ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অনুগল্প :: স্মৃতির জীবন

মীর মোস্তাইন বিল্লাহ্ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ২২ এপ্রিল ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অনুগল্প :: স্মৃতির জীবন

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

মীর মোস্তাইন বিল্লাহ্

জাদুকর

রাস্তায় বা হল রুমে আপনি হয়তো জাদুর অনুষ্ঠানে গিয়েছেন। একটা একশ টাকার নোট থেকে শত শত একশ টাকা বানাচ্ছে দেখতে পাচ্ছেন। আপনি কিন্তু শতভাগ নিশ্চিত যে, একশ টাকার নোট আসলে একটাই। আপনি মনেপ্রাণে জাদুকরের টাকা বানানোর কৌশল ধরতে চেষ্টা করছেন। জাদুকরের জাদুবিদ্যার গোপন পথটা আবিষ্কার করতে চাচ্ছেন। বিষয়টা আসলে অনেকটা আপনার মতই যা আপনি আজীবন বুঝতেই পারেননি যে আপনি একা। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসে আপনি জেনে গেলেন যে, আপনি আসলেই শতভাগ একা। আপনার চারপাশে যে আপনজন আপনি জাদুকরের মতো তৈরি করেছেন, আসলে সব মেকি! সবই নকল! ঠিক জাদুকরের জাল টাকার মতো।

চিরকুমারের মুঠোফোন

মোবাইল ফোন আমি আমার এই জীবনে বন্ধ করেছি বলে মনে পড়ে না। রাতে ঘুমানোর সময় সাইলেন্ট করে রাখতাম। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই আগে দেখে নিতাম কেউ ফোন দিয়েছিল কিনা। ফোন আসেনি দেখলে মনটা কেমন যেন করত। আবার কোনো দিন দেখতে পেতাম রাত তিনটা বা চারটায় অচেনা কোনো নম্বর থেকে কয়েকবার ফোন দিয়েছিল। বিছানায় শুয়েই কল ব্যাক করতাম। তখন হয়ত ফোনটা বন্ধ পেতাম। ভাবতাম কোনো নেশাখোর হয়ত নেশার ঘোরে অচেনা নম্বরে কল দিয়েছিল রাত জাগা কোনো নারীকে ধরার জন্য। দুপুরের দিকে বা বিকেলে আবার ফোন দিতাম। রিসিভ করলে জানতে চাইতাম, এই নম্বর থেকে কাল রাত তিনটায় একটা ফোন এসেছিল। আপনি কে জানতে চাইলে ওপাশ থেকে রোমান, ইমন, ঝন্টু, মন্টু এই ধরনের কিছু একটা বলত। আমি কে জানতে চাইলে বলতাম, আমি মো. রমিজ উদ্দিন রমিজ। এই সব কথার পর হয়ত ওপাশ থেকে বলত, ওহ্ স্যরি! ভুলে হয়ত কলটা গিয়েছিল। আমি বলতাম ওকে, ইটস্ ওকে।

চাকরি থেকে অবসরের পর দিনগুলো আরও ভীষণ রকমের দম বন্ধ হবার মতো কাটছে। শুয়ে শুয়ে রবীন্দ্রসংগীত বা হেমন্তের হারানো দিনের গান শুনতে শুনতে মোবাইল ফোনে নম্বরগুলো দেখতে দেখতে কাউকে কল করে বসতাম। ছয়টা টুট টুট রিং হবার পর মোবাইলের স্কিনে ভেসে উঠত ‘নো আনসার’। হয়তো কাউকে ফোন দিয়েছি রিং টোন বাজছে ‘আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম, ... শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যাটুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম, আমার সারাটা দিন...’ ব্যস্ততার কারণে ওপাশ থেকে লাইনটা হয়তো কেটে দিত। মনে মনে ভাবতাম ইস্ ফোনটা না হয় নাই রিসিভ করলি, শ্রীকান্তের অপূর্ব গানটা তো শুনতে দিতি। আফিসের পিয়ন রফিক ছেলেটা, যে মাঝে মধ্যেই সংসারের আর্থিক অনটনের কথা বলে আমার কাছ থেকে ধার দেনা করত, আজ কাল যখন কথা বলার মতো কাউকে পাচ্ছি না কিন্তু কারও সাথে কথা বলার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে পড়েছে, তখন হয়ত আমার এক মাত্র কথা বলার নির্ভরতা রফিককে ফোন দিয়ে কুশলাদি জানতাম। মেয়ে দুটোর পড়াশোনার খোঁজখবর নিতাম। সংসার কেমন চলছে, এই সব কথা বলতাম। কিন্তু অবসরে আসার পর রফিকও ফোন খুব একটা ধরে না। মাঝে মধ্যে ফোন ধরে বলে, স্যার খুব ব্যস্ত সময় তো কথা বলার মত সময় পাই না।

জুয়াড়ী

মাহতাব আহমাদ বুঝতে পারছেন কেউ একজন উঠেপড়ে লেগেছে কথাটাকে শেষ বারের মতো বলাতে। বলুন, লা ইলাহা... বলুন, লা ইলাহা...। কিন্তু আহমাদ সাহেবের সেই দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি এখন সেই ছোটবেলার সময়টাতে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন।

আজিজুর, মোখলেছ, আমিরুল, আফছার এই চারজনই ছিল তার সব সময়ের খেলার সাথী। তার মধ্যে উনিশ কি বিশ বছর বয়সে এক কন্যা সস্তান রেখে আফছার চিরস্থায়ী ঠিকানায় পাড়ি জমিয়েছে। পাঁচজন মিলে কতনা মধুর সময় কাটিয়েছেন। মার্বেল খেলে সারা দুপুর পার করে দিয়েছেন। সিগারেটের খালি প্যাকেট টাকা বানিয়ে চাড়া খেলতেন। স্টার সিগারেটের প্যাকেট এক টাকা, ক্যাপেস্টেনের প্যাকেট পাঁচ, সিজারেরটা দশ আরও কি কি সিগারেটের প্যাকেট বিশ, পঞ্চাশ, একশ, পাঁচশ টাকার নোট বানিয়ে চাড়া খেলতেন এখন মনে করতে পারছেন না। মাহতাব সাহেবের বন্ধু বলতে ছিল এই চারজন- প্রতিযোগীও ছিল এই চারজনই। সিগারেটের প্যাকেট জমানোর নেশা হয়ে গিয়েছিল তাদের। বুধবার আর শনিবারে তিনানী বাজারে যাবার সুযোগ হতো মাঝে মধ্যে। তখন তাদের দৃষ্টি থাকত সিগারেটের দোকানের নিচ দিকে, যেখানে খালি প্যাকেট পড়ে থাকত। দেখতে পেলেই বাজ পাখির মত ছোঁ মেরে নিয়ে নিত প্যাকেটা। মাহতাব আহমদের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে সে এতো এতো প্যাকেট জমাবে যাতে তার সংগ্রহ সবাইকে ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু বড় হবার পর স্বপ্নটা নিছক ছেলেখেলা হিসেবেই অর্থহীন মনে হয়েছিল। আজও কেন জানি মাহতাব আহমদ সাহেবের কাছে সেই ছেলেবেলার স্বপ্নের মতই হাজার হাজার কোটি টাকা, গ্রুপ অব কম্পানির সব ব্যবসাও সিগারেটের প্যাকেটের মতই নিরর্থক মনে হচ্ছে। কেবলই মনে হতে লাগল ছেলেবেলার স্বপ্নের মোহ যেমন বড়বেলায় হাস্যকর মনে হয়েছিল, আজ আবার সে রকম টাকার পাহাড়ও তার কাছে মূল্যহীন মনে হচ্ছে।

মাহতাব আহমদ বিছানায় শুয়ে পাথর দৃষ্টিতে চারপাশে ঘিরে থাকা আপনজনের মুখ দেখছেন। তিনি কাউকে মনে করতে পারছেন না। শুধু শুনতে পাচ্ছেন কেউ একজন বলেই চলছে... বলুন, বলুন, লা ইলাহা ইল্লাললাহু...।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ এপ্রিল ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়