও সেই ভালোবাসার টানেই তাকে বলেছিল সুমির পড়াগুলো দেখিয়ে দিতে। জহির সহজেই রাজি হয়ে যাওয়ায় বরং সে খুশিই হয়েছিল।

সে প্রতিদিন আসত সুমিদের বাসায়। শুক্রবারও বন্ধ নেই। একদিন হঠাৎ হাসতে হাসতে সে বলেছিল, ‘টিয়ে পাখির ঠোঁট তুই কোথায় পেলিরে?’
এ কথা শুনে সুমি লজ্জায় কুঁকড়ে গেলেও মনে মনে খুশিই হয়। আরেকদিন তো বলল, নীল কার্ডিগানে নাকি তাকে পাতালপুরীর রাজকন্যা মনে হয়। ততদিনে অবশ্য সুমির লজ্জা কেটে যেতে শুরু করেছে। এই প্রশংসা তাকে অন্য জগতে নিয়ে যেতে থাকে। দিন যেতে থাকে দিনের মতো। এমনই এক দিনে জহির সুমির গা ঘেঁষে বসার চেষ্টা করে। প্রথমে সুমি বাধা দিয়ে সরে বসে। কিন্তু কতক্ষণ? এক ধরনের ভালোলাগার ঘোর তাকেও পেয়ে বসেছিল। আর তাতেই সুমির সকল বাধা ভেসে গিয়েছিল বানের পানির মতো।

সুমি তবুও বলেছে বারকয়েক, ‘এখন না পড়ে। আগে বিয়ে হোক। তারপর ওসব।’
জহির বলেছে, ‘বিয়ে তো হবেই। বোকা মেয়ে!’
হ্যাঁ, সুমি এখন বুঝতে পারছে সে কতটা বোকামি করেছে। এই বোকামির মাশুল সে কীভাবে দেবে- রাজ্যের ভাবনা এসে ভিড় করে সুমির মনে। মার ডাকে সম্বিত ফেরে তার। মা জানতে চান, ‘কী ভাবছিস?’
সুমি মুখে বলে, ‘কিছু না।’ কিন্তু মনজুড়ে তার দুশ্চিন্তার মেঘ। মহাকাল নামক সময়ের কাছে তার স্বরূপকাল অতিক্রম করা নিজ সত্তায় মিশে যাওয়া নামান্তরেও, যেন ভালোবাসাকে ঘৃণা জানানোর সাহস ধুলায় লুটিয়েছে।




লেখক : কবি, সম্পাদক কালের ধ্বনি





রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫/তাপস রায়



রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়