ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

অভাবের কাছে অসহায় শিশু

আলম শামস || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৭, ২৩ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অভাবের কাছে অসহায় শিশু

আলম শামস : মা-বাবার কাছে অতি প্রিয় হলো সন্তান। কিন্তু অনেক বাবা-মা অভাব-অনটন, ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে আদরের শিশু সন্তানকে পাঠান কাজে। কখনো কখনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও পাঠাতে বাধ্য হন তারা।

 

যে বয়সে হাতে বই-খাতা থাকার কথা; খেলাধুলা করার কথা; মায়ের স্নেহ, বাবার ভালবাসা, পরিবারের সহযোগিতা পাওয়ার কথা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিজের অধিকার পাওয়ার কথা সে বয়সে জোটে চায়ের কেটলি, জোটে অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য আর সন্ত্রাসী-মাদকসেবীদের সঙ্গ। জীবন নামের তরীর মাঝি হয়ে দাঁড়ায় সে নিজেই। কখনও কখনও তার তরী ভিড়ে যায় কোন মাদকসম্রাট, মানবপাচারকারী বা অপরাধীদের গডফাদারের ঘাটে।

 

আর এখানেই অভ্যাস হয়ে যায় নেশা করার। নেশার টাকা সংগ্রহে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ে নেমে পড়ে। নিজেকে বাঁচানোর জন্য খোঁজে রাজনৈতিক আশ্রয়। একদিন এই শিশু পৃথিবীতে এসেছে সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পদ হয়ে বেড়ে ওঠার জন্য কিন্তু সেখানে তাকে গ্রাস করছে অপরাধ। আমাদের সমাজ তাকে বানিয়ে দিচ্ছে গডফাদার বা সন্ত্রাসী। এভাবেই হারিয়ে যায় সম্ভাবনাময় কিছু সুন্দর জীবন। চলে যায় অন্ধকারের অতল গহ্বরে।

 

আমাদের দেশে শিশুদের সুরক্ষায় আইন আছে। নেই শুধু তাদেরকে সুন্দর পরিবেশ দেয়ার জন্য আন্তরিক ও কার্যকর পদক্ষেপ।

 

জাতিসংঘ প্রণীত শিশু অধিকার সনদে ১৮ বছরের কম বয়সী প্রত্যেককে শিশু বলা হয়েছে। জাতিসংঘের শিশু সনদ এখন একটি আন্তর্জাতিক আইন। এতে শিশুর অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, ক) স্নেহ, ভালবাসা ও সমবেদনা পাওয়ার অধিকার, খ) পুষ্টিকর খাদ্য ও চিকিৎসা সুবিধা পাওয়ার অধিকার, গ) অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ, ঘ) খেলাধুলা ও আমোদ-প্রমোদের পূর্ণ সুযোগ পাওয়ার অধিকার, ঙ) একটি নাম ও নাগরিকত্ব, চ) পঙ্গু শিশুদের বিশেষ যতœ ও সেবা পাওয়া অধিকার, ছ) দুর্যোগের সময় সবার আগে ত্রাণ ব্যবস্থা পাওয়ার অধিকার, জ) সমাজের কাজে লাগার উপযোগী হয়ে গড়ে ওঠার এবং ব্যক্তি সামর্থ্য অর্থাৎ সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাওয়ার অধিকার, ঝ) শান্তি ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের মনোভাব নিয়ে গড়ে ওঠার সুযোগ পাওয়ার অধিকার।

 

জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও ছেলে বা মেয়ে নির্বিশেষে বিশ্বের সব শিশুর এই অধিকার থাকবে। বাংলাদেশে শিশুদের অধিকার রক্ষা ও তাদের বিকাশের জন্য রয়েছে আইন। কিন্তু তারপরও এখানে লঙ্ঘিত হচ্ছে শিশু অধিকার। শিশু-কিশোরদের যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার কথা তা পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিশুনীতিকে পাশ কাটিয়েই শিশুদের ভারী শ্রমে ও বেআইনি কাজে যুক্ত করা হচ্ছে।

 

বাংলাদেশে গৃহকর্মে নিয়োজিতদের বেশিরভাগই কিশোর-কিশোরী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ-২০১০ সালের তথ্যানুযায়ী গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশু (৫-১৭ বছর বয়সী) শ্রমিকের সংখ্যা এক লাখ ২৫ হাজার। জাতীয় শিশুনীতি-২০১০ এর খসড়ায় বলা হয়েছে, ১৪ বছরের কম বয়সীদের সার্বক্ষণিক শ্রমে নিয়োগ করা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০০ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ অর্থনৈতিক কাজে শিশুরা শ্রম দিচ্ছে। দেশের প্রচলিত আইনে শিল্প কারখানায় শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও জীবিকার প্রয়োজনে অনেক শিশুকে নানা ধরনের শ্রমে নিয়োজিত হতে হচ্ছে। শহর, গ্রাম উভয় অঞ্চলেই শিশু শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। সরকারের পরিসংখ্যান বিভাগের হিসাব মতে দেশের মোট শ্রমিকের ১২ শতাংশ শিশু। এ হিসেবে কেবল নিবন্ধনকৃত শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিশু শ্রমিকদের ধরা হয়েছে। অনিবন্ধনকৃত বা ননফরমাল সেক্টরে কর্মরত শিশু শ্রমিকদের হিসেব করলে এ সংখ্যা আরো বাড়বে। শুধু শহরাঞ্চলেই চরম দারিদ্রের মাঝে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু কাজ করছে শ্রমিক হিসেবে। আর তাদের সংখ্যা ১৯৯০ সালে প্রায় ২৯ লাখ বলে এক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে।

 

আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা শিশুশ্রম। কিন্তু এই সমস্যা সমাধানে নেই কোন ধারাবাহিক ও কার্যকর উদ্যোগ বা পরিকল্পনা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী যখন কোনো কর্ম পরিবেশ শিশুর দৈহিক, মানসিক ও নৈতিক মনোবিকাশের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হয়ে যায় তখন তা শিশুশ্রম হিসেবে গণ্য হবে।

 

আমি একদিন এক রেস্টুরেন্টে চা পান করতে গিয়েছিলাম। একটি ছোট্ট ছেলে টেবিলে এসে বলল স্যার কি খাবেন, অর্ডার দেন। ছেলেটিকে চা আনার জন্য বলি। ছেলেটা চা নিয়ে আসার সময় এক গ্রাহকের সঙ্গে তার ধাক্কা লাগে এবং হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গিয়ে ভেঙে যায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে রেস্টুরেন্ট মালিক সেই ছেলেটিকে মারলেন। তার অপরাধ সে চায়ের কাপ ভেঙে ফেলেছে। এটি শুধু এই রেস্টুরেন্টের দৃশ্য নয়। প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে এরকম অনেক ঘটনা।

 

যে বয়সে পড়ালেখা করার কথা সে বয়সে সে পেটের দায়ে শ্রম বিক্রি করছে। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লাখ শিশু অত্যন্ত ঝুঁকির্পূণ কাজে নিয়োজিত।

 

আমাদের দেশে এখনো শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়নি। আইনের যথাযথ প্রয়োগও হচ্ছে না। শহরে বিভিন্ন স্থানেই চোখে পড়ে শিশু শ্রমিক। বিভিন্ন কারখানায়, নগর পরিবহনের গাড়িতে, চায়ের দোকানে, হোটেল রেস্তোরাঁয় তাদের দেখতে পাওয়া যায়। ছোট্ট বয়সেই অনেকে পেশাদার চালক হিসেবে গাড়িতে চালকের আসনে বসে যা আইন পরিপন্থী।

 

তবে আশার কথা হলো, সরকার শিশুশ্রম নিরসনে এবং জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে নানা ধরনের কর্মকা- পরিচালনা করে যাচ্ছে। এতে বর্তমান সমাজ শিশুশ্রম বিষয়ে আগের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন হয়ে উঠছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানের অভাবে শিশুশ্রম নিরসনে কার্যকর কৌশল ও কর্মপন্থাও যেমন ঠিক করা যাচ্ছে না তেমনি শিশুশ্রম নিরসনে ঘধঃরড়হধষ চষধহ ড়ভ অপঃরড়হ (ঘচঅ) [২০১২-২০১৬]-এর আওতায় সরকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের সাফল্য চাপা পড়ে যাচ্ছে।

 

ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের ব্যবহার একটি গুরুতর ও জটিল সামাজিক সমস্যা। এ সমস্যা মোকাবেলায় এখনই সমন্বিত একটি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শিশুশ্রম নিরসনে জনসচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। সেই সঙ্গে প্রয়োজন প্রশাসনের যথাযথ হস্তক্ষেপ।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ জুন ২০১৬/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়