ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

অসাধারণ এক বঙ্গবীর

টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:১৯, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অসাধারণ এক বঙ্গবীর

শাহ মতিন টিপু : মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সামরিক নেতৃত্ব দেন। অসাধারণ বীরত্ব আর কৃতিত্ব প্রদর্শন করে তিনি পশ্চিমাদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করেন। সেই সঙ্গে তনি ছিলেন আজীবন গণতন্ত্রী, ধার্মিক ও খাঁটি দেশপ্রেমিক। তার নামটি বাদ দিলে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস রচনাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেমন, তেমনি স্বাধীন দেশেও জাতির দুঃসময়ে কান্ডারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এই বঙ্গবীর। অনেক সময় তিনি জাতিকে নির্ঘাত সংঘাত থেকে উত্তরণের পথ দেখিয়েছেন। অথচ তিনি কখনও রাষ্ট্রক্ষমতা চান নি। মহান এই বঙ্গবীরের নাম মুহম্মদ আতাউল গনি ওসমানী। যাকে আমরা এম.এ.জি ওসমানী নামে জানি।

মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীরের ৯৭তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৯১৮ সালের এই দিনে বাবা খান বাহাদুর মফিজুর রহমানের কর্মস্থল সুনামগঞ্জে তার জন্ম। তার পৈতৃক নিবাস দয়ামীর। মা জুবেদা খাতুন। একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণকারী ওসমানী জন্মেই অসাধারণ হয়ে ওঠেন নি। তিনি তার কর্ম দিয়ে বরণীয় হন, স্মরণীয় হন এদেশের মানুষের কাছে।

বঙ্গবীর ওসমানী ১৯৩১ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। পরের বছরই তিনি সামরিক শিক্ষা শেষ করে বৃটিশ কমিশনপ্রাপ্ত হন। ১৯৪১ সালে ক্যাপ্টেন এবং ১৯৪২ সালে তিনি মেজর পদে উন্নীত হন। তিনিই ছিলেন তখনকার বৃটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি একটি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হয়ে সামরিক ইতিহাসে অনন্য নজির স্থাপন করেন।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তিনি আত্মনিয়োগ করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী গঠনে। এ সময় তিনি ল্যাফটেনেন্ট কর্ণেল পদে উন্নীত হন। ১৯৫৭ সালে উন্নীত হন কর্ণেল পদে। ইপিআর প্রতিষ্ঠায় রয়েছে তার বিশাল অবদান। তারই ধারাবাহিকতায় একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনায় গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয় তার ওপর। ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে তিনি দু’বার জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।

সিলেটে রয়েছে বঙ্গবীর মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর স্মৃতিচিহ্নবিজড়িত ওসমানী জাদুঘর। প্রতিষ্ঠার ২৮ বছর পেরিয়ে গেছে এ জাদুঘরের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির সহজ-সরল জীবনযাত্রার এক জীবন্ত সাক্ষী ওসমানী জাদুঘর। নগরীর ধোপাদীঘির পাড় এবং নাইওরপুলের মাঝামাঝি জায়গায় বঙ্গবীর-১ নম্বর বাসাটির আলিশান গেটের সামনে দাঁড়ালেই হাতছানি দেবে ওসমানী জাদুঘর।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ধোপাদীঘির পাড়ের বঙ্গবীর ওসমানীর এ পৈতৃক বাড়িটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ শেষে তিনি নিজ উদ্যোগে চমৎকার বাংলো টাইপ ঘর নির্মাণ করেন সেখানে। ১৯৭৬ সালের ১৮ মে এ বাড়ির ২ বিঘা জায়গা দিয়ে তিনি তার বাবা-মার নামে গঠন করেন জুবেদা খাতুন খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ট্রাস্ট। এ ট্রাস্টের মাধ্যমে মেডিকেল ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হয়। একই সঙ্গে ঢাকার ধানমন্ডির রোড ১০-এ, বাড়ি নং ৪২-এর সুন্দরবন নামক ওসমানীর নিজস্ব বাড়ির সম্পত্তি দিয়ে আর্তমানবতার সেবার লক্ষ্যে গঠন করা হয় ওসমানী ট্রাস্ট।

জানা যায়, বঙ্গবীর ওসমানীর মৃত্যুর পর ১৯৮৭ সালে তৎকালীন এরশাদ সরকার সিলেটে ওসমানীর নামে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার আগ্রহ প্রকাশ করেন। সে অনুযায়ী জুবেদা খাতুন-খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ট্রাস্টের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ৯৯ বছরের জন্য ধোপাদীঘির পাড়ের বাড়িটি লিজ নেয় সরকার। ১৯৮৭ সালের ৪ মার্চ এ বাড়িতে ওসমানী জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সেই থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় জাদুঘরের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে এটি।

ওসমানীর পিতৃপুরুষের বাড়ি সিলেট জেলার বালাগঞ্জ থানার (বর্তমানে ওসমানীনগর থানা) দয়ামীরে। তার পিতা খান বাহাদুর মফিজুর রহমানের দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার ছোট ছেলে ওসমানী। ওসমানীর জন্মের প্রাক্কালে ১৯১৮ সালে খান বাহাদুর মফিজুর রহমান তৎকালীন আসামের সুনামগঞ্জ সদর মহকুমায় সাব-ডিভিশনাল অফিসার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তাদের বসবাস ছিল সুনামগঞ্জ সদরেই। সে সুবাদেই সুনামগঞ্জে জন্ম ওসমানীর। বাল্যকালে ওসমানীর আদরের নাম ছিল আতা। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা এই নামেই ডাকতেন। মায়ের কঠোর শাসনের মধ্যে ওসমানী শৈশব জীবন অতিবাহিত হয়। মায়ের প্রতি ছিল ওসমানীর অসীম শ্রদ্ধা।

পিতার চাকরির সূত্রে তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে বিভিন্ন জায়গায়। তাই কিছুদিন পর বদলির আদেশ নিয়ে সুনামগঞ্জ থেকে চলে যেতে হয় গোহাটিতে। আর সেখানেই ওসমানীর প্রাথমিক শিক্ষার শুরু হয়। ১৯২৩ সালে `কটনস্ স্কুল অব আসাম`-এ ভর্তি হন তিনি। লেখাপড়ায় যে তিনি খুবই মনোযোগী ছিলেন তার প্রমাণ হলো স্কুলের প্রত্যেক পরীক্ষায় প্রথম হতেন। ১৯৩২ সালে ওসমানী সিলেট গভর্নমেন্ট পাইলট হাই স্কুলে ভর্তি হন। তৎকালীন সময়ে সিলেটের এই স্কুলটি `ক্যালকাটা ইউনিভর্সিটির` অধীনে ছিল। ১৯৩৪ সালে সিলেট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে। সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে তিনি প্রথম স্থান লাভ করেন। এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য ব্রিটিশ সরকার এম. এ. জি. ওসমানীকে প্রাইওটোরিয়া পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করে। ১৯৩৮ সালে তিনি আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। স্নাতক শেষ করেই যোগ দেন সেনাবাহিনীতে।

তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ১৯৭০ সালে। এ বছর তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে `৭০-এর নির্বাচনে ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ-বিশ্বনাথ এলাকা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ওসমানী সীমান্ত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। ১১ এপ্রিল (১৯৭১) প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ভাষণ দেন। ওই ভাষণে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবকাঠামো গঠনের কথা উল্লেখ করে এম. এ. জি. ওসমানীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা দেন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার, ওসমানীকে করা হয় মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি।

ওসমানী`র নির্দেশনা অনুযায়ী সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সেক্টরের ‘সেক্টর কমান্ডার’ হিসেবে এক একজন সেনাবাহিনীর অফিসারকে নিয়োগ দেয়া হয়। বিভিন্ন সেক্টর ও বাহিনীর মাঝে সমন্বয়সাধন করা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ রাখা, অস্ত্রের যোগান নিশ্চিত করা, গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা- প্রভৃতি কাজ সাফল্যের সাথে পালন করেন ওসমানী। বিচক্ষণতার সঙ্গে সেক্টরগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন।

এটা সবারই জানা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ছিল দক্ষ এবং সংখ্যায় অনেক বেশি। এই বিবেচনায় ওসমানীর রণকৌশল ছিল প্রথমে শত্রুকে নিজেদের ছাউনিতে আটকে রাখা এবং তাদেরকে যোগাযোগের সবগুলো মাধ্যম হতে বিছিন্ন করে রাখা। এজন্য ওসমানী মে মাস পর্যন্ত নিয়মিত পদ্ধতিতে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মে মাসের পর তার মনে হয় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কমসংখ্যক সৈন্য নিয়ে শত্রুকে ছাউনিতে আটকে রাখা গেলেও ধবংস করা সম্ভব নয়। এ বিষয়টি তিনি সরকারকে জানিয়ে যুদ্ধে কৌশলগত পরিবর্তন আনেন। প্রাক্তন ইপিআর এর বাঙালি সদস্য, আনসার, মোজাহেদ, পুলিশ বাহিনী ও যুবকদের নিয়ে একটি গণবাহিনী বা গেরিলাবাহিনী গঠন করেন।

মুক্তির সংগ্রামে ওসমানীর হাতে কোনো নৌবাহিনী ছিল না। তিনি একটি নৌ-কমান্ডো বাহিনী গঠন করেন। আগস্টের মাঝামাঝিতে তারা নদীপথে শত্রুর চলাচল প্রায় রুদ্ধ করে দেন। নৌবাহিনী গঠনের ফলে একটা বড় ধরনের সংকটের অবসান হলেও দেশ স্বাধীন হবার আগে আগে আরও একটা সঙ্কট অনুভব করেন ওসমানী। সেটা হচ্ছে তার হাতে কোনো বিমানবাহিনী ছিল না। শেষের দিকে ছোট্ট একটি বিমানবাহিনীও গঠন করেছিলেন তিনি।

পাকিস্তানী বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী অনুপস্থিত ছিলেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ওসমানী উপস্থিত না থাকার কারন ছিল আর্মি প্রটোকল। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ভারতের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্ব ফ্রন্টের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। অন্যদিকে পাকিস্তানের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ব ফ্রন্টের প্রধান লে. জেনারেল নিয়াজী। এরা দুজনেই ছিলেন আঞ্চলিক প্রধান। অন্যদিকে ওসমানী ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান। তাই সেনাবাহিনীর প্রটোকল রক্ষার্থে কোন সেনাবাহিনীর আঞ্চলিক প্রধানের সাথে তিনি কোন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেন না। ওসমানি নিজেই এ বিতর্কের জবাব দিয়ে গেছেন।

পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে ওসমানী ছিলেন একজন আদর্শ, সৎ চরিত্র ও নিষ্ঠাবান সৈনিক। বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করেও কর্মে নিঃস্বার্থ ও নিবেদিত ছিলেন। সামরিক বাহিনীর সুনাম ও খ্যাতির চেষ্টায় আপ্রাণ পরিশ্রম করতেন। ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বৈশিষ্টপূর্ণ ঐতিহ্য রক্ষায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ। তিনি মাত্র দু’টি ব্যাটালিয়ান থেকে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সংখ্যা ছয়টিতে বৃদ্ধি সহ সেনাবাহিনীতে বাঙ্গালীর সংখ্যা ২ থেকে ১০ এর অধিক করা এবং বাঙালীদের জন্যে নির্দিষ্ট সংখ্যা অনুপাতে কমিশন ও অফিসার পদসহ সর্বস্তরে বাঙ্গালী সিনিয়রদের জন্য পদ সংরক্ষণ করেন।

তিনি কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয় বাংলা কবিতা ‘চল চল চল’ কে পাকিস্তান ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মার্চ সঙ্গীত হিসাবে অনুমোদন লাভে সফল হন। এ ছাড়া পাকিস্তান সামরিক বাদ্যযন্ত্রে সরকারী ভাবে ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’ ও ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গামাটির পথ’ বাংলা গান প্রচলন হয় তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। বেঙ্গল রেজিমেন্ট তার নিরলস প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল। এজন্যে তাকে Father of the regiment বলা হয়। তিনি বাঙ্গালী সেনাবাহিনীর প্রতি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর আচরণ ও ব্যবহারে ক্ষুব্ধ ছিলেন। সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করার পর ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের মন্ত্রীসহ উচ্চ পদের লোভ পেয়েও গ্রহণ করেননি তিনি।

যুদ্ধপরবর্তী জীবনে ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর তাকে বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সের জেনারেল পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৭২ সালে দায়িত্ব থেকে অবসর নেন। মন্ত্রীসভায় যোগ দেন অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ, জাহাজ ও বিমান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে। ১৯৭৩ সালের মার্চে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে ওসমানী তার নিজের এলাকা থেকে অংশ নেন এবং নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেন। ১৯৭৩ এর নির্বাচনে ওসমানী ৯৪ শতাংশ ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন। ডাক, তার, টেলিযোগাযোগ, অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ, জাহাজ ও বিমান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন।

১৯৭৪ সালের মে মাসে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে তিনি সংসদ সদস্যপদ এবং আওয়ামী লীগের সদস্যপদ ত্যাগ করেন। সে বছর ২৯ আগস্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদের প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা পদে নিয়োগ পান, তবে ৩ নভেম্বর জেলহত্যার ঘটনার পর পদত্যাগ করেন। ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওসমানী `জাতীয় জনতা পার্টি` নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৭৮ ও ১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করেন।

১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জেনারেল (অবঃ) এম.এ.জি. ওসমানী ছিলেন গণ ঐক্য জোট এবং  জাতীয় জনতা পার্টি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় আওয়ামী পার্টি (মোজাফ্ফর), বাংলাদেশ পিপলস লীগ, গণ আজাদী লীগ মনোনীত প্রার্থী। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ৩৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। ঐ নির্বাচনে জয়লাভ করেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার।

ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার্থে লন্ডন থাকাকালীন ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেন এই মহাবীর। তিনি পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সিলেটে সমাহিত হন। তার অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী শাহজালাল (রঃ) এর দরগাহ সংলগ্ন কবরস্থানে মায়ের পাশে লাশ সমাহিত করা হয়।

বঙ্গবীর ওসমানীর স্মরণে ঢাকায় গড়ে উঠেছে ‘ওসমানী উদ্যান’ ও স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশ সচিবালয়ের বিপরীতে ‘ওসমানী মেমোরিয়াল হল’। এ ছাড়া তার সিলেটস্থ বাসভবনকে পরিণত করা হয়েছে জাদুঘরে। সরকারি উদ্যোগে সিলেট শহরে তার নামে একটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

বৈচিত্র জীবনের অধিকারী ওসমানীর জীবন ছিল শৈশব থেকেই রুটিন বাঁধা। তিনি আদর্শ, দেশপ্রেম ও মূল্যবোধের ছিলেন এক অনন্য প্রতীক। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি ছিল তার অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা। তিনি ছিলেন কিংবদন্তীর এক মহানায়ক। তার শখ ছিল মৎস্য ও জন্তু শিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি সিনেমা ও যাত্রা দেখতে পছন্দ করতেন। তিনি ছিলেন একজন চৌকষ স্কোয়ার্স গলফ খেলোয়ার ও দক্ষ অশ্বারোহী। ছবি তোলা ও অবসর সময়ে বই পড়া ছিল তার শখ।  ওসমানী ছিলেন চিরকুমার।

মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী জাতির কাছে একটি প্রিয় নাম। তিনি বীরত্ব, কর্তব্য, নিষ্ঠা ও চারিত্রিক গুণাবলীর জন্যে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। অগ্নিপুরুষ ওসমানী এক মহান আদর্শের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অর্নিবাণ শিখায় ভাস্কর। ওসমানী আছেন প্রতিটি বাঙ্গালীর হৃদয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকবেন বাংলার মুক্তির ইতিহাসে।

 

 

 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ সেপ্টেম্বর ২০১৫/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়