ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

গ্রন্থমেলা নিয়ে লেখক ভাবনা

অন্ধকার শক্তি দূর হোক, বুদ্ধিবৃত্তির প্রসার ঘটুক

কাজী আশরাফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০০, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অন্ধকার শক্তি দূর হোক, বুদ্ধিবৃত্তির প্রসার ঘটুক

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

কাজী আশরাফ : বছর ঘুরে আবারও শুরু হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। প্রতি বছরের মতো এবারও রাইজিংবিডি গ্রন্থমেলা নিয়ে বিশেষ আয়োজন করেছে ‘ফাগুনের মলাট’। কেমন হবে লেখক পাঠক ও প্রকাশকের প্রাণের বইমেলা- এ বিষয় নিয়ে রাইজিংবিডিকে মতামত জানিয়েছেন বিশিষ্ট কয়েকজন কবি ও লেখক।

 

জাকিরতালুকদার, কথাসাহিত্যিক

অন্ধকার শক্তি চায় গ্রন্থমেলায় মানুষ কম আসুক। মেলায় যেসব লেখক- প্রকাশক ও পাঠক আসেন তাদের অধিকাংশই মুক্তমনের। অতীতের ঘটনা পুনরাবৃত্তি আর দেখতে চাই না। বাংলা একাডেমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গ্রন্থমেলা পাঠিয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশে দীর্ঘসময় ধরে এত বড় মেলার আয়োজন হয় না।বাংলা একাডেমি প্রতিবারের মতো এবারও এই মেলার আয়োজক। এতে তাদের তিনমাস সময় অপচয় হয়। মূলকাজ থেকে দূরে সরে যায়। বাংলা একাডেমির উচিত প্রকাশক সমিতি বা অন্য কাউকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া। গ্রন্থমেলায় শিশুদের বই বেশি বিক্রি হয়। অথচ শিশুদের জন্য আলাদা কর্ণার নেই। ঝামেলামুক্তভাবে শিশুরা যেন ঘুরে ঘুরে বই দেখে কিনতে পারে তার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।শিশুদের জন্য আলাদা করে ‘শিশু কর্ণার’ বানাতে হবে। এবার ‘বন্ধু আমার’ নামের একটি কিশোর উপন্যাস আসবে চন্দ্রাবতী একাডেমি থেকে। নির্বাচিত গল্প আসবে কবি প্রকাশনী থেকে। গদ্যপদ্য থেকে ‘মেয়েটি কেবল নিয়তির কাছে গিয়েছিল’ উপন্যাস। স্টারবুকস থেকে আসবে ‘আহ্নিক গতি’ নামে আরেকটি উপন্যাস।

 

ফকির ইলিয়াস, কবি

এবারের একুশে গ্রন্থমেলা ভালোভাবে হবে বলেই আশা করছি। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সেই সাথে আমাদের মনন, বিবেক ও বুদ্ধিবৃত্তির প্রসার ঘটুক-এটা চাইছি মনেপ্রাণে। এবারের মেলায় আমার তিনটি বই বের হবে। সাহিত্য-শিল্প বিষয়ক প্রবন্ধের বই- `সাহিত্যের শিল্পঋণ` বের হচ্ছে অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে। ৭১ এর ৭১ উপন্যাস নামে একটা সিরিজ করছে `বেহুলা বাংলা`। এই সিরিজে আমার একটি উপন্যাস থাকছে। এটি আমার মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক একটি উপন্যাস। একটি  কবিতার বই বের হবে দেশ পাবলিকেশনস থেকে।

 

আমিনুল ইসলাম, কবি

গ্রন্থমেলা হবে সুন্দর এবং নান্দনিকভাবে উপভোগ্য। কোনো রক্তপাত হবে না, কেউ নির্যাতিত হবে না। কবি-লেখক কোনোভাবেই অসম্মানের শিকার হবেন না- এমন গ্রন্থমেলা প্রত্যাশা করছি। মেলায় যারা যাবেন, অন্তত একটি হলেও বই কিনবেন--এই দাবি আমার। যেসব লেখকের বই প্রকাশ করে প্রকাশকের মুনাফা আসবে, অন্তত ঐ লেখককে তাঁর ন্যায্য রয়্যালটি দেবেন প্রকাশক- এই দাবিটাও রাখছি। এবার অনন্যা  প্রকাশনী বের হচ্ছে আমার কবিতাসমগ্র এর পরিবর্ধিত ২য় সংস্করণ। আর মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশ করছে আমার একাদশ কাব্যগ্রন্থ প্রণয়ী নদীর কাছে।

 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন, কবি

এবার মেলায় যেনো রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীকে যে পর্যায়ের নিরাপত্তা  দেওয়া হয়, সেরকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শাহবাগ, মৎস্য ভবন, দোয়েল চত্ত্বর, টিএসসি সবদিক থেকে যেনো মেলায় ঢোকার গেট রাখা হয়। কয়েক স্তরের নিরাপত্তা, সিসিক্যামেরা ও চেকিং পয়েন্ট থাকতে হবে। আমি ভয়ভীতিহীন নিঃশঙ্ক একটা বইমেলা চাই। আর কোন অভিজিৎ এর রক্ত দেখতে চাই না, আর কোন দীপনকে হারাতে চাই না। মেলায় ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াতে চাই। বই কিনে নিয়ে এসে কোন পাঠক চাইলে তাকে অটোগ্রাফ দিতে চাই, তার সাথে কথা বলতে বলতে চা খেতে চাই। বড় লেখকদের আড্ডায় গলা বাড়িয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকবো চুপচাপ। আমি দেখতে চাই, তন্বী-তরুণী সেজেগুঁজে তরুণের হাত ধরে ঘুরছে মেলায়, উল্টে পাল্টে দেখছে আমার, আমাদের বই। শিশুকে কাঁধে করে এনেছেন বাবা, স্বামীর হাত ধরে এসেছে নববিবাহিতা। এমন আবহের নিরাপদ একটি বইমেলার পরিবেশ আমি চাই। বাংলা একাডেমি যেনো ভালো বইগুলোর মূল্যায়ন করে, একইভাবে মেলায় প্রকাশিতব্য ভালো বইগুলোকে যেনো আমাদের মিডিয়ার সাংবাদিক-বন্ধুরাও তুলে ধরে, সে আশাবাদ ও প্রার্থনা রাখছি আমি সংশ্লিষ্ট সবার কাছে।

 

পিয়াস মজিদ, কবি ও গল্পকার

প্রতিবছর বইমেলা এলেই একটি ভাবনা ফিরে ফিরে আসে। বই আগে না বইমেলা আগে? বাংলাদেশে যখন একুশে গ্রন্থমেলা ছিল না তখন কি বই প্রকাশ পেত না? শুধু ফেব্রুয়ারি মাসই কি বই প্রকাশের মৌসুম? বই তো তখন অবশ্যই বেরুতো এবং এখনকার চেয়ে সেসব বইয়ের মানও ছিল যথাযথ রক্ষিত। এখনকার মতো ডিসেম্বর-জানুয়ারিকেন্দ্রিক বই গোছানোর তৎপরতা যেমন তখন লেখকদের ছিল না তেমনি ফেব্রুয়ারি  এলেই কোনোমতে ছাপাই-বাঁধাই করে ভুলে ভরা ভেজাল বইটা পাঠকের ঝুলিতে গছিয়ে দিতে প্রকাশকরাও সাহস করত না। এখন অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে দোষটা না লেখকদের দেওয়া যায় না প্রকাশকদের। প্রকাশনার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় একটা অচলায়তন তৈরি হয়েছে। এই অচলায়তন না ভাঙা গেলে প্রকৃত জ্ঞানভিত্তিক সমাজ সৃজনের আকাঙ্খা  অঙ্কুরেই মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য। রবীন্দ্রনাথ বলেন- ‘ভালো বই পড়িবার সময় মনে থাকে না যে বই পড়িতেছি।’ আর প্রমাদপূর্ণ বই পড়তে পড়তে আমাদের বারবার মনে হয় একটা যন্ত্রণাকর অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে যাচ্ছি। তখন কিন্তু বই পড়ার আগ্রহটাও ফিকে হয়ে আসে। এ জন্য একুশের চেতনা শুধু পৌষ-ফাগুনের পালায় সীমাবদ্ধ না রেখে সারা বছর ধরে যদি বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত-পরিচর্যা ও প্রকাশ করা যায় তবে বোধহয় ভাষার জন্য জীবনদানের গৌরবগান আমাদের কণ্ঠে শোভা পাবে। পৃথিবীর আর কোথাও কোনো নির্দিষ্ট মাস ধরে বই প্রকাশ হয় বলে আমাদের জানা নেই। অনেকে হয়ত বলবেন এটাই আমাদের স্বাতন্ত্র্য। বিনীতভাবে বলতে চাই মানুষ- ঠকানো বিকৃত স্বাতন্ত্র্যের হাত থেকে নিস্তার চাই। বই বের হোক জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মার্চ এপ্রিল মে জুন জুলাই আগস্ট সেপ্টেম্বর অক্টোবর নভেম্বর ডিসেম্বর-সকল সময়ে। যেকোনো পণ্যের মান যাচাইয়ের জন্য যেমন বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান থাকে তেমনি বইয়ের মান যাচাইয়ের জন্য একটি পরিকাঠামো গড়ে উঠুক। যেন-তেন বই দিয়ে ক্যাটালগ দীর্ঘ করার প্রবণতার বিপরীতে অন্তত একটি স্মরণীয় পাঠযোগ্য বই প্রকাশের প্রতিযোগিতা শুরু হোক। আর প্রিয় পাঠিকা ও পাঠকের কাছে প্রত্যাশা- বইমেলায় প্রতিষ্ঠিত নামকে নয় প্রকৃত বই সংগ্রহ করুণ। তরুণ লেখকদের বই কিনুন, চিন্তার নতুন ধারাকে আপনার সামর্থ্যে পৃষ্ঠপোষণা করুন। এবার বেশ কিছু বই বেরুচ্ছে। অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হবে প্রথম গল্পের বই নগর ঢাকায় জনৈক জীবনানন্দ, সময় প্রকাশন থেকে কবিতার সংকলন কবিকে নিয়ে কবিতা, ঐতিহ্য থেকে ব্যক্তিগত গদ্যের সংকলন এলোমেলো ভাবনাবৃন্দ। এছাড়া অনিন্দ্য প্রকাশ আমার সম্পাদনায় প্রকাশ করছে অগ্রন্থিত আবদুল মান্নান সৈয়দ- প্রথম খণ্ড।

 

শামীম হোসেন, কবি

গ্রন্থমেলা একটি প্রাণের জায়গা। বাংলাভাষার সর্ববৃহৎ যে মেলা সেটি বই মেলাকে কেন্দ্র করে হয়ে আসছে।আমি থাকি ঢাকার বাইরে। কিন্তু, মেলা মাস এলেই নতুন বইয়ের টানে চলে আসি গ্রন্থমেলায়। এটা একটা হ্নদয়ের  টান। এই টানকে আমি উপেক্ষা করতে পারি না। দেশে যতসব মেলা আছে গুরুত্বের দিক দিয়ে গ্রন্থমেলাকে আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। বাংলা একাডেমি যেহেতু এই মেলার আয়োজক তাদের উচিত খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে আন্তর্জাতিকভাবে এটাকে উপস্থাপনা করা।এতে আমাদের শিল্প সাহিত্যর প্রসারতা বাড়বে। প্রয়োজনে মেলাকে কেন্দ্র করে বিদেশি অতিথি আমন্ত্রণ জানাতে হবে। বাংলাদেশের প্রকাশনার মান বিদেশি বইয়ের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। কলকাতার বইয়ের চেয়ে আমাদের বইয়ের মান অনেক ভালো। এবার আমার প্রকাশিত কোন বই নেই। তবে ‘ধানের ধাত্রী’ বইটি প্লাটফর্ম প্রকাশনীতে  থাকবে।

 

শামস সাইদ,  প্রাবন্ধিক

এ মেলা অন্যদশটি  সাধারণ পণ্যের মেলার মতো নয়। এ মেলা জ্ঞানের মেলা। মালি, ফুল ও ভোমরের মেলা। লেখক পাঠকের যোগসূত্রের মেলা। একজন পাঠক তার প্রিয় লেখককে এসময় সবচেয়ে কাছে পান। আবার লেখকও তার সৃষ্টির উৎসাহ খুঁজে পান পাঠকের মাঝে। তাই গ্রন্থমেলা একটি ব্যতিক্রমধমী মেলা। বাংলা ভাষা চর্চা, দেশপ্রেম, সর্বোপরি  সাম্প্রদায়ীক সম্প্রীতি বৃদ্ধি করে এ মেলা। তাই প্রতি বছরই এই মেলা আনন্দমেলা, প্রাণের মেলা হয়ে উঠেছে। গ্রন্থমেলা হয়ে উঠেছে জাতির মেল বন্ধনের প্রতীক। তবে মেলায় এখন আর নির্ভয়ে আসার মতো পরিবেশ নাই। মেলা প্রাঙ্গনে ২০০৪ সালে ঘাতকদের আঘাতে রক্তাক্ত হন হুমায়ুন আজাদ। এর পরেও গত বছর বই মেলায় প্রাণ দিতে হলো আর এক লেখক অভিজিতকে। তার ধারাবাহিকতায় প্রাণ দিতে হলো প্রকাশক দীপনকে। এই আতঙ্ক লেখক পাঠক সবার ভিতরেই রয়ে গেছে। তাই মেলায় লেখক পাঠক সবারই নিরাপত্তা সরকারের নিশ্চিত করতে হবে।  মেলাটা হওয়া উচিত ফুল বাগানের মতো। পাঠক আসবে তার পছন্দের বইটা খুঁজে নিবে। কিন্তু সে পরিবশটা এখনও গ্রন্থমেলায় সৃষ্টি হয়নি। এবার আমার দুটি কিশোর উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। অরমার গল্প। প্রকাশ করেছে অনিন্দ্য প্রকাশ। ফজল মাস্টরের স্কুল। প্রকাম করেছে বেহুলা বাংলা। 

 

হানযালা হান, কবি

বই বিক্রির মেলার সঙ্গে বই পাঠের মেলা হতে পারে। পাঠক যাবেন, বই দেখবেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে পড়বেন, মন চাইলে কিনবেন। চা-পানি ও শৌচাগারের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। গ্রন্থমেলায় রক্তঝরা বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে বাংলা একাডেমিকে সক্রিয় হতে হবে। একজন লেখক-প্রকাশক মারা গেলে তার দায় এড়ানো যাবে না। এটা হাস্যকর দাবি যে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে লাশ পড়বে অথচ মেলাপ্রাঙ্গণে পড়বেনা, সারা বছর মানুষ মরবে অথচ ফেব্রুয়ারি মাসে মরবেনা। মানুষ মারার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে আগে। বিচার বা বিনাবিচারে হত্যার রীতি বন্ধ না করলে সংকট বাড়বে। এবার কবিতার বই ‘জোছনার সাইরেন’ প্রকাশিত হচ্ছে।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়